রুহ আফজা: দেশভাগের ধাক্কা সামলে এখনো রাজত্ব করে যাচ্ছে শতবর্ষী যে পানীয়
রমজান মাস শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে থেকে বাংলাদেশের দোকানগুলোতে নতুন একটি পানীয় শোভা পেতে শুরু করে। ক্রেতাদের সহজে চোখে পড়ে এমনভাবে তাকে, শোকেসে সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখা হয় টকটকে লাল বোতলগুলো। এমনকি ঔষধের দোকানগুলোতেও তখন এ শরবতের বোতলগুলো রাখতে শুরু করেন ফার্মাসিস্টরা। থরে থরে সাজিয়ে রাখা লালচে-খয়েরি রঙের এ রুহ আফজা বুঝি সবাইকে জানান দেয়, রমজান আসছে খুব শীঘ্রই।
রুহ আফজাকে এক নামে চেনেন বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মানুষ। অভিনব স্বাদের এ শরবতটি রমজান মাসে ইফতারের এক বিশেষ অনুষঙ্গ। রুহ আফজার জন্মের ইতিহাসটাও অনেক পুরনো। সেই ২০ শতকের শুরুতে রুহ আফজা আবিষ্কার করেন দিল্লীর একজন হাকিম। এরপর ইতিহাসের অনেক ধাক্কা সামলেছে রুহ আফজা। দেশভাগের পরেও এ পানীয়টি হারিয়ে যায়নি, বরং ছড়িয়ে পড়েছে উপমহাদেশের এ তিন দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বের অন্যান্য জায়গাতেও।
যেভাবে জন্ম নিলো রুহ আফজা
পুরনো দিল্লীর একটি ভবনে আজও নাকি গোলাপের সুবাস পাওয়া যায়। পরিত্যক্ত ওই ভবনে ঢুকলে এর ভগ্ন রূপ চোখে পড়বে না, বরং এক অদ্ভুত সুগন্ধের মাদকতায় হারিয়ে যেতে হবে সুদূর অতীতে। ১৯০৭ সালে এই ভবনেই হাকিম আবদুল মাজীদ রুহ আফজা তৈরি করেছিলেন।
লাল কুয়ান বাজারের এ ভবনটি হাকিমের দাওয়াখানা ছিল। গ্রীষ্মের কোনো এক কাঠফাটা দিনে তার মনে হলো, রোগীদের জন্য সুস্বাদু ও মন চাঙ্গা করে এমন একটি শরবত তৈরি করলে কেমন হয়। হাকিম সাহেব তার সে চিন্তাকে রূপ দিলেন রুহ আফজায়। 'হামদর্দ দাওয়াখানা'র রোগীদের আরাম দেওয়ার পাশাপাশি ক্রমে এ পানীয়ের খবর ছড়িয়ে পড়লো লাল কুয়ান বাজারেও।
প্রথম যে মানুষেরা রুহ আফজার স্বাদ নিয়েছিলেন, তারা জানতেন না ওই শরবতে কী ছিল। কিন্তু তা-তে থেমে থাকেনি শরবতের ছড়িয়ে পড়ার যাত্রা। তাদের হাত ধরেই দিল্লীর বাইরেও গোলাপের সুগন্ধিতে ভরপুর রুহ আফজা পেতে শুরু করলো মানুষের সমাদর।
হাকিম মাজীদ তার রুহ আফজার জন্য বিভিন্ন ভেষজ গাছ, ফল, ফুল, এমনকি শাকসবজিও ব্যবহার করছিলেন। এগুলোকে নিংড়ে সেখান থেকে যে ঘনীভূত পদার্থ পাওয়া গেল, তাকেই পানি বা অন্য কোনো তরলের সাথে মিশিয়ে রুহ আফজা পান করা হতো। তবে শোনা যায়, মোটামুটি ২১টি বিভিন্ন রকমের গাছগাছড়া, ফুলফলের উপাদান ব্যবহার করেছিলেন আবদুল মাজীদ রুহ আফজা তৈরি করার জন্য।
তখন কি হাকিম মাজীদ বিন্দুমাত্র ধারণা করতে পেরেছিলেন, পুরনো দিল্লীর ছোট এক অন্ধকার গলিতে তৈরি করা তার এ শরবত দেশভাগের ঝঞ্ঝাটেও দিব্যি টিকে থাকবে, তারপর শতবর্ষী হয়ে পৌঁছে যাবে বিশ্বের ৩৭টি দেশে?
রুহ আফজার ছড়িয়ে পড়া
১৯২২ সালে হাকিম মাজীদ মারা যান। এরপর তার স্ত্রী রাবিয়া বেগম দাওয়াখানার ভার তুলে নেন নিজের হাতে। তিনি হামদর্দকে একটি ওয়াকফ হিসেবে ঘোষণা করেন। এটি একটি ইসলামিক দাতব্য প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়। আরও কয়েক বছর পরে বড় ছেলে আবদুল হামীদ হামদর্দের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
পরিবারের ছোট ছেলে মোহাম্মদ সাইদ ইস্টার্ন মেডিসিন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। দেশভাগের পরে ১৯৪৮ সালে সাইদ পাকিস্তান চলে যান। তখনো ভারতে হামদর্দ কোম্পানির দায়িত্বে বড় ভাই হামীদ। পাকিস্তানে হামদর্দ প্রতিষ্ঠা করেন সাইদ।
প্রথমে করাচির আরামবাগ এলাকায় একাই রুহ আফজা তৈরি করা শুরু করেন সাইদ। কয়েক বছর পরে পাকিস্তানে এটির চাহিদা বেড়ে গেলে কারখানা বসান তিনি। ধীরে ধীরে পাকিস্তানে তুমুল জনপ্রিয় একটি পানীয়তে পরিণত হয় হামদর্দের রুহ আফজা।
২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টাইমস স্কয়ারে নাসডাক টাওয়ারের পর্দায় রুহ আফজার বিজ্ঞাপন দেয় হামদর্দ পাকিস্তান। ২০১৯ সালে বর্তমান প্রজন্মের রুচির কথা মাথায় রেখে রুহ আফজা গো নামক একটি কার্বোনেটেড বেভারেজ বাজারে ছাড়ে হামদর্দ। বর্তমানে বিজ্ঞাপনের পেছনে যথেষ্ট মনোযোগ দিচ্ছে হামদর্দ। হামদর্দ ইন্ডিয়ার রুহ আফজার বিজ্ঞাপনে দেখা গেছে জুহি চাওলার মতো জনপ্রিয় বলিউড চিত্রতারকাকেও। হামদর্দ-এর বাংলাদেশ, ভারত আর পাকিস্তানের তিনটি কোম্পানিই স্বাধীনভাবে পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশে রুহ আফজা
রুহ আফজার সবচেয়ে বড় পরীক্ষা ছিল '৪৭-এর দেশভাগের পরেও টিকে থাকা। দিল্লী থেকে শুরু হলেও রুহ আফজা পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশেও ব্যবসা শুরু করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে রুহ আফজা বাংলাদেশে আলাদা করে ব্যবসা আরম্ভ করে।
১৯৯৫ সালে মার্কিন গণমাধ্যম নিউ ইয়র্ক ডেইলি'র এক প্রতিবেদনে একধরনের আইসক্রিমের টপিং-এর কথা জানা যায় যেটাকে 'রুহ আফজা ও দুধের ঘন কাই' হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। নিউ ইয়র্ক সিটির লেক্সিংটন অ্যাভিনিউর একটা বাংলাদেশি দোকানে ওই খাবার প্রতি বোতল চার ডলার হিসেবে বিক্রি করা হতো। ওই প্রতিবেদক এটিকে 'চেরি জুসের মতো দেখতে ও পারফিউমের মতো খেতে' হিসেবে বর্ণনা করেন।
নৃতত্ত্ববিদ লটে হোয়েক তার এক গবেষণায় জানিয়েছেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন সিনেমার সেটে রুহ আফজা ব্যবহার করা হয়। তবে পানীয় হিসেবে নয়, 'রক্ত' হিসেবে। মেকআপ শিল্পীরা ময়দার সাথে রুহ আফজা মিশিয়ে ঘন করে নেন। তারপর এটিকে গল্পের প্রয়োজনে হাত, পা, গাল ইত্যাদি অংশে লাগানো হয় থকথকে জমাট বাধা রক্ত হিসেবে।
বাংলাদেশে রমজানের সময়ে ইফতারে শরবতের ভূমিকা পালন করে রুহ আফজা। এছাড়া বছরের অন্যান্য সময়েও রুহ আফজা পান করেন অনেকে। তবে ২০১৮ সালে রুহ আফজাকে অননুমোদিত উপাদান দিয়ে শরবত তৈরি ও বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপন প্রচারের দায়ে চার লাখ টাকা জরিমানা করেন আদালত। তারপর থেকে অনেকে ভেজালের আশঙ্কায় রুহ আফজা পান করা ছেড়েছেন।
চট্টগ্রামের বাসিন্দা ও একটি গণমাধ্যমের সাংবাদিক ফারুক মুনিরের খাদ্য তালিকায় একসময়ে পছন্দের শীর্ষে ছিল রুহ আফজা। কিন্তু ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ধরা পড়ায় গত কয়েক বছর থেকে তিনি আর রুহ আফজা কেনেন না।
'একটু ঠাণ্ডা পানিতে হালকা রুহ আফজা মিশিয়ে শরবত তৈরী করে ইফতারে খেলে স্বাদটা শরীরের ক্লান্তি দূর করতো। সেই ছোটবেলা থেকেই মনে করতাম শরবত মানেই রুহ আফজা। কিন্তু নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর যখন নিশ্চিত করলো রুহ আফজায় কোনো ফলের রস নেই, সবই কেমিকেল তখন থেকে খাদ্য তালিকায় রুহ আফজা চিরতরে নাই হয়ে গেল,' বলেন তিনি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে রুহ আফজা বিষয়ক বিভিন্ন পোস্টের মন্তব্যের ঘরে অবশ্য রুহ আফজা নিয়ে ভিন্নমত দেখা যায়। এসব পোস্টে অনেকেই জানিয়েছেন, রুহ আফজা ছাড়া তাদের ইফতার যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আবার অনেকে বলছেন ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের কথা জানাজানি হওয়ার পর থেকে তারা রুহ আফজাকে বাদ দিয়েছেন তাদের পানীয়ের তালিকা থেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী তুহিন ইমরানের রুহ আফজা নিয়ে রয়েছে মিষ্টি স্মৃতি। হামদর্দের একটি মাদ্রাসায় পড়ার সুবাদে রুহ আফজার সাথে তার সম্পর্ক অনেক দিনের। সেই ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় ২০১০ সালে প্রথম রুহ আফজার স্বাদ গ্রহণ করেন তিনি।
'রমজানের একটি অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে হামদর্দ কয়েকজন শিক্ষার্থীর পরিবারের জন্য রুহ আফজা সরবরাহ করে। বাড়িতে আনতেই এটা নিয়ে মোটামুটি কাড়াকাড়ি লেগে গেল। এর আগে একে হামদর্দ-এর বিভিন্ন ক্যালেন্ডারে দেখার সুযোগ হলেও এই প্রথম খেতে যাচ্ছিলাম। আব্বুর খাওয়ার অভিজ্ঞতা থাকায় তিনি দায়িত্ব নিয়ে শরবত তৈরি করলেন। রুহ আফজার পরিমাণ পানির সাথে একটু বেশি দিয়ে করায় এটির স্বাদ যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেল,' বলেন এ শিক্ষার্থী।
রুহ আফজা খেতে কেমন লাগে এমনটা জানতে চাইলে ইমরান বলেন, 'আলাদা করে রুহ আফজার স্বাদের কথা আসলে বলার কিছু নেই। এটির স্বাদ বাস্তবেই অসাধারণ এবং অমৃত।' সেই প্রথম রুহ আফজার স্বাদ নেওয়ার পর থেকেই রমজানে নিয়মিতই পরিবারের জন্য রুহ আফজা রাখার চেষ্টা করেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।
চট্টগ্রামের আরেকজন বাসিন্দা ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শর্বাণী দত্তের কাছেও রুহ আফজা সুস্বাদু একটি পানীয়। রুহ আফজার বিজ্ঞাপন দেখে খেতে আগ্রহী হন তিনি। এরপর বাবাকে দিয়ে রুহ আফজা আনান বাসায়।
প্রথমে পানি না মিশিয়ে রুহ আফজা খেয়েছিলেন তিনি। সেটা ভালো লাগেনি। এরপর এক বন্ধুর কাছে জানলেন, অর্ধেক পানি আর অর্ধেক রুহ আফজা মিশিয়ে ফ্রিজে রেখে দিতে হবে। দুপুরের গরমে সেই ঠাণ্ডা রুহ আফজা তার মন জয় করে নিলো।
রুহ আফজার স্বাদ সম্পর্কে শর্বাণী বলেন, 'ফলের স্বাদ, সাথে সিরাপ-সিরাপ একটা ব্যাপার আছে। তবে সেটা আমার ভালো লাগে।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন শিক্ষার্থী সাদিক মাহবুব ইসলামের পরিবারে অনেক আগে থেকেই রুহ আফজার চল ছিল। তবে তিনি পাকিস্তানে তৈরি রুহ আফজা খান। তার মতে, বাংলাদেশি রুহ আফজা যারপরনাই বিস্বাদ।
'২০২০-এর রোজায় প্রথমে দেশি রুহ আফজা কেনার পর শেষ হয়ে গেলে পরে পাকিস্তানেরটা কিনি। তখন দেখি এটার স্বাদ তুলনামূলক বেশি ভালো' বলেন সাদিক। পাকিস্তানি রুহ আফজা এলাকার দোকানেই পাওয়া যায় বলে জানান তিনি।
- তথ্যসূত্র: আল জাজিরা, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস