ঢাকার ভ্রাম্যমাণ ছবিওয়ালা
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, ইউরোপীয়দের হাত ধরে ছবি তোলার প্রযুক্তি এসেছিল বাংলায়। ব্যয়বহুল আর জটিল কলাকৌশলের কারণে প্রথমদিকে এর চর্চা কেবল বিত্তশালী এবং অভিজ্ঞদের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে, স্বেচ্ছায়-অনিচ্ছায় একের পর এক ছবিতে বন্দি হয় এদেশের মানুষ।
প্রথম প্রথম ক্যামেরার সামনে সাধারণ বাঙালির দাঁড়াবার অভিজ্ঞতাও সুখকর কিছু ছিল না। দীর্ঘ এক্সপোজারে ব্যক্তিকে স্থির রাখবার প্রয়োজনে সেকালের ফটোগ্রাফাররা বাঙালির মনে নানা অমূলক ভয়ভীতি ঢোকাতে দ্বিধা করেননি। উনিশ শতকের শেষভাগ নাগাদ এ অবস্থা অনেকটা কেটে যায়।
ছবি তোলার প্রযুক্তি দ্রুত পাল্টাতে থাকে। এ হাত সে হাত ঘুরে ছবি তোলার প্রযুক্তি পৌঁছে যায় সাধারণের কাছে। কখনো একা, কখনো সপরিবারে বাঙালি এসে দাঁড়ায় লেন্সের সামনে। ধীরে হলেও প্রথা ভেঙে অনেক তরুণ ছবি তোলাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন, বাঙালি ভালোবেসে তাদের নাম দেয় ফটোওয়ালা বা ছবিওয়ালা।
বিশ শতকের শুরু থেকে ছবি তোলাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েন।
পূর্ববঙ্গের প্রধান শহর ঢাকায় পেশাদার স্টুডিওর বাইরে স্ট্রিট ফটোগ্রাফার বা ভ্রাম্যমাণ ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করতে দেখা যায় অনেককে। সাধারণ মানুষের কাছে এদের ব্যবহৃত ক্যামেরা গুলো পরিচয় পায় 'মিনিট ক্যামেরা' নামে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ কাজে ব্যবহৃত ক্যামেরাগুলো ছিল খুবই সাধারণ, ৪"x৫" সাইজের প্লেট ক্যামেরা। শহরের ব্যস্ত এলাকায়, রাস্তার ধারে মিনিট ক্যামেরাসহ দাঁড়িয়ে তারা ছবি তোলার আহ্বান জানাত। মাথায় ক্যামেরা বহন করে এক শহর থেকে অন্য শহরে ঘুরে বেড়াত এরকম অনেক ফটোগ্রাফারও ছিলেন।
স্টুডিও থেকে অনেক কম দামে এসব জায়গায় ছবি তোলার সুযোগ ছিল। একটা খোলা জায়গায় এক টুকরো কাপড়কে ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহার করে ছবি তোলা হত। সে কাপড়ে আঁকা থাকত তাজমহল, রাজবাড়ির বাগান, ধবধবে সাদা বাড়ি, বাড়ির সিঁড়ি, বাগানের ফোয়ারা, ফুলগাছ ইত্যাদি নানা দৃশ্য। একটি দৃশ্য ছিল উড়োজাহাজের, জানালায় খদ্দরের মুখ কেটে বসিয়ে দেয়া হত। ঢাকায় পেশাদার স্টুডিওপাড়া ছিল মূলত নবাবপুর রোড, তবে মিনিট ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যামেরাম্যানদের দেখা মিলত ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন, সদরঘাট, আর ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায়।
ফুলবাড়িয়া স্টেশনের ছবিওয়ালাদের নিয়ে নন্দিত অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামানের স্মৃতিচারণ- "ফুলবাড়িয়ায় ক্যামেরাম্যানরা বসত, লম্বা পর্দা দিয়ে ক্যামেরার ভেতর মাথা ঢুকিয়ে ছবি তুলত। 'আন' ছবিতে দীলিপকুমারের ছোরা হাতে দাঁড়ানো ছবির মতো আমাকে দীলিপকুমার বানিয়ে দিতে বললাম। পাঁচ সিকা নিল। ইচ্ছে ছিল মধুবালার ঘাড়ে হাত দেব, এতে দুই টাকা লাগবে। তখন ওরা আমার গলা কেটে দীলিপ কুমার বানিয়ে দিল"।
নাট্যকার সাঈদ আহমদের স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে ভিক্টোরিয়া পার্কের এক ফটোগ্রাফার জনাব মোস্তফা হোসেনের কথা। মোস্তফা হোসেন ছিলেন কানপুরের অধিবাসী। বিভিন্ন থিয়েটারে কাজ করেছিলেন। এক সময় ঢাকার লায়ন থিয়েটারে যোগ দেন স্টেজ নির্দেশক ও অভিনেতা হিসেবে। সিনেমার আগমনে মঞ্চের তখন নিভু নিভু অবস্থা। ততদিনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। ঢাকা জুড়ে ব্রিটিশ আর মার্কিন সৈন্যের ছড়াছড়ি। বিকালের দিকে অনেকেই সমবেত হতেন ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায়। এ সময় মোস্তফা হোসেন নিজের তৈরি কালো রঙের বক্স ক্যামেরাখানা বিরাট তেপায়ার উপর বসিয়ে শুরু করলেন ছবি তোলার ব্যবসা।
ছবি তোলাটা আগেই জানা ছিল মোস্তফা হোসেনের। পরিচিতজনদের বিভিন্ন পারিবারিক আয়োজনের ছবি তিনিই তুলে দিতেন। থিয়েটারের দুর্দিনে ছবি তোলার শখ বদলে গেল পেশায়। সাঈদ আহমদের লেখা থেকে- "এক বালতি পানি সবসময় মজুত থাকতো মোস্তফা হোসেনের সঙ্গে। সেই পানিতে ছবিগুলো চুবিয়ে দিয়ে টানা দড়িতে ক্লিপ দিয়ে আটকাতে আটকাতে বলতেন, 'ব্যাস আভি হি শুক যায়েগা ক্যাপ্টেন সাব, এক মিনিট ফটো রেডি বারোবার।"
ওই ফটো দিয়ে চমক লাগিয়ে দিতেন মোস্তফা হোসেন। ওঁর তোলা ছবি মায়ের কাছে, প্রেয়সীর কাছে বা বউয়ের কাছে পাঠাতেন সোলজাররা। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার পর্দায় অঙ্কিত তাজমহলের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ছবি উঠানোর ব্যাপারটা "ওয়ান মিনিট ফটো বারোবার কামিং টু লেন্স', এটাই কথোপকথনের সারাংশ ছিল। আর সোলজাররা নিয়ে যেত একটা করে মেমেন্টো।"
কথাসাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকের কলমে উঠে এসেছে এক ছবিওয়ালার কথা যার ব্যবসা ছিল পুরাতন জজ কোর্টের পেছনে, খোলা আকাশের নীচে- "বাঁশের তিনটি খুঁটি, দু'টা খাড়া পোঁতা, সেই দু'টার ওপর আড়াআড়ি আরেকটি বাঁশ, সেই বাঁশে ঝোলানো পর্দা, পর্দায় সিনারি- সে সিনারিতে কাঁচা দগদগে রঙে আঁকা একটা বাড়ির সম্মুখভাগ.."।
তবে আশির দশকের শেষভাগ তখন; ব্যবসার পড়ন্ত কাল। ছবি তোলার খদ্দরের তখন বড় অভাব। কোর্টে জমায়েত মানুষদের কেউ কাছে দাঁড়ালেই তাকে সাথে সাথে ডাকছেন- "আসেন, আসেন, ফটো তোলেন।"
নব্বইয়ের দশকের গোড়াতেও ঢাকার গুলিস্তান, নবাবপুর রোড, পুরাতন জজ কোর্ট এবং ধানমন্ডিতে ভারতীয় দূতাবাসের সামনে মিনিট ক্যামেরাসমেত বেশ কয়েকজন ফটোগ্রাফারের দেখা মিলত। সময়ের বিবর্তনে সেসব এখন শুধুই স্মৃতি।
লেখকের 'সেকালের ছবিওয়ালা' নামে আলোকচিত্র-ইতিহাস বিষয়ক পূর্ণাঙ্গ বই প্রকাশের অপেক্ষায়, প্রকাশক: কবি প্রকাশনী]