দেশবন্ধু সুইটমিট: ৬৪ বছর ধরে ঢাকাবাসীর সকাল-বিকালের নাস্তার প্রিয় জায়গা
"বাবা, মামা, ভাইয়ের কোলে-কাঁখে কইরা আসতাম এখানে। আমার বয়স হয়তো দুই-তিন বছর ছিল, দেশবন্ধু চিনছি তখন। সেই আদি আমল থেইকাই চলছে দেশবন্ধু। এখানে যারা কাজ করেন এরাও ছোটবেলা থেইকাই চিনে আমারে। ৩৮ বছর ধইরা আমি এই এলাকাতে আছি। দেশবন্ধু সারা ঢাকার ঐতিহ্য," কথাগুলো একটানে বলে যাচ্ছিলেন আহসান উল্লাহ বেপারী। সকালের নাস্তা নিয়ে যেতে দেশবন্ধু সুইটমিট এন্ড রেস্টুরেন্টে এসেছিলেন তিনি। দোকানের কর্মীদের সাথে তার কথা-বার্তা দেখে মনে হয়েছিল সম্পর্কটা বেশ পুরোনো। কথা বলতে এগিয়ে গেলেই খুলে বসলেন স্মৃতির ঝুড়ি।
"১২টা পরোটা দেও আর ৬টা ভাজি দেও, পার্সেল," গল্পের মাঝেই অর্ডার দিয়ে রাখলেন। "গোনার মতো খুব বেশি আইটেম নাই এদের। এই পরোটা-ভাজিই সারাদিন চলে। তবু বেইচা কুলাইতে পারে না। দিনে-রাইতে সবসময় খাই এখানে। মাঝেমধ্যে এমনও হয় যে বন্ধু-বান্ধবের আড্ডায় বসছি, মুরগি-গরুর মাংস ভুনা দিয়ে খাইতেছি, তাও হুট কইরা মনে হইলো দেশবন্ধু থেইকা পরোটা-ভাজি নিয়া আসি। দেশবন্ধু আমার পরিবারের মতো হইয়া গেছে। নামটাই একটা ব্র্যান্ড হইয়া উঠছে," বলেন আহসান উল্লাহ।
শুরুর গল্প
হাটখোলা রোডে ইত্তেফাকের মোড়ে অবস্থিত দেশবন্ধু সুইটমিট এন্ড রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৮ সালে। প্রতিষ্ঠাতা শচীমোহন গোপ আগে রাস্তার মোড়ে বিক্রি করতেন দই-মাঠা। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন ঘোষের ভক্ত ছিলেন শচীমোহন। তার পরিবারের ধারণা, দেশবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা থেকেই নিজের দোকানের নাম রেখেছিলেন দেশবন্ধু সুইটমিট।
মূলত মিষ্টির দোকান হলেও এখানকার পরোটা-ভাজির নাস্তার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল শহর জুড়ে। নাস্তা করতে করতে হোটেলের টেবিলে বসে আড্ডায় মেতে উঠতেন সে সময়ের বিখ্যাত লেখক, সাংবাদিক, শিল্পীরা।
৬৪ বছর আগের সেই সময়ে দেশবন্ধুর উল্টো দিকেই টিনের অফিসঘর ছিল ইত্তেফাকের। ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মানিক মিয়াসহ অন্যান্য সাংবাদিকরা নিয়মিত আসতেন দেশবন্ধুতে। ওই সময় ঢাকার সাংবাদিকদের আড্ডার মূল জায়গা ছিল এই হোটেল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলতো তাদের আড্ডা। তখন দেশবন্ধু ছাড়া ভালো হোটেল তেমন ছিল না আশেপাশে।
চার দশকের বেশি সময় ধরে দেশবন্ধুতে কাজ করেন বাবুল দেবনাথ। বাবুল বলছিলেন, "শুনছি ছাত্রজীবনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও খাইতে আসতেন এইখানে। বিএনপির সাদেক হোসেন খোকা তো এই হোটেলে খাইয়াই বড় হইছেন। তারেক জিয়া, এরশাদরাও আসত। নায়িকা কবরীও আমাদের পরোটা-ভাজি খুব পছন্দ করতেন। শাবানা, আলমগীর, রাজ্জাক, প্রবীর মিত্ররাও দেশবন্ধুর খাবার খাইতেন। সিনেমার শ্যুটিংয়ের নাস্তায় রেগুলার যাইতো এই পরোটা-ভাজি। আগে প্রায়ই টেবিলে জায়গা না হইলে সিঁড়িতে বইসাও খাইতো মানুষ।"
হোটেলের বর্তমান ম্যানেজার রবি সরকার। তিনিও এখানে কাজ করেন প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে। রবি জানান, এখান থেকে সাধারণত চাকরি ছেড়ে যায় না কেউ। শুরু থেকে যারা কাজ করতেন তাদের অনেক মারা গেছেন। সবচেয়ে প্রবীণ কর্মীদের তিনজনই চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দোকানের অবস্থা জানতে চাইলে রবি বলেন, "যুদ্ধের সময় দেশবন্ধুর ক্ষয়-ক্ষতি খুব বেশি হয় নাই শুনছি। আসলে তখন খাওয়ার দোকান তো খুব একটা ছিল না এলাকায়। মানুষ খাবারই পাইতো না। মিলিটারিরা এইখানে খাইতে আইত, খাবার শেষে বেশিরভাগ সময় বিল না দিয়া চইলা যাইত, দোকানের স্টাফদের সাথে খারাপ ব্যবহার করত। তাও দোকান লুট করে নাই তারা। তবে দেশ স্বাধীনের পরে ইন্ডিয়ার বাবরী মসজিদে হামলার সময় দোকানে অনেক ভাংচুর করছিল মানুষ।"
সেই ঘটনার বিস্তারিত জানতে চাইলে রবি সরকার বলেন, "১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে ইন্ডিয়ায় বাবরী মসজিদে হামলা যেদিন হইলো তার পরেরদিন রাস্তার সামনে দিয়া একটা মিছিল আসলো। আইয়াই দোকানে হামলা দিলো। আমরা মিছিল দেইখাই শাটার ফালায়ে ভেতরে লুকায়ে ছিলাম। মিছিলের মানুষজন শাটার ভাইঙ্গা মিষ্টির বোল-টোল নিয়া, ফ্রিজ নিয়া সব পুড়াইয়া ফেলছে রাস্তায়। হিন্দু মালিকের দোকান দেইখা এইটাতেই হামলা হইছিলো। সেই লুটপাটের ক্ষয়ক্ষতি সামলায়ে আবার দোকান খুলতে একমাস সময় লাগছিল মালিকের।"
কেমন আছে এখনের দেশবন্ধু
প্রয়াত মালিক শচীমোহন গোপের ছেলে শ্যামল চন্দ্র গোপই বর্তমানে দেখাশোনা করেন হোটেলটির। সেই শুরুর দিকের জমজমাট অবস্থা আর না থাকলেও পুরোনো ঐতিহ্য এখনো বয়ে চলছে দেশবন্ধু সুইটমিট এন্ড রেস্টুরেন্ট। পুরোনো আমলের সাজসজ্জায় সাধারণ চেহারার হোটেলটি। শুরুতে মিষ্টির শোকেস, ভেতরে বসে খাওয়ার জন্য পরিচ্ছন্ন ৬টি টেবিল পাতা। কর্মীদের সহজ ব্যবহার এখনও হোটেলের কাস্টমারদের জানায় উষ্ণ অভ্যর্থনা।
সকাল থেকেই দেখা যায় সারাক্ষণ কাস্টমাররা আসছেন, বসে আড্ডা দিচ্ছেন বা বাসার জন্য পার্সেল নিয়ে যাচ্ছেন। মধ্যবয়সী পুরোনো কাস্টমারদের আনাগোনাই বেশি। দেশবন্ধুর পরোটা-ভাজি ছাড়া তাদের কারো কারো দিনই শুরু হয় না!
১৯৯৬ সাল থেকে দেশবন্ধুতে নিয়মিত নাস্তা করেন সানাউল হক খান। থাকেন মাদারটেকে, ঠিকাদারোর কাজে প্রায়ই তাকে যেতে হয় মুন্সিগঞ্জে। তিনি বলেন, "কাজের জন্য আমার বাসা থেকে সহজ রাস্তায় ফ্লাইওভার দিয়ে যাতায়াত করা যায়। কিন্তু শুধু দেশবন্ধুতে নাস্তা করার জন্য আমি এদিক দিয়ে ঘুরে আসি প্রায়ই। দেশবন্ধুর নাস্তার প্রতি কতটা টান থাকলে এই জ্যামের রাস্তা পার হয়ে এদিক দিয়ে যাই চিন্তা করেন!"
বর্তমানে দেশবন্ধু হোটেলে সকালের নাস্তায় আছে লুচি, পরোটা, ভাজি, হালুয়া আর নানা ধরনের মিষ্টি। ৪৫ থেকে ৭০ টাকার মধ্যেই ভাজি-হালুয়াসহ নাস্তা সেরে ফেলা যায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সম্প্রতি কিছুটা দাম বেড়েছে সবকিছুর। মিষ্টির মধ্যে রাজভোগ, ছানার আমিত্তি আর কালোজাম কাস্টমারদের বেশি পছন্দ। মিষ্টির দাম প্রতি পিস ১৫ টাকা থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত।
দুপুরের ভাত-মাছও পাওয়া যায় দেশবন্ধুতে। রুই মাছ, মুরগির মাংস, খাসির মাংস, ডাল, ডিম, ভাত আর খিচুড়ি থাকে রোজকার তালিকায়। সাথে পরোটা-ভাজি পাওয়া যায় সারাদিনই। সকাল, দুপুর আর বিকালে তিনবার রান্না হয় আলু, পটল, বেগুন আর মিষ্টিকুমড়ার বিখ্যাত সেই ভাজি। মূল রান্না হয় হাটখোলায় বড় রান্নাঘরে। রাজধানী সুপার মার্কেটের পাশে দেশবন্ধুর আরেকটা শাখাও আছে। সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্তই পাওয়া যায় খাবার। পার্সেল হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা নেই এখানে।
বর্তমানে দেশবন্ধু সুইটমিটের অবস্থা নিয়ে জিজ্ঞেস করলে বাবুল দেবনাথ স্মিত হেসে বলেন "আগের মতো নামকরা মানুষের আনাগোনা এখন আর হয় না সত্যি। তবে আশেপাশের মানুষের কাছে দেশবন্ধুর নামটাই আলাদা। প্রায়ই দূরদূরান্ত থেইকা মানুষ আসে পরোটা ভাজি পার্সেল নিয়া যাইতে। তাদের বয়স্ক মা-বাবার আবদার রাখতে। অনেকেই বিদেশ থেইকা খোঁজ নেয় দেশবন্ধু এখনো আছে কি না। দেশে আসলেই তারা এখানে নাস্তা খাইতে আসবে জানায়।"
ষাটের দশক থেকে শুরু করে পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ঢাকা শহরে দেশবন্ধু সুইটমিট এন্ড রেস্টুরেন্টের জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। দেশ বরেণ্য নানা ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি অনেক সাধারণ মানুষের আবেগের সাথে জড়িয়ে আছে নামটি।