'ব্যুরো ৫৫৫': কাপড় সংরক্ষণ হবে ডিজিটাল মাধ্যমে
বাংলাদেশ জন্মের আগে থেকে বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতির সাথে কারুশিল্প ও বুননের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। মুঘল শাসনামল থেকে বাঙালির মসলিন, জামদানির বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সমাদর ছিল। কথিত আছে, অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত ঢাকাই মসলিন ও জামদানি সারাবিশ্বে উঁচুমানের বস্ত্র হিসেবে বিবেচিত ছিল। কিন্তু কালক্রমে কারিগরদের মৃত্যুর পরে বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতির হাতে বোনা বস্ত্র, বস্ত্রে তোলা নকশা ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে শুরু করে।
শিল্পবিপ্লবের যুগে টেক্সটাইল ব্যবসার বিস্তার হতে শুরু করলে অনেক স্থানীয় কারিগর তাদের পূর্বপুরুষের গড়ে তোলা বুননের ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। বর্তমানে গুটি কয়েকজন বুননের সাথে জড়িত থাকলেও সংরক্ষণ ও সুযোগ-সুবিধার অভাবে এই শিল্প অনেকটা মলিন হয়ে পড়েছে। তাই সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে এবং তা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে 'ব্যুরো ৫৫৫' নামের একটি প্রতিষ্ঠান উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঐতিহ্যবাহী কাপড় ও কাপড়ে ব্যবহৃত নকশা সংরক্ষণে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে।
ভাবনাকে উদ্যোগে বাস্তবায়ন
'ব্যুরো ৫৫৫' প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতাদের দু'জনের একজন হচ্ছেন লন্ডন নিবাসী গ্যাব্রিয়েল শাইনার-হিল এবং আরেকজন হচ্ছেন নুসরাত মাহমুদ। গ্যাব্রিয়েল শাইনার হিল লন্ডনে বুননের ওপর উচ্চশিক্ষা শেষ করে ২০ বছর ধরে টেক্সটাইল ও ডিজাইনের ওপর কাজ করছেন। 'শাইনার হিল ডিজাইন কনসালটেন্সি' নামক লন্ডনে তার একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। গ্যাব্রিয়েল শাইনার হিলের এই প্রতিষ্ঠানটি বাজারে আসা বিভিন্ন নতুন পোশাক ব্র্যান্ডকে সুযোগ তৈরি করে দেওয়া থেকে তন্তু জোগাড় ও অভিনব সব ডিজাইন করার ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করে। সম্প্রতি গ্যাবি তার পূর্ব পরিচিত সহকর্মী নুসরাত মাহমুদের সাথে সম্মিলিতভাবে 'ব্যুরো ৫৫৫' এর কার্যক্রম শুরু করেছেন। নুসরাত মাহমুদ ঢাকার 'হামিদ ফেব্রিক্স লিমিটেড' প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ও 'বৃহত্ত্ব আর্ট ফাউন্ডেশনের' প্রতিষ্ঠাতা। দীর্ঘকাল ধরে নুসরাত মাহমুদের প্রতিষ্ঠান আমেরিকা ও ইউরোপের মার্কেটে কাপড় রপ্তানি করে আসছে, সেই সূত্রে গ্যাব্রিয়েলের সাথে নুসরাতের পরিচয়।
'ব্যুরো ৫৫৫' এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা নুসরাত বলেন, "করোনা মহামারিতে সবকিছু থমকে গিয়েছিল, তখন টেক্সটাইল সেক্টরেও এর প্রভাব পড়ে। সেসময় গ্যাব্রিয়েলের সাথে আমার প্রায়ই যোগাযোগ হতো। এই সেক্টরে কাজ করতে গিয়ে এতো বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা লক্ষ্য করেছিলাম, গার্মেন্টস সেক্টরটি বিকশিত হলেও এটার সংরক্ষণে যথাযথ ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। তখন আমরা চিন্তা করলাম আমরা একটি কাপড় তৈরি করে প্রথমে নমুনা হিসেবে ক্রেতাদের কাছে পাঠাচ্ছি, তারপর সেটি বৃহৎ পরিসরে উৎপাদনের জন্য কারখানায় পাঠাচ্ছি। এতে একদিকে যেমন সময় ও অর্থ অপচয় হচ্ছে; তেমনি সংরক্ষণের অভাবে অনেক আগে উৎপাদিত কাপড় হারিয়ে যাচ্ছে। আবার কাপড়ের নকশাগুলো সংরক্ষণ করা না থাকলে তা পুনরায় করতে গেলে ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এই ব্যাপারগুলো চিন্তা করে আমি আর গ্যাবি ভাবলাম আমরা কাপড় ও বুনন শিল্পকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করবো।"
"সেই চিন্তা থেকে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে আমরা এটার ওপর গবেষণা চালাতে আরম্ভ করি; কীভাবে কাপড়কে ডিজিটাল রূপ দেওয়া সম্ভব, কোথা থেকে কাপড়ের উৎস সংগ্রহ করতে পারি এবং এক্ষেত্রে কী ধরণের দক্ষতা ও প্রযুক্তির প্রয়োজন হতে পারে এই বিষয়গুলো। প্রায় নয় মাস গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার পর সেপ্টেম্বরে আমরা কাজ শুরু করি। আর এইসব লক্ষ্যমাত্রাকে বাস্তবায়নের জন্য ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে 'ব্যুরো ৫৫৫' এর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয়।"
'ব্যুরো ৫৫৫' এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা গ্যাব্রিয়েল শাইনার হিল বলেন, "ইউরোপের নাম করা 'ইউকে হাই স্ট্রীট' ব্র্যান্ডে কাজ করাকালীন আমার ওপর দায়িত্ব ছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে সেই দেশের টেক্সটাইল মিলগুলো থেকে ভালো মানের কাপড় ও তন্তু সংগ্রহ করা। ভারত, শ্রীলংকা, চায়না, বাংলাদেশসহ আরও অনেক দেশেই আমাকে যেতে হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের 'হামিদ ফেব্রিক্স লিমিটেডের' সাথে দীর্ঘ ১০ বছর কাজ করার সূত্রে প্রায়ই বাংলাদেশে যাতায়াত করতে হতো। সম্প্রতি আমি ও নুসরাত উদ্যোগ নিয়েছি কাপড়কে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে সংরক্ষণ করার এবং স্থানীয় কারিগরদের সহায়তা প্রদান করার।"
'ব্যুরো ৫৫৫' এর কার্যক্রম বাস্তবায়নে ঢাকা ও লন্ডনে কয়েকজন সদস্যের দল রয়েছে। সদস্যদের মধ্যে ঢাকায় ৭ জন ও লন্ডনে ২ জন রয়েছে। কাপড়কে অত্যাধুনিক থ্রি-ডি রূপ দেওয়ার কাজ সম্পন্ন করতে ইটালিয়ান-চাইনিজ বংশোদ্ভূত ও তুর্কি বংশোদ্ভূত দু'জন রয়েছেন। এছাড়াও সুইডেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে অনেকেই যুক্ত হয়ে কাজ করছেন 'ব্যুরো ৫৫৫' এর সাথে। কারুশিল্পকে ডিজিটাল করার মাধ্যমে সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি কাজ শুরু করেছে। 'ব্যুরো ৫৫৫' এর লক্ষ্য স্থানীয় কারিগরদের কাজকে ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরির মাধ্যমে ভবিষ্যতে সহায়তা প্রদান করা। কিন্তু এই কাজটি করতে স্থানীয় কারিগরদের কোনপ্রকার অর্থপ্রদান করতে হবে না।
ডিজিটাল কারুশিল্প প্রচারের মাধ্যমে এই শিল্প সবার কাছে পৌঁছে দিতে কাজ করছে স্টার্টআপ উদ্যোগটি। সম্প্রতি 'ব্যুরো ৫৫৫' নিউ ল্যান্ডস্কেপ প্রোগ্রামের মাধ্যমে ব্রিটিশ কাউন্সিল এবং যুক্তরাজ্যের ফ্যাশন, টেক্সটাইল অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউট (এফটিটিআই) থেকে অনুদান পেয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে এই অনুদান ঘোষণা করা হয়।
কাপড়কে ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষণ
আধুনিক বিশ্বের সবকিছুকে যখন ডিজিটাল রূপ দেওয়া হচ্ছে তাহলে এক্ষেত্রে কারুশিল্প ও বুনন শিল্প পিছিয়ে থাকবে কেন? কিন্তু কাপড়কে কিভাবে ডিজিটাল রূপ দেওয়া যায় এটা নিয়ে সবার মনে প্রশ্ন থাকতেই পারে। এই বিষয়ে গ্যাবি তাদের ডিজিটাল করণীয় প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলেন, "প্রথমে কাপড়ের সামনের ও পেছনের ছবি তুলে সেটাকে স্ক্যান করা হবে। তারপর স্ক্যান করা ছবিকে কম্পিউটারের বিশেষ সফটওয়্যারে টু-ডি ও থ্রি-ডিতে রূপান্তর করা হবে। থ্রি-ডি করার ফলে ছবিকে বড় করে সূক্ষ্ম তন্তুর গঠন ও নড়াচড়ার গতি পরীক্ষা করা সম্ভব হবে। এভাবে কাপড় ও বুনন নকশা সংরক্ষণের পাশাপাশি ক্রেতারা কাপড় ক্রয় করার আগে ওয়েবসাইট থেকে কাপড়ের তন্তু কাছ থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারবেন। কেউ চাইলে কাপড়ের এই ডিজিটাল সংস্করণকে মেটা দুনিয়ার অ্যাভাটার ব্যবহার করে পরিধান করেও দেখতে পারবে।
কারুশিল্প সংরক্ষণের ফলে পরবর্তী প্রজন্ম তা ব্যবহার করে বুননের ওপর গবেষণা করতে পারবে এবং এটি তাদেরকে ঐতিহ্যবাহী কাপড় নিয়ে ধারণা পেতে সহায়তা করবে।
'ব্যুরো ৫৫৫' ইতিমধ্যে কিছু টেক্সটাইল ও গার্মেন্টসের কাপড় নিয়ে কাজ শুরু করেছে এবং স্থানীয় বুনন শিল্পী, কারিগর ও ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠানের সাথে একত্রিত হয়ে কাপড় ও ডিজাইন সংরক্ষণে তাদের আগ্রহী করে তুলছে। এক্ষেত্রে সব ধরণের কাপড় সংরক্ষণের পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী কাপড়গুলো অর্থাৎ মসলিন, জামদানি, তাঁত, খাদি, মনিপুরী তাঁত কে প্রাধান্য দেওয়া হবে। জামদানিসহ অন্যান্য কাপড়ের সূক্ষ্ম নকশা ও কাপড় সংরক্ষণের ফলে সময়ের বিবর্তন ঘটলেও পরবর্তী প্রজন্ম আগামী শত বছর পরেও নিজ দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারবে। 'ব্যুরো ৫৫৫' স্থানীয় ও ক্ষুদ্র কারিগরদের-কে সংরক্ষণের ব্যাপারে অবগত করতে এবং তাদের উৎসাহী করে তুলতে বস্ত্র অধিদপ্তর ও পরামর্শদাতাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার কথা ভাবছে।
নুসরাত মাহমুদ বলেন, "চাহিদা ও উৎসের জোগানের ওপর নির্ভর করে আমরা সংরক্ষণের জন্য কাপড়গুলো বেছে নিব। এগুলো শত বছরের ঐতিহ্যবাহী কাপড় হতে পারে, আবার গার্মেন্টসে উৎপাদিত পলিয়েস্টার, লেদার হতে পারে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত বুনন শিল্পের বিকাশ ঘটাতে ও এই খাতে জড়িত তাঁতিদের ধরে রাখতে ইতিমধ্যে উদ্যোগ নিয়েছে। ফ্রান্স যুগ যুগ ধরে সিল্কের উৎপাদন করে আসছে এবং তাদের ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছে। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত এমন কোন উদ্যোগ আগে নেওয়া হয়নি। তাই আমাদের এই উদ্যোগের মাধ্যমে দেশের ঐতিহ্যকে ধরে রেখে তা সামনে বিকশিত করা এবং নতুন প্রজন্ম ও বিশ্বের কাছে তা তুলে ধরতে চাই।"