বুয়েনস এইরেস: যে শহরের প্রতিটি ফাঁকা জায়গাই নাচের মঞ্চ!
আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এইরেসকে বলা হয় 'প্যারিস অব সাউথ আমেরিকা'। ২০৩ কিলোমিটারের এই কসমোপলিটান শহরে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষের বাস। অভিবাসীদের সংমিশ্রণ, ভৌগলিক অবস্থান, ইউরোপীয় ধাচের স্থাপত্য ও প্রাণবন্ত সংস্কৃতির মিশেলে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে এই শহর। তাই 'দক্ষিণের প্যারিস' নামকরণ করাটা যে মিথ্যে হয়নি তা বলাই বাহুল্য।
বুয়েনস এইরেসের পথে-ঘাটে পা রাখলেই আপনি অনুভব করবেন এক অন্যরকম উত্তেজনা ও প্রাণচাঞ্চল্য। শুধুমাত্র দেশের রাজধানী বলেই নয়, এই শহর প্রাচীন ও নতুনের সংমিশ্রণে এক মোহনীয় আকর্ষণ! রোমান্টিক ট্যাঙ্গো নাচ থেকে শুরু করে ফুটবলের জাদুতে মোড়ানো স্টেডিয়ামের উদ্দাম উল্লাস, কিংবা পার্ক ও জাদুঘরের শৈল্পিক নিদর্শন, বুয়েনস এইরেস আপনার দেখা অন্য যেকোনো শহরের চাইতে হবে আলাদা! তবে এ সবকিছুকে ছাপিয়ে যে কারণে বিখ্যাত হয় উঠেছে এই শহর, তা হলো- নাচ। এই শহরের প্রতিটি খালি জায়গাই যেন একেকটা নাচের মঞ্চ!
পথে-প্রান্তরে নাচ
বুয়েনস এইরেসের বন্দর 'লা বোকা' এমন এক জায়গা যেখানে প্রবেশ করলে আর পরিত্রাণ নেই! না, কেউ আপনাকে আটকে রাখবে না বটে। কিন্তু এ অঞ্চলে আছে ইতালীয় অভিবাসীর দল, যারা বিশ শতকে এসেছিল আর্জেন্টিনায়। সেই সাথে প্রতিপালিত হয়েছিল আর্জেন্টাইনদের সবচেয়ে বড় দুই নেশা- ফুটবল এবং ট্যাঙ্গো নাচ।
সর্বকালের সেরা ফুটবলার ম্যারাডোনার কল্যাণে বোকা জুনিয়রসের নাম হয়তো অনেকেই শুনেছেন। এই বোকা জুনিয়রসের ঘরের মাঠ লা বোমবোনেরা পাশেই চলছে ট্যাঙ্গোর আসর। প্রতিনিয়ত পর্যটকদের মুগ্ধ করছে খোলা রাস্তায় প্রদর্শিত এই প্রেমাবেদনপূর্ণ নাচ।
আর্জেন্টিনায় ট্যাঙ্গো জনপ্রিয় হয়ে ওঠার কথা ব্যাখ্যা করলেন নৃত্যশিল্পী ও ইনস্ট্রাকটর হোরাসিও গোডয়। তিনি বলেন, "লা বোকায় ট্যাঙ্গো জনপ্রিয় হয় যখন এখানকার ইতালীয়রা নিজেদের মতো নাচের ধরন চর্চা করতে থাকে। নতুন জায়গায় বসতি গড়ে তোলার পর সময় কাটাতে তাদের কিছু একটা করা দরকার ছিল। সেই থেকে নাচের চর্চা আরম্ভ করে তারা।"
হোরাসিও জানালেন, ট্যাঙ্গো নিছক একটা নাচই নয়। বরং নারীদের আকৃষ্ট করতে পুরুষের একটি উপায়ও বটে!
তবে আজ থেকে ১২০ বছর আগে খোলা রাস্তায় নারীদের সাথে নাচার উপায় ছিল না। তাই তখন পুরুষেরাই পুরুষদের সাথে নেচে এটি চর্চা করতো। ফলে প্রাথমিকভাবে ট্যাঙ্গো 'দরিদ্র পুরুষদের নাচ' হিসেবে পরিচিত ছিল! ওয়াল্টজ নাচের চেয়ে কম ফরমাল এবং ফক্সট্রটের চেয়ে কম বর্ণবিদ্বেষী এই নাচ আর্জেন্টিনার প্যাশন হিসেবে বহাল হতে খুব বেশি সময় নেয়নি। নারীরা এই নাচে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সাথে সাথেই এর আবেদনময় স্টাইল ঠিক হয়ে যায়, আর বাকিটা ইতিহাস!
ট্যাঙ্গোর আদি নাচের নাম মিলঙ্গা। বুয়েনস এইরেসের অলিগলিতে আগে দেখা যেতো এই নাচ, যেখানে লোকজন একসাথে পানাহার করতে, নাচতো এবং পার্থিব দুঃখ-দুর্দশা ভুলে থাকতে চাইতো। ট্যাঙ্গো নাচে রোমান্টিকতা থাকায় এটিকে সামাজিকীকরণের অংশ হিসেবে ধরা হলেও, শুধু সোশ্যাল ক্লাবে এটি অনুষ্ঠিত হয় না। বুয়েনস এইরেসে বাড়িঘর, রাস্তা, পার্ক- যেখানেই ফাকা জায়গা পাওয়া যাবে, সেখানেই হবে ট্যাঙ্গো!
নৃত্যশিল্পী হোরাসিও যেন আরো এক কাঠি সরেস। তার ভাষ্যে, "ট্যাঙ্গো হচ্ছে একা না থাকতে চাওয়ার অজুহাত! নাচিয়েরা মানুষের মধ্যেই থাকতে পছন্দ করে। গার্লফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড, বন্ধুবান্ধব- সব থাকতে হবে তাদের। কারণ এটা মানুষে মানুষে একটা সংযোগ তৈরি করে।"
অতীতের প্রতি সম্মান
ফুটবলের বাইরে দ্বিতীয় কোনো কিছু যদি বুয়েনস এইরেস শহরের প্রাণকে বাচিয়ে রাখতে পারে, তা অবশ্যই ট্যাঙ্গো। তবে এই আর্জেন্টাইন রাজধানীতে মৃতদেরও দেওয়া হয় অবিশ্বাস্য সম্মান। দক্ষিণ আমেরিকার অন্য যেকোনো দেশের চাইতে, এখানে মৃত ব্যক্তিদের মর্যাদা দেওয়া হয় সবচেয়ে বেশি। আর তার জন্য চমৎকার রেকোলেটা সমাধিস্থানকে ধন্যবাদ দিতেই হয়!
বিশাল বিশাল গম্ভুজ ও স্মৃতিস্মম্ভ দাঁড়িয়ে আছে এখানে। বুয়েনস এইরেসের বাসিন্দারা নিজেদের শেষ পয়সাটিও ব্যয় করতে রাজি প্রিয়জনের সমাধিস্তম্ভ তৈরি করতে, যাতে তাদের স্মৃতিটুকু কখনো হারিয়ে না যায়। তবে ইভা পেরোনের সমাধিই বোধহয় সবচেয়ে বেশি দর্শন করেছেন মানুষ। অভিনেত্রী ও পরবর্তীতে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া আইকন ইভিটার নামে পরিচিত এই সমাধিটি। মাত্র ৩৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছিলেন এই নারী। প্রথম ২০ বছর এক মিত্রর অধীনে ইতালিতে সমাধিস্থ করা থাকলেও, পরে সেটি আর্জেন্টিনায় আনা হয়।
আর্জেন্টিনার ফার্স্ট লেডি ছিলেন ইভিটা বা ইভা পেরন। রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার পর দেশের নারীদের ভোটাধিকার আইনের জন্য লড়াই করেছেন। আর্জেন্টিনার নিম্নশ্রেণীর মানুষের অধিকার আদায়ে একাধিক আইন সংস্কারে সাহায্য করেছেন।
স্থানীয় ঐতিহাসিক ক্যামিলা পেরোচেনার মতে, "ইভিটা আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তিত্ব। বিশ শতকে যে কজন আর্জেন্টাইনকে বাইরের বিশ্ব চিনতো, তিনি ছিলেন তাদের একজন।"
ইভিটার পরে এ জায়গা দখল করেছেন ফুটবল ঈশ্বর দিয়েগো ম্যারাডোনা। কিন্তু মৃত্যুর পর ৭০ বছর পরেও, আজও ইভিটার কাজ নিয়ে কথা হয় বুয়েনস এইরেসে। তার অস্তিত্ব আজও অনুভব করেন শহরের মানুষ।
সূত্র: সিএনএন