ইফতারে পুরান ঢাকার জনপ্রিয় শরবত!
বাহারি খাবারের পাশাপাশি অভিনব সব পানীয়র জন্য ভোজনপ্রেমীদের কাছে পুরান ঢাকার আবেদন সবসমসয় অমলিন। শুধু বিরিয়ানি-তেহারিই নয়, দিল জুড়ানো নানান শরবতের টানে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পুরান ঢাকায় ছুটে আসেন ভোজন রসিকেরা। বিশেষ করে চৈত্রের কাঠফাটা গরমে সারাদিন রোজা রাখার পর সেসব শরবতের চাহিদা থাকে তুঙ্গে।
ঠান্ডা লেবুর শরবত থেকে শুরু করে লাচ্ছি, মৌসুমী ফলের শরবত, বাদামের শরবত এমনকি হালের জনপ্রিয় 'মহব্বতের শরবত'—কী নেই পুরান ঢাকার অলি-গলিতে! কর্মব্যস্ত দিন শেষে এক গ্লাস বরফ ঠান্ডা শরবতের চেয়ে আকর্ষণীয় আর কী হতে পারে! শত বছরের ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিশ্রণে তৈরি শরবতগুলো সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ইফতারে যোগ করে সজীবতা। রমজানজুড়ে ঢাকাবাসীর ইফতারে জনপ্রিয় শরবতের খোঁজে তাই পুরান ঢাকা চষে বেড়িয়েছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
রয়েলের পেস্তা বাদামের শরবত ছাড়া অসম্পূর্ণ ইফতার
পুরান ঢাকার লালবাগের হরনাথ ঘোষ রোডে অবস্থিত 'রয়েল রেস্টুরেন্ট'। প্রায় দেড় দশক আগে রয়েলের যাত্রা শুরুর সময়ই মালিক জিয়াউদ্দিন দৈনন্দিন খাবারের পাশাপাশি রেস্টুরেন্টের মেন্যুতে যোগ করেছিলেন পেস্তা বাদামের শরবত। জিয়াউদ্দিনের ভাষ্যে, "বিয়েবাড়িতে যে লাচ্ছি-শরবত দেয় সেটা মানুষের এত পছন্দ দেখে ভাবলাম, আমার রেস্টুরেন্টে ওরকম কোনো শরবত রাখব। তখন দুধ, মালাই, পেস্তা, জাফরান এনে এই শরবত বানালাম। লোকজনকে খাওয়ানোর পর তারা খুব পছন্দ করেছিল। আস্তে আস্তে এটার প্রচারটা দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে গেছে। তখন এই শরবতের দাম ছিল ১২০ টাকা লিটার।"
ইফতারের ঘণ্টাখানেক আগে রয়েল রেস্টুরেন্টের সামনে দেখা যায় রোজাদারদের লম্বা লাইন। ইফতার কিনতে শহরের নানা প্রান্ত থেকে এসেছেন তারা। নানা ধরনের ভাজা-পোড়া, কাবাবের পাশাপাশি বোতলজাত পেস্তা বাদামের শরবত ছিল অধিকাংশের হাতে।
শরবত কিনতে আসা মো. মঞ্জুর হোসেন বলেন, "পেস্তা বাদামের শরবত আরো কয়েক জায়গায় পাওয়া গেলেও রয়েলেরটা সবচেয়ে ভালো। এই রেস্টুরেন্টের শুরু থেকেই আমি তাদের কাস্টমার। এই শরবত ছাড়া আমার বাসায় ইফতার অসম্পূর্ণ।"
বর্তমানে রয়ালের পেস্তা বাদামের এক লিটার শরবতের দাম ৩০০ টাকা। ডিপ ফ্রিজে সর্বোচ্চ তিনদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায় এই শরবত। সারাবছর পাওয়া গেলেও রমজানে এই শরবতের চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। এসময় প্রতিদিন দেড়শো থেকে তিনশো লিটার পর্যন্ত এই শরবত বিক্রি হয় বলে জানান জিয়াউদ্দিন।
শাহী জুস কর্নারের খেজুর মিল্কশেক
লালবাগ চৌরাস্তার কাছেই লালবাগ শাহী জামে মসজিদের বিপরীতে ছোট্ট দোকান 'শাহী জুস কর্নার'। ভেতরে দাঁড়ানোর জায়গাও তেমন নেই। একটা মাত্র বেঞ্চ পাতা। রমজানে ইফতারের আগে বসে খাওয়া নিষেধ সেখানে।
ইফতারের জন্য শাহী জুস কর্নারের সবচেয়ে চাহিদাসম্পন্ন শরবত হলো খেজুর মিল্কশেক, পেস্তা মিল্কশেক, জাম আর জলপাইয়ের জুস। শেষের দুটি ফলের মৌসুম না থাকলেও ফ্রিজিং করে রাখা পাল্প দিয়ে বানানো হয় জুস।
আয়তনে ছোট হলেও শাহী জুস কর্নারের জুসের সুনাম ছড়িয়ে গেছে পুরো শহর জুড়ে। দুধ-খেজুর দিয়ে বানানো তাদের খেজুর মিল্কশেক শক্তিজোগানকারী পানীয় হিসেবে ইফতারে বেশ জনপ্রিয়। দাম প্রতি গ্লাস মাত্র ৫০ টাকা। এখানকার আরেক জনপ্রিয় শরবত পেস্তা মিল্কশেকের দাম প্রতি গ্লাস ১০০ টাকা।
বানানা মিল্কশেক, কাঁচা আমের শরবত, জিরা পানিসহ আরো অনেক ধরনের শরবত শাহী জুস কর্নারে পাওয়া গেলেও সেগুলো ইফতারের জন্য পার্সেল করে নিতে ক্রেতাদের নিরুৎসাহিত করেন কর্মচারীরা। সেখানে কর্মরত রানা হামিদ বলেন, "সবচেয়ে ভালো জুসগুলাই কাস্টমারদের দিতে চাই আমরা। ইফতারের আগে পার্সেল নিলে অনেকসময় ফ্রিজের বাইরে থাকতে পারে সেটা। তখন সব ধরনের জুসের টেস্ট আর ভালো থাকবে না।"
আল-কারীম জুসবারের 'মহব্বতকা শরবত'
শরবতপ্রেমীদের আরেক প্রিয় গন্তব্য নাজিরাবাজার চৌরাস্তায় অবস্থিত 'আল-কারীম জুসবার'। বছর চারেক আগে প্রতিষ্ঠিত এই জুসবারের মালিক প্রথমে ফুটপাতে নানান পাতা দিয়ে শরবত বানিয়ে বিক্রি করতেন। শরবতের ব্যবসার সম্ভাবনাকে পুঁজি করে এখন পুরান ঢাকায় তার দোকানের তিনটি শাখা। ইফতারে আল-কারীমের লাচ্ছি, তরমুজের শরবত, লেবুর শরবতের পাশাপাশি গ্রাহকদের মাঝে সাড়া ফেলেছে 'মহব্বতকা শরবত' আর 'এ্যারাবিয়ান শরবত'।
দোকানের কর্মচারী শুভ আর ম্যানেজার কাউসার জানান, ভারতের এক রেসিপি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে গত রমজান থেকে চালু হয়েছে মহব্বতের শরবত। ড্রাগন ফল, দুধ, তরমুজ কুচি আর কাঠবাদাম কুচি দিয়ে এই শরবত বানান তারা। প্রতি গ্লাসের দাম ১০০ টাকা। এ বছর প্রথম রমজানে নতুন যোগ হয়েছে এ্যারাবিয়ান শরবত। আম, ড্রাগন ফল, তরমুজ, দুধ আর দুই ধরনের বাদাম দিয়ে স্তরে স্তরে সাজানো থাকে এই শরবত। গ্লাসপ্রতি দাম ১৪০ টাকা।
নানান ধরনের ফল আর বাদামের শরবত ছাড়াও ইফতারে আল-কারীম জুসবারের অন্যতম আরেক আকর্ষণ ফালুদা। কাশ্মিরী ফালুদা আর স্পেশাল ফালুদা নামের দুই ধরনের ফালুদা পাওয়া যায় এখানে। দাম যথাক্রমে ১০০ টাকা ও ১৫০ টাকা।
শরবত পার্সেল নিতে আসা ১৩ বছর বয়সী অন্তু জানায়, ইফতারে আল-কারীমের লাচ্ছি আর মহব্বতের শরবত তার সবচেয়ে পছন্দের।
রমজানে সেহরির পর থেকে বেলা ১১টা-১২টা পর্যন্ত বন্ধ থাকলেও সারাবছর প্রায় ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে জুসবারটি। গভীর রাতে জুস বা ফালুদা খেতে এসে ফেরত যেতে হয় না কোনো ভোজনপ্রেমিকে।
শতবর্ষী বিউটির লেবুর শরবত
রায়সাহেব বাজার মোড়ের কাছেই অবস্থিত 'বিউটি লাচ্ছি'র প্রধান শাখা। বর্তমানে দোকানটির লাচ্ছি ও ফালুদার পরিচিতি বেশি থাকলেও ১৯২২ সালে এর পথচলা শুরু হয়েছিল লেবুর শরবত দিয়েই। এখনো প্রতিদিন বিউটির বরফঠান্ডা লেবুর শরবত চুমুকেই প্রাণ জুড়ায় হাজারো মানুষের। ইফতারে যার রয়েছে বিশেষ আবেদন।
দোকানে ঢোকার মুখেই এক কোনায় বসে লেবুর শরবত আর লাচ্ছি বানাতে দেখা যায় বয়স্ক কর্মচারী আমির ও শহীদুল্লাহকে। গ্লাসে বরফ কুচি দিয়ে তাতে চিনির সিরাপ আর টাটকা লেবু মিশিয়ে বানানো হয় লেবুর শরবত। এক গ্লাসের দাম ২০ টাকা। বোতল ভর্তি করে এই শরবত ইফতারের জন্য নিয়ে যান অনেকেই।
বিউটির মিষ্টি বা নোনতা লাচ্ছিও পিছিয়ে নেই ইফতারে রোজাদারদের পছন্দের তালিকায়। শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী এই লাচ্ছির দাম ৫০ টাকা প্রতি গ্লাস।