ডিমের ঝুরি ভাজা: যেভাবে পারস্যের খাবারটির বারবার বিবর্তন ঘটল উপমহাদেশে
বাংলায় খাবারটি প্রচলিত ডিমের ঝুরি ভাজা বা ডিম বেগুনের ভর্তা নামে। হিন্দি ভাষায় একে সবাই 'আন্ডা ভুর্জি' নামে চেনে। ডিম আর বেগুনের এ পদটি খেতে যতই বাঙালি-বাঙালি লাগুক, এটি উপমহাদেশে এসেছে কিন্তু পারস্য তথা ইরান থেকে। পারস্যের খাগিনা নামের খাবারটিই এ অঞ্চলে ডিমঝুরি ভাজা হিসেবে বাঙালির পাত পাকাপোক্তভাবে দখল করে নিয়েছে।
ডিমকে ফার্সি ভাষায় 'খাগ' বলে ডাকা হয়। এই খাগ থেকেই খাগিনার উৎপত্তি। খাগিনা পারস্যে মানুষের খাবারের তালিকায় রয়েছে কয়েকশ বছর ধরেই। তবে কখনো কখনো এর রূপ বদলেছে।
ফার্সি ভাষার অনেক ধ্রুপদী সাহিত্যিকদের লেখায় খাগিনার উল্লেখ পাওয়া যায়। আমির খসরু তার ১৩ শতকে লেখা বাঘ ও বাহার-এ খাগিনার কথা উল্লেখ করেন। এটি আবার ঘেইগানাখ নামেও পরিচিত। একবারে মুখে পুরে দেওয়া যায় এমন আকৃতিতে তৈরি করা এ খাবারটি সিরাপে ডুবিয়ে পরিবেশন করা হয়।
তবে বাংলায় যেটা বেগুনের খাগিনা নামে পরিচিত, তার সাথে ইরানের খাগিনা'র বাইরেও আরেকটি খাবারের মিল রয়েছে। সেটির নাম মির্জা ঘাসেমি। টমেটো ও বেগুন পোড়া মিশিয়ে বিভিন্ন মশলার সহযোগে একটি উপাদান তৈরি করা হয়। সে উপাদানে কাঁচা ডিম ভেঙে আবারও মিশ্রণ বানিয়ে সেই ডিম পোচ করলেই তৈরি হয়ে যায় মির্জা ঘাসেমি।
মোগলদের খানাতেও খাগিনার উপস্থিতি ছিল। তবে সে খাগিনায় মশলা'র দিকটাকে আরেকটু উন্নত করা হয়েছিল। শাহজাহানের সময়ে এটি খাগিনা-ই-বাইজ নামে পরিচিত ছিল মোগল রসুইঘরে। এটির উপাদান তালিকায় ছিল ডিম, পেঁয়াজ, আদা, ধনেপাতা, দারুচিনি, লবঙ্গ, সবুজ এলাচ, ও গোল মরিচ। তাওয়ায় ঘি ফেলে তার মধ্যে রান্না করা হতো এটি। পরিবেশন করার আগে জাফরান ছিটিয়ে দেওয়া হতো।
১৯ শতকের ব্রিটিশ ভারততত্ত্ববিদ স্যানফোর্ড আর্নটের লেখায় খাগিনা রান্নার আরেকটু জটিল প্রক্রিয়ার কথা জানা যায়। তার বর্ণিত খাগিনা বানাতে তৈরি হতো মটর ডালের ময়দা, পেঁয়াজ, দই বানানোর দুধ, এলাচের গুঁড়ো, লবঙ্গ, ও ধনেপাতা। এগুলো সব মিশিয়ে কয়লার আগুনে মাখনের মধ্যে রান্না করা হতো।
বাংলার প্রাচীন রন্ধন-পুস্তকগুলোর একটি হচ্ছে ব্যঞ্জন রত্নাকর। বর্ধমান রাজপরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় এটি ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত হয়। এ বইতে উল্লেখ করা হয়েছে খাগিলা নামক একটি খাবার রান্নাপ্রণালীর কথা। মধুরম্ল খাগিলা নামের ওই খাবারটি তৈরি করা হতো মাংস ও ডিমের প্যানকেক মিশিয়ে। সাথে থাকত চিনি ও লেবুর রস।
এ বইয়ে মূল খাগিনার প্রায় কাছাকাছি যে পদটির কথা উল্লেখ আছে সেটি হচ্ছে শিরাজ ভর্তা। শিরাজ ইরানের একটি শহর। শিরাজ ভর্তা তৈরি করা হতো সিদ্ধ বেগুন, ডিম, পেঁয়াজ, আদা, মশলা, দই, কিসমিস, পনির, ঘি ইত্যাদি একত্রে মিশিয়ে তার ভর্তা বানিয়ে।
উপমহাদেশের মুসলিম রান্নাঘরগুলোতে খাগিনা একটু ভিন্নভাবে তৈরি করা হয়। তাদের কাছে খাগিনা মানেই একটু থকথকে ডিম ভুনা। লক্ষ্ণৌ, পাকিস্তান ইত্যাদি জায়গায় খাগিনা খাওয়া হয় মূলত সকালের নাস্তা হিসেবে। এসব অঞ্চলের খাগিনা তথা ডিম ভুনায় আরও থাকে পেঁয়াজ, মরিচ, পেঁয়াজকলি, ধনেপাতা, রসুন ও চাট মশলা।
পাকিস্তানে সকালের নাস্তা হিসেবে খাগিনার জুড়ি নেই। এর আবার রয়েছে পাঞ্জাবি ও মুহাজির রকম। যেসব ভারতীয় উর্দুভাষী দেশভাগের সময় পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন, তারাই মুহাজির নামে পরিচিত। এদিকে আফগানদের সকালবেলার নাস্তার পাতেও থাকে খাগিনা।
পাকিস্তানি খাগিনার সাথে আবার মিল রয়েছে পারসি আকুরি নামের আরেকটি খাবারের। মশলাপাতি দিয়ে ঘন করে ডিম রান্না করলেই হয়ে যায় পারসি আকুরি। অবশ্য তাতে কিছু আলুও থাকে। লাহোরে অনেকে খাগিনাকে আন্ডা ভুর্জি নামেও চেনে।
দক্ষিণ ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি খাবার রয়েছে যেটির সাথে খাগিনার কিছু মিল দেখা যায়। ডিমের তৈরি মুত্তা চিক্কি নামের এ খাবারটি ওই অঞ্চলের মুসলিমদের প্রিয় এটি পদ। সুন্দর করে কাটা পেঁয়াজ ও মরিচকে অল্প হলুদ মেশানো পানিতে সিদ্ধ করা হয়। পানি সিদ্ধ হয়ে উড়ে গেলে পেঁয়াজ নরম হয়ে যায়। এরপর সেখানে ডিম ভেঙে দেওয়া হয়। তারপর লবণ, মরিচ দিয়ে তা রান্না করা হয়।
মুত্তা চিক্কি সবচেয়ে ভালো যায় নরম ভাত, ময়দার রুটি ইত্যাদির সাথে। রান্নাঘরে আনাজপাতি কম থাকলে বা হুট করে বাড়িতে অতিথি এসে উঠলে সহজেই মুত্তা চিক্কি রান্না করে পরিবেশন করা যায়।
খাগিনার একটি জনপ্রিয় রূপভেদ দেখা যায় হায়দ্রাবাদে। এটিকে হায়দ্রাবাদি আন্ডে কা খাগিনা নামে ডাকা হয়। প্রথমে তেলের মধ্যে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, বেশি পরিমাণে টমেটো, জিরা, ধনেপাতা, রেড চিলি, হলুদ, গরম মশলা ইত্যাদি রান্না করে থকথকে করা হয়। এরপর সেটার মধ্যে কাঁচা ডিম ভেঙে আবারও রান্না করে তৈরি করা হয় এ খাগিনাটি।
তবে অনেকে হায়দ্রাবাদি আন্ডে কা খাগিনা'র সাথে লেভান্টাইন শাকশোকা বা তুরস্কের মেনেমেন খাবারের মিল খুঁজে পান। মোগলদের রান্নাঘরে খাগিনা পারস্যের পাচকেরা আমদানি করেছেন বলে ধারণা করা যায়। অন্যদিকে হায়দ্রাবাদের সাথে তুরস্ক ও ইয়েমেনের হাদরামি আরবদের সাথে যোগাযোগ ছিল। তাই হয়তো তাদের খাগিনার সাথে অনেকে তুরস্কের খাবারের মিল খুঁজে পান।
উপমহাদেশে খাগিনার বিবর্তন হয়েছে অনেকবার। অঞ্চলভেদে এর রান্নাপ্রণালীও বারবার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এই প্রতিটি রূপভেদের ফলে সৃষ্টি হয়েছে নিজস্ব স্বাদ, বৈচিত্র্য, আর কিছু স্মৃতি। খাগিনার হয়তো আরও অনেক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাবে, কিন্তু খাবার হিসেবে এটি সবসময় অতুলনীয় হিসেবেই বিবেচিত হবে।
- মূল লেখা: প্রিয়দর্শিনী চ্যাটার্জি, স্ক্রল ডট ইন
- অনুবাদ: সুজন সেন গুপ্ত