যে রেস্তোরাঁয় খেতে যেতেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, নাম দিয়েছেন কায়েস আহমেদ
'কিছুক্ষণ আরো না হয় রহিতে কাছে,
আরো কিছু কথা না হয় বলিতে মোরে'
ফেসবুকে রেস্তোরাঁর নামটা দেখে সন্ধ্যা মুখার্জির এই গানটির কথাই বারবার মাথায় ঘুরছিল। অনেকরকম রেস্তোরাঁর নাম তো শুনেছি, কিন্তু এমন নান্দনিক নাম আগে কখনো শুনিনি। তা-ই বলা যায়, একপ্রকার নামের মোহে পড়েই সেদিন অপরাহ্নে পা রাখি 'কিছুক্ষণ রেস্তোরাঁ'য়।
পুরনো ঢাকার গেন্ডারিয়ার সতীশ সরকার রোডের লেন ধরে আসলে একদম নাক বরাবর পড়বে সবুজ প্রকোষ্ঠের একটি ঘর, উপরে বড় সাইনবোর্ডে লালরঙে লেখা 'কিছুক্ষণ রেস্তোরাঁ'। যদিও সাইনবোর্ডে ঠিকানা লেখা 'কেশব ব্যানার্জী লেন', তবে অনেকেই এই নামটির সঙ্গে তেমন পরিচিত নয়। তবে 'কিছুক্ষণ রেস্তোরাঁ' বললে একনামেই চেনে লোকে।
রাস্তা পার হয়ে দোকানে ঢুকবো। কিন্তু দুই পাশ থেকে ক্রমাগত রিকশা, মানুষ, গাড়ি, ট্রাকের আসা-যাওয়ার কারণে, রাস্তা পার হতে গেলে একটু বেগ পেতে হয়। যাহোক, দোকানে পা বাড়াতেই ভালো লাগা, খারাপ লাগা যেন একসঙ্গে আমায় জেঁকে বসলো। ছবিতে বা ফেসবুকে দেখে প্রথমে ভেবেছিলাম, দোকানটি বেশ বড় জায়গা জুড়ে হবে। অন্তত ২০-৩০ জন বসতে পারবে একসঙ্গে। কিন্তু এখানে আছে মোট ১৫-১৬ জনের বসার জায়গা। দোকানে মোট তিনটে টেবিল। চারজন একসঙ্গে বসতে পারবে এমন দুটো চেয়ার-টেবিলের ব্যবস্থা। আরেকটা লম্বা টেবিল, মুখোমুখি মোট আটজনের মতো হয়তো বসতে পারবে। দোকানের যে জনপ্রিয়তা তাতে এটুকুন বসার জায়গা দিয়ে কীভাবে জায়গার সংকুলান হয় সেটা একটা প্রশ্নই বটে!
তবে এই প্রশ্নের উত্তর পেলাম, যখন ক্যাশিয়ার আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, 'পার্সেল নেবেন?' বুঝলাম, বেশিরভাগই পার্সেল নিয়ে যায়। আর কাস্টমার 'মেয়ে' হলে তো পার্সেলই হয় বেশি।
যা-হোক, গিয়ে দুটো আলাদা টেবিলের একটায় গিয়ে বসলাম। বসার জায়গাটা তেমন মনমতো হয়নি। যেহেতু মোটে তিনটে টেবিলই আছে, তাই একটিতে বসলে একদম রান্নাঘরের কাছাকছি বসতে হয়, আর অপরটিতে বসলে, একদম গেটের সামনে!
তবে দোকানটি ছোটর মধ্যেও বেশ পরিপাটি, পরিষ্কার এবং ছিমছাম। 'কাস্টমার কেয়ার'ও ভালোই। টেবিলে বসার সঙ্গে সঙ্গেই টেবিল সাজিয়ে দিয়ে, কী খেতে চাই তা জানতে এলো। স্যুপ মানেই কিছুক্ষণ রেস্তোরাঁ- একথা যেহেতু শুনে এসেছি তাই কোনো ভাবনাচিন্তা না করেই বলে দিলেম, 'স্যুপ দিবেন একটা।'
উত্তম কুমার তাকিয়ে হাসছেন!
দোকানে ঢুকেই দেখি, উত্তম কুমার তাকিয়ে হাসছেন, পাশেই কাজী নজরুলের নীরব চাহনি। একটু ডানেই যেন রবিঠাকুর আড়দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। ডানে ঘুরলেই সত্যজিৎকে দেখা যাবে সবসময়ের মতো ভাবুক আর গালে হাত দেয়া অবস্থায়।
যেভাবে সারি সারি এই শিল্পীদের ছবি টাঙ্গানো তাতে, কাস্টমার শুধু খাওয়ার জন্য নয়, কালক্ষেপণ করতেও এই জায়গাটিকে বেছে নেবেন।
রেস্তোরাঁর বর্তমান কর্ণধার স্বপন চন্দ্র ঘোষ জানান, তার বাবা নারায়ণ চন্দ্র ঘোষ ছিলেন একজন শিল্পানুরাগী ব্যক্তি। ভালোবাসতেন কবিতা পড়তে, সাহিত্যচর্চা করতে, গান শুনতে আর সিনেমা দেখতে। বাবার স্মরণে তাই ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ থেকে সুকান্ত ভট্টাচার্য্য, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হাসন রাজা, জয়নুল আবেদীন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, লালন শাহ্, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাদার তেরেসা, স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর মতো সব উজ্জ্বল নক্ষত্রদের ছবি রেস্তোরাঁর তিন দেয়াল জুড়ে টাঙ্গানো রয়েছে।
এক টেবিলে বাবা-মায়ের সঙ্গে বসে আছে সাত বছরের ছোট্ট খুকি। দেয়ালে ঝোলানো এসব বিখ্যাত মানুষের ছবি দেখে আঙ্গুল দেখিয়ে বাবা-মাকে বারবার জিজ্ঞেস করছে, 'এটা কে, ঐ লোকটা কে?' বাবা-মাও ক্লান্তহীনভাবে মেয়ের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন এক এক করে। কথা বলে জানলাম, মিরপুর থেকে স্ত্রী, সন্তানকে নিয়ে খেতে এসেছেন শরীফুল ইসলাম। সারাদিন এখানকার লালকুঠি- রূপলাল হাউজে ঘোরার পর সন্ধ্যার নাস্তা করতে এখানে এসেছেন শরীফুল। জানতে চাইলাম, এত জায়গা থাকতে কেন এখানেই এলেন? শরীফের স্ত্রী শাহনাজ বলে উঠলেন, 'এখানকার খাবারের ডাক-নাম শুনেছি অনেক, তাই আজ এখানেই খেতে এলাম। সবগুলো খাবারই ভালো লেগেছে। তবে এখানকার স্যুপটা বেশি ভালো লাগলো, তাই বাসার জন্যও দুই বাটি নিয়ে নিলাম।'
কিছুক্ষণ পর একজন ৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধা এসে বসলেন আমার সামনের চেয়ারে। মুখে মাস্ক, মোগলাই পরোটার অর্ডার দিয়ে চুপচাপ বসে চারপাশটা দেখছেন। প্রবীন এই ব্যক্তির নাম শেখ কামাল মাহমুদ। বাংলাদের কৃষি ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। এখানকার খাবার ভালো হওয়ায় বিকেলের নাস্তা তা প্রায়ই এখান থেকে কেনেন তিনি।
'এখানকার স্যুপ অন্যদের চেয়ে আলাদা'
পুরান ঢাকার বিখ্যাত চা-কাটলেটের দোকান মানেই সেখানে কবি-সাহিত্যিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের আড্ডা বসতো, এমন চিন্তা আর দেয়াল জুড়ে টাঙ্গানো সব বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের ছবি দেখে খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল এরা কেউ কখনো এসেছেন কি-না এখানে। হয়তো নবীনের মনের প্রশ্ন প্রবীণ বুঝতে পেরেছিলেন।
শেখ কামাল মাহমুদ জানান, 'এসব দেখে ভাববেন না এরা এখানে আসতেন। আসলে এগুলো সবই কাস্টমারদের আকৃষ্ট করার কৌশল।'
কামাল চাচার সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্বপন চন্দ্রও জানান, 'এরা এখানে কেউ কখনো আসেনি, তবে আমার বাবার বন্ধু ছিলেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ছোট গল্পকার কায়েস আহমেদ, সংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর। তারা এখানে নিয়মিত আসতেন।'
দোকানটি খোলা থাকে সকাল ৭টা থেকে ১১টা এবং বিকেলে খোলে ৫টা থেকে ১০টা। সকালে পাওয়া যায় ডাল-সবজি পরোটা। আর বিকেলে থাকে স্যুপ, কাটলেট, চিকেন ফ্রাই, মোগলাই পরোটা। তবে জমজমাট হতে থাকে বিকেলের পর থেকে। ঘড়ির কাঁটা যত গড়ায়, ধীরে ধীরে ভিড়ও বাড়তে থাকে।
একে তো দোকান ছোটো, তার ওপর এত কাস্টমার। তাই সন্ধ্যার পর জায়গা পাওয়াই মুশকিল। তাই কেউ যদি আরাম করে বসে খেতে চায়, উপদেশ থাকবে পাঁচটার পরপরই খেতে চলে আসার।
কেউবা পরিবারসমেত আসে। কেউ আসে একাই, পছন্দের খাবারটি খেয়ে আবার চলে যায়, যেন নিজের অতি পরিচিত এক জায়গা। কেউ আবার আসে দলবেঁধে বন্ধুবান্ধব সহযোগে।
স্যুপ চলে আসার পর টেবিলে বসে খাচ্ছিলাম। পরিচিত হয়ে নিলাম সামনে বসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী তানভীরের সঙ্গে। আমাকে স্যুপ খেতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, 'এখানকার স্যুপ অন্যদের চেয়ে আলাদা, তাই না? আমার খুব পছন্দ ওদের স্যুপ।'
মর্মান্তিক স্মৃতি…
এই রেস্তোরাঁর গোড়াপত্তন হয় ১৯৭৯ সালে ঠিক এই জায়গাতেই। আর ঠিক এই জায়গাতেই দোকানের সামনে রাস্তায় ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যুবরণ করেন দোকানের প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ চন্দ্র ঘোষ। জানালা দিয়ে বাইরের ট্রাকগুলোর দিকে তাকিয়ে পিতার মৃত্যুর কথাগুলো বলছিলেন স্বপন চন্দ্র ঘোষ। হয়তো সেদিনও এমনি একটি দিন ছিল! নারায়ণবাবু দোকানের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। একটি ট্রাক এসে তাকে চাপা দেয়। নারায়ণবাবু মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে নাকি ঐ ড্রাইভারের দু'বছর জেল হয়।
বরিশালের ব্রজমোহন স্কুল (তখনও কলেজ হয়নি) থেকে পড়াশোনা করেছেন নারায়ণ চন্দ্র ঘোষ। দাদা-চাচাদের ট্রাংকের (টিনের বাক্স) ব্যবসা ছিল বরিশালে। তাদের পূর্বপুরুষের কিছু অংশ আছে বরিশালে, কিছু আছে আসামে। ম্যাট্রিকের পর আর লেখাপড়া এগোতে পারেননি নারায়ণ চন্দ্র ঘোষ।
তবে শিল্প-সাহিত্যের প্রতি অবাধ ভালোবাসা ছিল তার। ফরাশগঞ্জের লালকুঠিতে থিয়েটার করতেন, সমান পদচারণা ছিল খেলাধুলার জগতেও। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল আসতেন এখানে।
১৯৭৯ সালে প্রথম বাবুর্চি ছিলেন বিমল ডি'কস্তা
দশ বছরের মতো কাজ করেন তিনি এখানে। তার মৃত্যুর পর থেকে ৩০ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছেন মোহাম্মদ শহীদ। তবে, বিমল ডি'কস্তার সেই রেসিপিই এখনো অব্যাহত আছে।
স্যুপ, কাটলেট তো আছেই, সঙ্গে নিলাম চিকেন ফ্রাই আর আলুর চপ। মোগলাই পরোটা কিনতে নাকি আগ থেকে অর্ডার দিয়ে রাখতে হয়। স্যুপ ছোটবাটি ৬০ টাকা, কাটলেট ২০ টাকা, চপ ১০ টাকা, চিকেন ফ্রাই ৬০ টাকা আর মোগলাই পরোটা ৬০ টাকা।
স্বাদের বিচারে দাঁড় করাতে গেলে আমি প্রথমেই স্থান দিবো স্যুপকে। স্যুপের পরিবেশনও বেশ সুন্দর। ওপরে ছিটানো থাকে মুরগির মাংসের ঝুড়ি, সেই সাথে আছে, চাইনিজ রেস্টুরেন্টের মতো ভিনেগার-মরিচ পানি আর বিট লবণের ব্যবস্থা। তবে স্যুপটা একটু ঘন।
কাটলেটের আগে বলবো চিকেন ফ্রাইয়ের কথা। মুচমুচে নরম, বিস্কুটের গুঁড়োয় ভেজে নেওয়া চিকেন ফ্রাই ছোট থেকে বড় সকলেরই মন কাড়তে বাধ্য।
এরপর আসি কাটলেটে। পুরান ঢাকায় অনেক বিখ্যাত দোকানেই সুস্বাদু কাটলেট বিক্রি করে। তবে, কিছুক্ষণ রেস্তোরাঁর বিশেষত্ব হলো এখানে, অনেক কম দামে (কেবল ২০ টাকা) মানসম্মত কাটলেট পাওয়া যায়। দাম কম বলে, স্বাদেও কম একথা বলা যাবে না একেবারেই!
কাটলেট, চিকেন ফ্রাই, চপের সাথে দেওয়া বিটলবণ ও শসা-মরিচের সালাদ স্বাদে আনে আরও পরিপূর্ণতা।
তবে রেসিপির বিষয়ে আগ্রহ দেখালে মালিক বলেন, 'আমাদের ব্যবসাই চলছে খাবারের স্বাদ ধরে রাখার মাধ্যমে। তাই আমরা এই রেসিপি কাউকে বলিনা।'
খুব বেশি আইটেম এখানে পাওয়া যায় না। শুরু থেকে যেসব ছিল, এখনও তাই-ই আছে। তবে, নতুন সংযোজন এসেছে দোকানের পরিবেশে। স্থানীয়দের মতে, আগে এতটা নান্দনিক আর ছিমছাম ছিল না এই দোকান। এখন কাস্টমারদের কথা ভেবে অনেকটাই সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে। সুতরাং, দোকান কর্তৃপক্ষ যে বেশ রুচিবোধসম্পন্ন তা পরিষ্কার!
'আমার বাবার বন্ধুবান্ধব সবাই কবি-সাহিত্যিক ছিলেন। ছোটো গল্পকার কায়েস আহমেদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ফকির আলমগীর একসঙ্গে আড্ডা দিতেন,' যোগ করেন স্বপন বাবু।
শুরুতে যেমন বলেছি, দোকানের নামের প্রেমে পড়ে এসেছি এখানে। ইতিহাস ঘেঁটে জানলাম, দোকানের নামটি নাকি রেখেছেন ছোট গল্পকার কায়েস আহমেদ। এখানে তিনি প্রায়ই আসতেন জীবদ্দশায়। সঙ্গে থাকতেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস।
লেখক কায়েস আহমেদই বন্ধুর দোকানটির নামকরণ করেন
শুরুতে যেমন বলেছি, দোকানের নামের প্রেমে পড়ে এসেছি এখানে। সামনেই ইউনাইটেড মেডিক্যাল হল নামে এক ওষুধের দোকান ছিল, সেখানে রোজ আড্ডা দিতেন নারায়ণ চন্দ্র ঘোষ, কায়েস আহমেদ আর আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। এই কায়েস আহমেদই বন্ধুর দোকানটির নামকরণ করেন, 'কিছুক্ষণ রেস্তোরাঁ' নামে। তাই শুধু নাম নয়, নাম রাখার সঙ্গেও আছে দোকানের বিশেষত্ব।
সুস্বাদু খাবারের জন্য ৪৪ বছরের পুরোনো 'কিছুক্ষণ রেস্তোরাঁ' রসনাবিলাসীদের প্রিয় তার মনোরম পরিবেশ আর স্যুপ কাটলেটের জন্য। বর্তমানে খাবারের দাম কিছুটা বাড়লেও ২০ থেকে ৮০ টাকার মধ্যেই ভরপেট বিকেলের নাস্তা করার সুযোগ পাবেন এখানে। তাই ভোজনরসিক এবং ইতিহাসপ্রেমী হয়ে থাকলে, গেন্ডারিয়ায় কেশব ব্যানার্জি রোডে ৩৪/১ নম্বরের এ দোকানটি নিঃসন্দেহেই ভালোবাসার জায়গা দখল করে নিতে পারে।