পলাশীর জুসের দোকান: চুমুকে জুড়াবে প্রাণ
চৈত্রের শুরু হতে না হতেই দাবদাহে জনজীবন অতিষ্ঠ হতে শুরু করেছে। রাজধানী ঢাকার বাসিন্দাদের এই গরমের সাথে উপরি পাওনা হিসেবে জুটেছে অসহ্য জ্যাম। কর্মব্যস্ত জীবনে এসব যন্ত্রণায় আপনাদের অনেকেরই হয়তো ওষ্ঠাগত প্রাণ। পিচগলা রোদের তাপে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আপনার এই ক্লান্ত প্রাণকে দুদণ্ড শান্তি দিতে পারে পলাশীর জুসের দোকানগুলো।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক)-এর শিক্ষার্থীদের প্রিয় আড্ডার জায়গা লালবাগের পলাশীর মোড়। নানা ধরনের ফাস্টফুডের দোকানের পাশাপাশি পলাশীর মোড় থেকে আজিমপুরে যাওয়ার রাস্তায় রয়েছে বেশ কয়েকটি জুসের দোকান। দোকানগুলোর প্রাকৃতিক ফলের জুস পুরো ঢাকা শহরে বেশ জনপ্রিয়। আম, জাম, জলপাই, আতার মতো দেশি মৌসুমি ফলের পাশাপাশি ড্রাগন, স্ট্রবেরি ইত্যাদি বিদেশি ফলের জুসও প্রায় সারাবছর পাওয়া যায় এখানে। তবে গ্রীষ্মকালে এখানকার জুসের চাহিদা থাকে তুঙ্গে।
পলাশী মোড়ে বুয়েট মার্কেটের কোনায় শুরুতেই দেখা পাবেন 'দ্য টেস্টি জোন'-এর। অনেক বছর যাবত একই জায়গায় ছিল জমজমাট 'পলাশী জুস কর্নার'। বছরখানেক আগে মালিকানা হাতবদল হয়ে টেস্টি জোনের যাত্রা শুরু হয়। তপ্ত দুপুরে দোকানে গিয়ে দেখা যায় তিনজন কর্মী ব্যস্ত ব্লেন্ডারে জুস বানানোতে। নানা ধরনের জুস হাতে দোকানের ভেতর টুলে বসে আড্ডায় মশগুল তরুণেরা। কর্মী হানিফ জানান, কাস্টমারদের মধ্যে বুয়েট, ঢাবির শিক্ষার্থীরাই বেশি থাকেন। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১১টা-১২টা পর্যন্ত খোলা থাকে দোকান। তবে বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বেশি থাকে ভিড়। জামের জুস তাদের দোকানের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও স্পেশাল জুস।
হানিফ বলেন, 'জুসের জন্য বুয়েট থেকে পানি নিয়ে আসি আমরা। আর বরফের জোগান দেয় আইসক্রিম কোম্পানি। মাঝেমধ্যে নিজেরাও বরফ বানিয়ে নিই। সবসময় কোয়ালিটি মেইনটেইন করেই জুস বানাই।'
আজিমপুরের রাস্তা ধরে সামনে এগিয়ে গেলে দেখা মেলে 'আল-আমিন কাবাব ও জুস কর্নার'-এর। দোকানের ভেতরে অবশ্য 'শরীফ পলাশী জুস কর্নার'-এর পোস্টার দেখা যায়। ছয় মাস আগে মালিকানা বদল হয়ে শরীফ পলাশী জুস কর্নার পরিণত হয়েছে আল-আমিন জুস কর্নারে। আগের মালিকের সময় থেকেই দুই বছর ধরে এখানে জুস বানানোর দায়িত্বে আছেন জুটন দেবনাথ। জুটন জানান, গরমকালে অন্য সব খাবারের চেয়ে জুসের প্রতিই মানুষের আগ্রহ থাকে বেশি। 'সিজনাল ফলের জুসে বেশি গুরুত্ব দেই আমরা। যখন যে ফলের সিজন থাকে সে ফলেরই জুস বানাই। সাধারণত ফ্রিজিং করা ফলের জুস রাখি না আমরা,' বলেন তিনি।
আজিমপুর গভঃ গার্লস স্কুলের শিক্ষার্থী মাইশা জুস খেতে এসেছে মা-বাবার সাথে। সে বলে, 'স্কুল শেষে প্রায়ই এখানে জুস খেতে আসি আমি। পেস্তাবাদামের মিল্কশেক আমার সবচেয়ে পছন্দ।'
এই পথের আরেক জনপ্রিয় জুসের দোকান 'ঢাকাইয়া মজমা'। দোকানের মালিক রামা ঘোষ জানান, তার এখানে সারাবছরই সব ফলেএ জুস রাখার চেষ্টা করেন। মৌসুমি ফলগুলো ফ্রিজিং করে রাখেন, যেন মৌসুম চলে গেলেও জুস বানাতে পারেন। গরম শুরু হওয়ার সাথে সাথে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জুসের চাহিদা থাকে সর্বোচ্চ। শীতকালে জুসের খুব একটা চাহিদা না হলেও গরমের সময়ের লাভ দিয়েই দোকান চালিয়ে নেয়া যায়।
রামা ঘোষ বলেন, 'সবসময় ফ্রেশ জুসটা দেয়ার চেষ্টা করি আমি। যে স্পেশাল মশলাটা জুসে দেই, তার ১০০ গ্রামের দাম ৩০০ টাকা। আবার মিল্কশেকের জন্য ১২০০ টাকা কেজি বাদাম ইউজ করি। এত সব দামি উপাদান দিলেও দামটা সবার হাতের নাগালে রাখার চেষ্টা থাকে।'
পলাশী পেরিয়ে আজিমপুরের দিকে রাস্তায় দেখা মেলে 'শাহী জুস কর্নার এন্ড ঢাকেশ্বরী জুস কর্নার'-এর। এলাকার জুসের দোকানগুলোর মধ্যে এখানেই সবচেয়ে বেশি ভিড় জমে ছিল। স্কুল ইউনিফর্ম পরা বাচ্চা থেকে শুরু করে অফিসগামী মধ্যবয়স্ক লোকসহ সব বয়সী মানুষ দেখা যায় দোকানের সামনে। সময়ের দিক থেকে অন্যান্য সব জুস কর্নার থেকে পুরানো এটি। জুসের দামও এখানে সবচেয়ে কম।
দোকানের ক্যাশে কাজ করছিলেন নরেশ দেবনাথ। তার ছেলে মোহন দেবনাথ প্রায় ২৬ বছর আগে জিগাতলা কাঁচাবাজারে শুরু করেছিলেন এই দোকান। সময়ের সাথে স্থান পরিবর্তন করে এই জায়গায় থিতু হয়েছেন তারা। নরেশ দেবনাথ বলেন, 'আমরা যে দামে ফল সংগ্রহ করি সেই দামে আর কেউ সংগ্রহ করতে পারে না। তাই জুসের দামটাও এখানে কম রাখতে পারি। আমাদের পেস্তা বাদামের জুসটা সবচেয়ে জনপ্রিয়।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য প্রযুক্তি ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী ফাহমিদ আহমেদ বলেন, 'বকসীবাজার বোর্ড অফিসের পাশেই আমার বাসা। বাইরে খেতে বের হলেই এলাকার জুসের দোকানগুলোতে যাওয়া হয়। জুসের জন্য শাহী জুস কর্নার ও ঢাকেশ্বরী জুস কর্নার বেস্ট। টিউশন থেকে ফেরার পথে প্রায় প্রতি রাতেই তরমুজের জুস খাই। আবার কাবাব বা কাচ্চি বিরিয়ানি-জাতীয় ভারী খাবার যেদিন খাই সেদিন জিরা পানি খাওয়াটা মাস্ট।'
এই দোকানগুলো ছাড়াও ঢাকেশ্বরী রোডে আছে 'ড্রীম জুস কর্নার' নামের আরেক দোকান। সবগুলো জুস কর্নারেই জলপাই, জাম, পাকা আম, কাঁচা আম, আনারস, কমলা, মাল্টা, ড্রাগন ফ্রুট, বেদানা, আতা, তরমুজ, আপেল ইত্যাদি ফলের জুসের পাশাপাশি পাওয়া যায় নানা ধরনের মিল্কশেক। জিরাপানি ও লেমন মিন্টও বেশ জনপ্রিয় এখানে।
ঢাকার নানা প্রান্ত থেকে পলাশী এলাকায় জুস খেতে আসেন মানুষজন। প্রতি গ্লাস জুসের দাম সর্বনিম্ন ২৫ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। জুস কর্নারগুলোর জন্য দুই-একদিন পরপর বাদামতলী, কারওয়ানবাজার, বেলতলী, মৌলভীবাজারের মতো দূরদূরান্ত থেকে তাজা ফল সংগ্রহ করা হয়।
মৌসুম অনুযায়ী একেক দোকানে রোজ ৫ হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকার জুসের কেনা-বেচা হয়। সবগুলো জুস কর্নারই মোটামুটি সকাল ১০টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। কাস্টমাররা দোকানে বসে খাওয়ার পাশাপাশি পার্সেল হিসেবে বাসায়ও নিয়ে যেতে পারেন এখানকার জুস।