অসময়ে আম-জাম-জলপাই! ঠান্ডা গরমে সব ফলের শরবত চাহিবামাত্র হাজির
তীব্র গরমে জলপাই বা শীতের দিনে জামের মতো মৌসুমি ফল খাওয়ার ইচ্ছা হলে কী করবেন? এক সময়ে মৌসুম ছাড়া এধরনের ফলের চাহিদা মেটানো কষ্টকরই ছিল। এখন কিন্তু বছরের যেকোনো সময় মৌসুমি ফলের স্বাদ নেয়ার উপায় আছে হাতের নাগালেই। আস্ত ফল না পাওয়া গেলেও সারাবছর জনপ্রিয় সব ফলের জুস পাওয়া যায় জুস কর্নারগুলোতে। ঢাকা শহরে এধরনের প্রাকৃতিক ফলের জুস কর্নারগুলোর মধ্যে শুরুর দিকের দোকান ঠান্ডা গরম জুস গ্যালারি। আনারস থেকে লটকন, বিলিম্বি থেকে ডেওয়া বা বিটরুট-ড্রাগনফলের মতো বৈচিত্র্যময় নানা ফলের জুস সময়ে-অসময়ে পাওয়া যায় এখানে।
"সব জুস সবসময়" স্লোগান নিয়ে কাজ করে ঠান্ডা গরম। প্রায় ৩০ রকমের ফলের জুস আছে এখানে। চেনা অচেনা অসংখ্য ফলের জুসের মধ্যে বাছাই করতে দোটানায় পড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক না। তবে ঠান্ডা গরম জুস গ্যালারিতে আছে বিনামূল্যে জুস টেস্টিং ব্যবস্থা। ছোট্ট টেস্টার গ্লাসে যেকোনো জুস নিয়ে আগেই স্বাদ যাচাই করে নেয়া যায়। এই অভিনব ব্যবস্থা থাকায় কাস্টমাররা আরো বেশি আগ্রহী হয় এখানকার জুস খেতে। গ্লাসের সাইজ আর ফল অনুযায়ী জুসের দাম ৫০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৩৮৫ টাকা পর্যন্ত হয়।
ফলের পাশাপাশি নানা ধরনের হারবাল জুসের ব্যবস্থাও আছে ঠান্ডা গরম জুস গ্যালারিতে। নিমপাতা, সজনেপাতা, পেঁপে পাতা, করলা, কাঁচা হলুদের রস যার মধ্যে অন্যতম। তবে এধরনের জুস একটু কম প্রচলিত হওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে সব ব্রাঞ্চে নিয়মিত পাওয়া যায় না। কাস্টমার আগেরদিন জানিয়ে রাখলেই এই জুসগুলোর ব্যবস্থা করে রাখা হয়।
ঠান্ডা গরম জুস গ্যালারির বেইলি রোড ব্রাঞ্চে জুস খেতে এসেছিলেন ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষার্থী তৃপ্তি। তার কাছে এখানে সবচেয়ে প্রিয় জামের জুস। "অনেক বছর ধরেই ঠান্ডা গরমে জুস খাই আমি। স্কুল শেষে বন্ধুদের সাথে বা মায়ের সাথে শপিং শেষে তৃষ্ণা মেটাতে এদের জুসের জুড়ি নেই। জামের জুসের পাশাপাশি এখানের কাঁচা আমের জুসটাও খুব ভালো। চিনি ছাড়া 'র' জুসটাই আমার বেশি পছন্দ," বলেন তৃপ্তি।
টেস্টারে নিয়ে আম, জাম, জলপাই, তরমুজের জুস টেস্ট করছিলেন জুস খেতে আসা সানজিদা। জলপাইয়ের জুসটা তার সবচেয়ে বেশি পছন্দ হলো। সানজিদা বলছিলেন, "প্রথমবার এখানে এসেছি আমি। শুরুতে টেস্ট করে নেয়ার সিস্টেমটা খুব ভালো লেগেছে। জলপাইয়ের জুস খেতে এখন থেকে নিয়মিত আসব ভাবছি।"
২০০৭ সালে ঠান্ডা গরমের প্রথম আউটলেট খোলা হয়েছিল উত্তরার রাজলক্ষী কমপ্লেক্সে। উত্তরা, গুলশান, বেইলি রোড, খিলগাঁও, বসুন্ধরা, আর ধানমন্ডিতে মোট ৬টি ব্রাঞ্চ আছে ঠান্ডা গরমের। প্রায় সবগুলো ব্রাঞ্চের অবস্থানই ব্যস্ত রাস্তার পাশে অল্প জায়গায়। বসারও জায়গা নেই বেশিরভাগ ব্রাঞ্চে। সামনে দাঁড়িয়ে অর্ডার করে জুস হাতে নিয়ে যাওয়ার নিয়ম। তবুও ১৫ বছর যাবত কীভাবে গ্রাহকদের মন জয় করে চলেছে এই জুস গ্যালারি?
প্রতিষ্ঠাতা রফিকুর রহমানের অদম্য প্রচেষ্টা আর অনন্য পরিকল্পনাই এর বড় শক্তি। বয়স চল্লিশের কোঠা পেরোলে সাধারণ মানুষ যখন জীবনে স্থিত হওয়া শুরু করে সেই সময়ে ঠান্ডা গরমের প্রতিষ্ঠাতা রফিকুর রহমান বেশ বড় একটা ঝুঁকি নিয়ে নেন। অতীতে কয়েকটি বিদেশি ফ্র্যাঞ্চাইজির ফাস্টফুড শপে চাকরির অভিজ্ঞতা ছিল তার। সে অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই ভাবলেন নিজে কিছু করবেন। স্ত্রী আলিমা খাতুন, বড় ভাই জাহিদুর রহমান আর কাজিন আব্দুল মাজেদকে নিয়ে রাজলক্ষ্মীতে ৫ ফুট বাই ৬ ফুটের এক দোকান নিয়ে জুস কর্নার খোলার পরিকল্পনা করেন তিনি।
ব্যবসা করার অভিজ্ঞতা আগেও ছিল রফিকুর রহমানের। তবে খুব সফলভাবে সেগুলো আগায়নি। তাই এই বয়সে এসে এমন একটা কাজ শুরু করা সাহসী পদক্ষেপ ছিল তার জন্য। ভেবেছিলেন জুসের পাশাপাশি চা-কফির ব্যবস্থাও থাকবে দোকানে। তাই জাহিদুর রহমান নাম দিয়েছিলেন ঠান্ডা গরম। কিন্তু পরে আর গরম কোনো কিছুর ব্যবস্থা রাখেননি তারা। রফিকুর আর তার স্ত্রী মিলে নিজের বাসাতেই বানাতেন সব ধরনের জুস।
ঠান্ডা গরমের জুসে শতভাগ প্রাকৃতিক সব উপাদান ব্যবহৃত হয় বলে দাবি করেন রফিকুর। সারাবছর কীভাবে ফল সংরক্ষণ করেন সে বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, "যেকোনো ফলের একদম ভরা মৌসুম যখন থাকে সেসময়ে সবচেয়ে পরিপক্ব আর সবচেয়ে ভালো মানের ফল সংগ্রহ করি আমরা। এরপর সেখান থেকে পাল্প প্রসেসিং করা হয়। ফলের পাল্প সংগ্রহ করে সারাবছরের জন্য মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফ্রিজিং করে রাখতে হয়। এই ব্যবস্থায় পাল্পের মান ঠিক রাখতে আর তাজা ফলের স্বাদ অক্ষুণ্ণ রাখতে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।"
সবসময় ফিল্টারের বিশুদ্ধ পানি দিয়েই বানানো ঠান্ডা গরমের জুস। বর্তমানে উত্তরায় তাদের নিজস্ব কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থা আছে। সব জায়গায় জুসের স্বাদ আর মান ঠিক রাখতে উত্তরা থেকেই সব জুস বানিয়ে পাঠানো হয় ব্রাঞ্চগুলোতে। ব্রাঞ্চেও উন্নত কোল্ড স্টোরিং ব্যবস্থায় সংরক্ষণ করা হয় জুস।
"বসার জায়গার ব্যবস্থা করলে জুসের দাম বাড়াতে হত, তাই সে ব্যবস্থা করিনি আমরা। বিদেশে কিন্তু বেশিরভাগ জুস কর্নারেই এমন 'টেক এওয়ে' সিস্টেম। শুরু থেকে ভেবেছি আমার কনজিউমাররা কী চায়। তাদের ফিডব্যাক অনুযায়ী ঠিক করেছি নিজেদের কাজ। জুস ভালো না মন্দ তা নিয়ে সন্দেহ করতে বিনামূল্যে টেস্ট করার অপশন রাখলাম। জুস টেস্টিং-এর ব্যবস্থাটায় নতুনত্ব ছিল। এটার কারণে মানুষ আরো বেশি আগ্রহী হয়েছে ঠান্ডা গরমের জুস খেতে। আজ একরকম কোয়ালিটির জুস বানালাম আবার কাল আরেকরকম কোয়ালিটির- এমন যেন না হয় তা নিয়ে সতর্ক থাকি সবসময়। নিজে যা খাই তা-ই যেন কাস্টমারদের দিতে পারি সে চেষ্টাই করি," বলছিলেন রফিকুর রহমান।
প্রায় ষাটের কাছাকাছি বয়স এখন রফিকুর রহমানের। হালাল পথে উপার্জন করতে পারাই তার কাছে সবচেয়ে বড় সাফল্য। ফলের জুসে আরো নতুনত্ব আনতে চান তিনি ভবিষ্যতে।