বুকটক কী? কিভাবে এটি টিনেজারদের বই পড়ার অভ্যাসকে প্রভাবিত করছে?
বর্তমানে টিনেজারদের কাছে তুমুল জনপ্রিয় একটি অ্যাপের নাম টিকটক। গানবাজনা-নাচের পাশাপাশি এবার টিনেজারদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছে টিকটকের 'হ্যাশট্যাগ বুকটক' (#booktok)। হ্যাশট্যাগের বুকটকের আওতায় বইয়ের ছবির সাথে মিল রেখে ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপ, ছবিকে টিকটকের জনপ্রিয় সাউন্ডট্র্যাকের সাথে সংযুক্ত করা হয়। সাধারণত এসব ভিডিও এক মিনিটেরও কম দীর্ঘ হয়। যারা এই হ্যাশট্যাগের অধীনে কাজ করছেন, তাদের একটি নতুন নামও ঠিক হয়ে গেছে- 'বুকটকার।'
উদাহরণস্বরূপ, জনপ্রিয় অস্ট্রেলিয়ান বুকটকার @londonapples এর ১০ সেকেন্ডের ভিডিও 'ওয়াইএ হুপস'-এ দেখা যায়, বই পড়ার সময় তাকে বিরক্ত করায় একটু লজ্জিত ভঙ্গিতে অবাক হয়েছেন তিনি।
টিকটক এবং বুকটক কী?
২০২২ সালে এসে টিকটকের পরিচয় হয়তো নতুন করে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তরুণদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় এই অ্যাপ।
২০২০ সালে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী অস্ট্রেলিয়ান টিনেজারদের মধ্যে ৩৮ শতাংশ টিনেজার টিকটকে সময় পার করেছে। গত বছর তাদের টিকটকে সময় দেওয়ার মাত্রা ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, অর্থাৎ তারা মাসে ২৩.৪ ঘন্টা করে সময়ে টিকটকের পেছনে দেন।
এবার আসা যাক বুকটকের প্রসঙ্গে। বুকটক মূলত একটি বইপাগল গোষ্ঠী, যারা টিকটকে নিজেদের বইপ্রেম ও পড়ার অভ্যাসকে তুলে ধরেন। এই মুহূর্তে সারা বিশ্বে হ্যাশট্যাগ বুকটক-এর ৪৬ বিলিয়ন ভিউ রয়েছে!
বুকটক ভিডিও কারা দেখেন এবং কারা বানান?
দ্য কনভারসেশন-এর টিন রিডিং সার্ভে থেকে জানা গেছে কীভাবে অস্ট্রেলিয়ান টিনেজাররা বই-সম্পর্কিত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করছে এবং এই ব্যবহারকারীরা আসলে কারা।
প্রাথমিক জরিপে দেখা গেছে, অর্ধেকেরও বেশি অস্ট্রেলিয়ান টিনেজার টিকটকে যুক্ত আছেন, তবে এদের মধ্যে অল্প সংখ্যক ব্যবহারকারীই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে 'বুক টক' এর জড়িত। এর মধ্যে হ্যাশট্যাগ বুকটকের আওতায় আছে ১৬ শতাংশ ব্যবহারকারী।
এর মানে দাঁড়ায়, শুধুমাত্র বই যাদের কাছে নেশার মতো, সেরকম একটি ক্ষুদ্র টিনেজার গোষ্ঠীই বুকটকে যুক্ত আছেন। কিন্তু সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও ইতোমধ্যেই বেশ প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছেন বুকটকাররা। তারা টিনেজারদের বই পড়তে উৎসাহিত করছেন এবং নিজেরা কী পড়ছেন তা জানাচ্ছেন।
অনেক বই বিক্রেতাই জানিয়েছেন, বুকটকের প্রভাবে এসে টিনেজাররা এখন আগের চেয়ে বেশি বই কিনছেন।
উৎসাহী বুকটকার মিরেইলি লি বুকটককে ব্যখ্যা করলেন এভাবে- "বুকটকের সাথে পরিচিত হওয়ার পরেই আমি ৬ বছর পর আবার বই পড়া শুরু করলাম।"
মহামারির আগে টিনেজারদের বই পড়ার হার হ্রাস পেলেও, মহামারিকালে যুক্তরাজ্যের টিনেজারদের মধ্যে বই পড়ার হার আবার বেড়ে যায়। অনেক বই বিক্রেতাই এখন দোকানে হ্যাশট্যাগ বুকটক টেবিল রেখে দিচ্ছেন অথবা 'ট্রেন্ডিং অন বুকটক' তালিকা প্রদর্শন করেন কিংবা হ্যাশট্যাগ বুকটক সেট রেখে দেন।
বুকটকের ৫ জাদু!
যে বুকটক নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে, এটি আসলে কিভাবে কাজ করে? আমরা বুকটকের ৫টি উপাদান খুঁজে বের করেছি যে কিভাবে এটি তরুণদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলছে।
১. মজার ও সৃজনশীল
প্রথমত, টিকটক একটি মজার মাধ্যম। এখানে আপনি চাইলেই গানের সাথে ছবি সংযুক্ত করতে, কোনোকিছু পুনরায় ব্যবহার করতে, নকল করতে বা অনুকরণ করতে পারবেন। আর সেটা বেশ সৃজনশীল উপায়ে করার সুযোগও রয়েছে এখানে।
যেমন, একটা 'স্টিচ' পোস্টে ব্যবহারকারী নিজের মতো করে অন্য পোস্ট যোগ- অনুকরণ করতে, সমালোচনা বা ব্যঙ্গ করতে পারবেন।
আবার 'ডুয়েট' পোস্টে অন্য পোস্ট যুক্ত করা যাবে কিন্তু সেটি আলাদাভাবেই বাজতে থাকবে।
২. অ্যালগরিদমের কারণে অপ্রত্যাশিত পোস্টের সুপারিশ
অন্যান্য অ্যাপে আপনি যাদের ফলো করবেন, তাদের কাছ থেকে কনটেন্টের সুপারিশ আসতে থাকবে। কিন্তু টিকটকের অ্যালগরিদম ভিন্ন, এখানে কোনো পোস্টের ভিউ, লাইক ও সাড়াদানের উপর ভিত্তি করে পোস্টের সুপারিশ আসে। ফলে টিকটক ব্যবহারকারীরা প্রচুর পোস্ট থেকে নিজের রুচি অনুযায়ী পোস্টটি দেখতে পারেন।
৩. পোস্ট জনপ্রিয়, পোস্টকারী নন
টিকটকে আলাদা আলাদা পোস্টের জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে পোস্টটি খ্যাতি পায়, এর স্রষ্টা নন। অস্ট্রেলিয়ান বুকটকার @hibas.library সাধারণত কয়েক হাজার ভিউ পান তার পোস্টে। কিন্তু 'প্রাণীদের প্রস্রাব-সংক্রান্ত সবচেয়ে বড় বই' শিরোনামের পোস্টটি পেয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার ভিউ। অন্যদিকে, বুকটকার @kelibrary এর একাউন্টের বয়স মাত্র দুই সপ্তাহের কম হলেও তার বইয়ের পোস্ট ৩ লাখ ৯৩ হাজার ভিউ পেয়েছে!
৪. বইপ্রেমীদের নেটওয়ার্ক
বুকটকের প্রধান আকর্ষণই হলো, বিশ্বের সব বইপ্রেমীদের একত্রে যুক্ত করা। বুকটকার @kelibrary বলেন, "আমি আমার বুক একাউন্ট তৈরি করেছি কারণ আমি সমমনা মানুষের সাথে যুক্ত হতে চাচ্ছিলাম।"
এর ফলে বই এবং বিভিন্ন দেশের বইয়ের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারেন এবং তথ্য শেয়ার করতে পারেন বুকটকাররা।
৫. আবেগই প্রধান
টিকটকের মূল উপাদান হচ্ছে আবেগ এবং এখানে প্রচুর ভিডিও আসে যা সব মিলিয়ে এটিকে একটি ভালোবাসার মাধ্যমে পরিণত করে তরুণদের কাছে।
বইয়ের ক্ষেত্রেও একই বিষয় কাজ করে, কারণ বইপ্রেমীদের কাছে বই তাদের ভালোবাসা। প্রায়ই বুকটক ভিডিওতে দেখা যায়, পাঠকেরা কাঁদছেন, তাদের আবেগ প্রকাশ করছেন।
বুকটক কিভাবে বই পড়ার অভ্যাসকে প্রভাবিত করছে?
অবাক করা বিষয় হলো, বুকটকাররা বেশ কয়েক বছর আগে প্রকাশিত বইগুলোও সামনে নিয়ে আসছেন। ফলে সেসব বই নতুন করে চাহিদা ও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
এসব বইয়ের মধ্যে আছে ইট এন্ডস উইথ আস (কলিন হুভার, ২০১৬), দে বোথ ডাই অ্যাট দ্য এন্ড ( অ্যাডাম সিলভেরা, ২০১৭), দ্য সেভেন হাজবেন্ডস অব ইভলিন হুগো (টেইলর জেংকিনস রাইড, ২০১৭) ইত্যাদি।
তবে মাঝেমাঝে শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গ লেখকদের বই তুলে ধরার কারণে সমালোচিত হয় বুকটক। যদিও বুকটকের ট্রেন্ডিং বইয়ের মধ্যে বৈচিত্র্যতা খুঁজছে তরুণরা।
এমনকি বই বিক্রেতারাও এখন বুকটক সম্পর্কে পারদর্শী হয়ে উঠছেন। তারা ক্রেতার সাথে আলাপ শুরু করছেন এটি দিয়ে এবং ট্রেন্ডিং বই সুপারিশ করছেন।
বুকটক টিনেজারদের জন্য একটি 'ডিজিটাল স্পেস' তৈরি করে দিচ্ছে, যেখানে তারা বন্ধুত্বপূর্ণ ও তরুণদের জন্য উপযোগী পরিবেশে নিজেদের মতামত-অনুভূতি শেয়ার করতে পারবে। সেই সাথে তারা বর্তমান প্রজন্মকে বই পড়ায় উৎসাহিত করবে।
সূত্র: দ্য কনভারসেশন