জীবন সুন্দর! আত্মহত্যা থেকে নতুন জীবনে ফিরিয়ে আনতে পাশে আছে ‘কান পেতে রই’
হতাশা, বিষণ্নতা, দুশ্চিন্তা একধরনের মানসিক ব্যাধি। এই ব্যাধিগুলোর ভয়াবহতা এতোটাই বেশি যে এগুলো মানুষকে অযোগ্য, ব্যর্থ অনুভব করিয়ে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে যেখানে বেশিরভাগ মানুষ নিম্ন আয়ের, তাদের কাছে মানসিক ব্যাধি নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কোথায়! তবুও বিষয়টিকে উপেক্ষা করা যায় না। কারণ দিনকে দিন মানসিক রোগে আক্রান্তের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি বেড়ে চলেছে মানুষের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা।
আত্মঘাতী মানুষকে মানসিক সহায়তা দিতে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো হেল্পলাইন সেবা নিয়ে হাজির হয় 'কান পেতে রই' নামের সংস্থাটি। ২০১৩ সাল থেকে সংস্থাটি অনলাইন ও ফোন কলের মাধ্যমে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষকে সেবা দিচ্ছে। কেউ চাইলে নিজেদের নাম, পরিচয় গোপন রেখে 'কান পেতে রই'-এর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে নিজেদের হতাশার কথা শেয়ার করে কিছুটা চাপমুক্ত হতে পারেন। সেবা গ্রহণের জন্য গ্রাহকের কোনোরকম ফি প্রদান করতে হয় না। সংস্থাটির মূল নীতি হচ্ছে, গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে তাদের অনুভূতিকে মূল্যয়ন করার পাশাপাশি আস্থার সঙ্গে মানসিক সহায়তা দেওয়া এবং আত্মহত্যার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত থেকে ফিরিয়ে এনে স্বাভাবিক জীবনমুখী করা।
পাশে থাকবে 'কান পেতে রই'
সংস্থাটির প্রশিক্ষণ ও প্রচার বিভাগের প্রধান আশিক আব্দুল্লাহ জানান, 'কান পেতে রই-এর প্রতিষ্ঠাতা ইশেম ইকবাল আমেরিকার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানের ওপর উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। আমেরিকার আত্মহত্যা প্রতিরোধক সংস্থা 'বোস্টন সামারির্টানে' স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করাকালীন তিনি দেখেছেন বিশ্বের ৪০টি দেশে এই ধরনের হেল্পলাইন সেবা চালু রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান আত্মহত্যা রোধ করা এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় উন্নয়নের জন্যে অনেক অবদান রাখছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে মানসিক সেবার যথাযথ ব্যবস্থা নেই এবং মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয় না; যার ফলাফলস্বরুপ গত কয়েক বছরে আত্মহত্যার সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। সেখান থেকেই তার ভাবনার শুরু এবং ধারণা করেছিলেন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এরকম কোনো কার্যক্রম চালু করতে পারলে তা বেশ ফলপ্রসূ হবে। যেখানে সবাই নির্দ্বিধায় মন খুলে নিজেদের কথাগুলো বলতে পারবে এবং পৃথিবীতে তারা একা, তাদের কথা শোনার মতো লোক নেই—এরকমটি বোধ হবে না। যা আত্মহত্যার মাত্রা অনেকাংশে কমিয়ে আনতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারবে।'
আশিক আব্দুল্লাহ বলেন, 'আমাদের সংস্থা সেবা প্রদানে "সুইসাইড প্রিভেন্ট মডেল" অনুসরণ করে। সেবাপ্রত্যাশীদের সঙ্গে কথা বলার সময় তাদের মনের ভেতর কী চলছে এবং তাদের অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করে স্বেচ্ছাসেবকরা। নানারকম মানসিক চাপে ও হতাশায় থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করার মাধ্যমে তাদেরকে কম্ফোর্ট অনুভব করানো, যেন তারা নিঃসঙ্কোচে তাদের কথাগুলো আমাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে। হতাশার সময়গুলোতে মানুষ পরিবার, বন্ধু ও কাছের মানুষের থেকে মানসিক সহায়তা প্রত্যাশা করে। কিন্তু তাদের সঙ্গে মন খুলে নিজেদের কথা প্রকাশ করতে অনেকের মাঝেই সংকোচ কাজ করে। আবার নিজেদের অনুভূতিকে অন্যরা যথাযথ মূল্যয়ন না করলে একরকমের জড়তা থেকে সেই কথাগুলো কাউকে না বলে আমরা নিজেদের গুটিয়ে নিতে থাকি। আমাদের হেল্পলাইনের মূল উদ্দেশ্য সমাজের মানুষের মনে হতাশা, একাকিত্ব, মানসিক চাপ ও আত্মহত্যার প্রবণতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করা; তাদের মানসিক সমর্থন জোগানো। এই লক্ষ্যটি মাথায় রেখে কান পেতে রই গোপনীয়তা এবং সহমর্মিতার সঙ্গে সম্পূর্ণ খোলা মনে অন্যদের কথা শোনে।'
মানসিক স্বাস্থ্য কেন গুরুত্বপূর্ণ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ বলছে—বাংলাদেশে বছরে আত্মহত্যা করছে প্রায় ১৩ হাজার মানুষ এবং গড়ে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে ৩৫ জন। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ শুধু ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষপানে আত্মহত্যা করেন।
২০২০ সালে 'বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো' ও 'আঁচল ফাউন্ডেশনের' জরিপানুযায়ী, অন্যান্য বছরের তুলনায় করোনাকালে আত্মহত্যার হার ৪৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেড়ে গিয়েছিল। যার মধ্যে এক বছরে ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা যেমন দিনকে দিন বাড়ছে, তেমনি সমাজের বিত্তবানেরাও আত্মহত্যার পথে ঝুঁকছেন। আত্মঘাতী হওয়ার এই প্রবণতা কেন?
মানসিক স্বাস্থ্যও যে শারীরিক স্বাস্থ্যের মতোই গুরুত্বপূর্ণ, তা অনেকেই বুঝতে পারেন না। অনেকে আবার মানসিক স্বাস্থ্যকে ও এর সঙ্গে জড়িত সমস্যাগুলোকে হাসি ঠাট্টার ছলে পাগলের ডাক্তারের সঙ্গে তুলনা করেন। মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারটি ফলাও করে প্রচার ও জনসচেতনতা সৃষ্টির যথাযথ ব্যবস্থার অভাবে অনেকের অজ্ঞতার আড়ালে রয়ে গেছে। তাই তো হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তিদের বেশিরভাগই আত্মঘাতীর মতো সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলেও তা নির্মূলে কী কী করণীয় সে বিষয়ক যথাযথ জ্ঞান রাখেন না।
গত ৯ বছরের যাত্রায় কান পেতে রই-এর কাছে প্রায় ৪০ হাজার ফোনকল এসেছে। যার মধ্যে ৫ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ৮০০ জন ব্যক্তি সরাসরি তাদের আত্মহত্যার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। জীবনের প্রতি মায়া ও বেঁচে থাকার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলেছেন বলে তারা এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানান। আর এদের মধ্যে ২০ শতাংশ ব্যক্তি জানিয়েছিলেন, তারা দিন দিন আত্মহত্যাপ্রবণতার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। ফোনকল করা ব্যক্তিদের বেশিরভাগের বয়স ছিল ২১-৪০ বছর। যাদের শতকরা ৫১ ভাগ নারী ও বাকি ৪৯ ভাগ ছিল পুরুষ।
আশিক আব্দুল্লাহ সংস্থাটির সঙ্গে শুরু থেকেই কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি জানান, 'ফোনকল করা ব্যক্তিদের হতাশার জায়গা ও সমস্যাগুলো তাদের ব্যক্তিজীবন ও পারিপার্শ্বিক, অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে ভিন্ন ভিন্ন হয়। বেশিরভাগের হতাশার মূল কারণগুলো থাকে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, পেশা, শিক্ষা, কাজের বৈষম্য, পারিবারিক অবমাননা ও অত্যাচার। আরও নানারকম সমস্যা ও ঝামেলা থাকে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির জীবনে।'
স্বেচ্ছাসেবক কারা
স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগে সংস্থাটি কয়েকটি মানদণ্ড ও বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করে। তবে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, কান পেতে রই তাদের স্বেচ্ছাসেবকদের কোনোরকম আর্থিক সাহায্য বা বেতন প্রদান করে না। স্বেচ্ছাসেবকেরা সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে, নিজ ইচ্ছায় সংস্থাটির সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করেন এবং অন্যদের জীবনকে স্বাভাবিক পথে ফিরিয়ে আনার গুরুদায়িত্ব নেন। তাই অন্যদের কথা শোনার মতো ধৈর্য ও তাদের সমস্যা অনুভব করার মতো মানসিক দক্ষতা স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে আছে কি না, তা যাচাই-বাছাই করেই নিয়োগ দেওয়া হয়। মানসিক ভঙ্গুরাবস্থায় থাকা কোনো ব্যক্তির মানসিক অবস্থা সহমর্মিতার সঙ্গে গভীরভাবে উপলব্ধি করে, সে প্রসঙ্গে কথা বলার সক্ষমতা গড়ে তুলতে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগের পর সংস্থাটি সাপ্তাহিক ছুটির ২ দিন প্রশিক্ষণ দেয়।
ওয়েবসাইটে থাকা ফর্ম পূরণের মাধ্যমে ১৮ বছর বয়সের বেশি যে-কেউ স্বেচ্ছাসেবক পদের জন্য আবেদন করতে পারেন। কিন্তু বিশ্বস্ততার বিষয়টি এক্ষেত্রে প্রাধান্য সহকারে বিবেচনা করা হয়। কারণ সংস্থাটি তার কোনো গ্রাহকের তথ্য সংরক্ষণ করে তা পুনরায় অন্য কোথাও ব্যবহার করে না। তাই নিয়মটি কোনো স্বেচ্ছাসেবক যেন ভঙ্গ করতে না পারেন, সেজন্যে নিয়োগের সময় গোপনীয়তা রক্ষার চুক্তিতে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। যদি কোনো স্বেচ্ছাসেবক ব্যক্তিস্বার্থে তথ্য পুনরায় ব্যবহার করেন বা ফোনকল করা ব্যক্তির সঙ্গে বিনা কারণে পুনরায় নিজ থেকে যোগাযোগ করেন, তখন গঠনতন্ত্র নিয়মনুযায়ী সংস্থাটি যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে সংস্থাটি নিয়োগের আগে স্বেচ্ছাসেবকের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে খবর সংগ্রহ ও সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচন-পরবর্তী নিয়োগ দেয়। স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষদের সমানভাবে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। নীতি অনুসরণের মাধ্যমে আস্থার সঙ্গে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সংস্থাটি গ্রাহক সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
কান পেতে রই একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ও শুরু থেকেই ব্যক্তি-অনুদানে চালিত। বিভিন্ন ইভেন্ট আয়োজনের মাধ্যমেও সংস্থাটি অনুদান সংগ্রহ করে পরিচালন ব্যয় জোগাড় করত। সম্প্রতি সাজিদা ফাউন্ডেশনের সঙ্গে একত্রিত হয়ে কাজ করার নিমিত্তে সেখান থেকে প্রদেয় অর্থে সংস্থাটির কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। কান পেতে রই ১৮ ঘণ্টা হেল্পলাইন সেবা নিয়ে যে যাত্রা শুরু করেছিল, তা করোনাকালে ২৪ ঘণ্টা চালু রাখা হয়েছিলো। কিন্তু বর্তমানে সংস্থাটি ৬ ঘণ্টা হেল্পলাইন সেবা দিচ্ছে।
কান পেতে রই-এর ফেসবুক পেজ ও ওয়েবসাইট থেকে যে-কেউ তাদের হেল্পলাইনের নম্বরসহ সেবার জন্য উল্লিখিত সময় সম্পর্কে সহজেই জানতে পারবেন। সংস্থাটি কিছু সীমাবদ্ধতার জন্য এখনো সরাসরি সেবা চালু করতে পারেনি। আত্মহত্যায় চেষ্টারত ব্যক্তিদের রুখতে এবং দ্রুত উদ্ধারে সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে সংস্থাটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ কার্য অব্যহত রেখেছে।
কান পেতে রই-এর কার্যক্রম বর্তমানে ঢাকাকেন্দ্রিক হলেও সংস্থাটির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে সারা দেশে তাদের সেবা ছড়িয়ে দেওয়া। মানুষের মাঝে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে হতাশাকালীন সময়ে তা মোকাবিলা করার সক্ষমতা তৈরি করা। এবং সেবার মান বৃদ্ধির পাশাপাশি সময় বাড়িয়ে ২৪ ঘণ্টা হেল্পলাইন চালু রাখা।