ওয়াফেল আপ: স্ট্রিট ফুড জগতে এসেই তারুণ্যের মন জয়!
কবি কালিদাস বলেছেন 'আশ্বাস: পিশাচো হপি ভোজনেন'; যার অর্থ খাবার দিয়ে পিশাচকেও বাগে আনা যায়। কথাটা সম্পূর্ণ ঠিক না হলেও এর আংশিক বাস্তবতা যে রয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। পিশাচকে বাগে না আনা গেলেও বন্ধুদের সাথে আড্ডা জমানোর জন্য ভোজনরসিক বাঙালির অন্যতম উপসর্গ হলো খাবার। এই খাবার আবার ঐতিহ্যগত খাবার নয়। আড্ডা দেওয়ার জন্যে অধিকাংশ কিশোর কিশোরীর পছন্দ স্ট্রিট ফুড।
দেশে সাধারণত স্ট্রিট ফুড বলতে গৎবাঁধা কয়েকটি খাবারের নাম চলে আসে। ফুচকা, ভেলপুরি, বিভিন্ন ধরনের আচার, ঝালমুড়ি, চটপটি, কাবাব আরও কত কী! বেশ কিছুকাল থেকে চলতে থাকা দেশের স্ট্রিট ফুডের জগতে নতুন সংযোজন 'ওয়াফেল'।
স্ট্রিট ফুড শব্দবন্ধনী কানে বাজতেই ভোজনরসিক বাঙালীর জ্বিভে জল এসে যায়। এই খাবারের বিবর্তন হয়েছে সময়ে সময়ে। খাবারের বিবর্তন অনেকটা মানুষের আর্থিক কাঠামোর উপর নির্ভর করে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে নতুন নতুন খাবারের আগমন হয় রেস্টুরেন্ট অঙ্গনে। এই ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়েছে স্ট্রিট ফুডের ক্ষেত্রেও।
ওয়াফেল কী?
একধরনের খামিরযুক্ত পিঠা যা দুটি গরম প্যাটার্নযুক্ত কাঠামোর মাঝে রেখে চাপ দিয়ে বানানো হয়। প্যাটার্নের ভিন্নতা অনুযায়ী এর আকারেও ভিন্নতা আসে।
মূলত প্রাতঃরাশের খাবার হিসেবে পরিচিত হলেও এটি ডেজার্ট কিংবা স্ন্যাকস্ হিসেবেও ভালো কাজে দেয়। যে ধরনের ওয়াফেল তৈরি করছেন তার উপর নির্ভর করে এর রেসিপি।
ওয়াফেল বাইরে থেকে অনেকটা মচমচে আর ভেতরে চুইং। এর সাথে বিভিন্ন উপাদেয় দিয়ে গরম গরম পরিবেশন করা হয়। এরমধ্যে রয়েছে বাদাম, ফল বা মধু।
ওয়াফেলের ইতিহাস
দীর্ঘকাল থেকে ওয়াফেল মানুষের কাছে জনপ্রিয় খাবার হিসেবে পরিচিত ছিলো। রন্ধনসম্পর্কীয় ইতিহাসবিদদের ধারনা, প্রাচীন গ্রীসে ওয়াফেল এর আবিষ্কার হয়েছিলো এবং সেখানে এটি জনপ্রিয়ও ছিলো। সেসময়ে পাচকরা লম্বা কাঠের হাতলে যুক্ত ধাতব প্লেটের মাঝখানে ফ্লাট কেক ভাজতেন।
গ্রীকদের কাছে এই কেকগুলো 'ওবেলিওস' হিসেবেই পরিচিত ছিলো। আধুনিককালের ওয়াফেলের মতো 'ওবেলিওস' এতো মিষ্টি ছিল না। গ্রিকদের পর মধ্যযুগীয় ইউরোপে ক্যাথলিক চার্চ শস্যের আটা এবং পানি দিয়ে 'অব্লি' নামে একই ধরনের খামিরবিহীন ওয়েফার তৈরি করে।
ক্রমান্বয়ে এগুলোর সাথে বিভিন্ন ধরনের মশলা, ক্রিম, মধু এবং মাখনের মতো অন্যান্য উপাদান ব্যবহৃত হয়। ফলে ওয়েফারগুলো আরও ঘন হতে থাকে। মোটা ওয়েফারগুলোই পরবর্তীতে 'ওয়াফেল' এ পরিণত হয়।
তবে, আজ আমরা যেধরনের ওয়াফেল উপভোগ করি তার কৃতিত্ব দেওয়া হয় ডাচদেরকে। ১৫ শতকে, ডাচ ওয়াফেল পরিবেশকরা একটি গ্রিড প্যাটার্নসহ আয়তক্ষেত্রাকার প্লেট ব্যবহার করে এই খাবার তৈরি শুরু করেন। আমেরিকাতে ওয়াফেল জনপ্রিয় করার কৃতিত্ব ডাচদেরকেই দেওয়া হয়। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে 'ওয়াফেল আয়রন' ডাচদের পূর্বেই এভইলেবল ছিলো। নিউইয়র্কের ট্রয়ের কর্নেলিয়াস সোয়ার্টওয়ার্টই সর্বপ্রথম 'ওয়াফেল আয়রন' এর জন্য পেটেন্ট জারি করেন। সময়টি ছিলো ১৮৬৯ সাল। ১৯৫০ এর দশক থেকে এটি একটি জনপ্রিয় প্রাতঃরাশের খাবার হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে ওয়াফেল
ওয়াফেল বাইরের দেশগুলোতে স্ট্রিট ফুড হিসেবে পরিচিত হলেও বাংলাদেশে এটি দীর্ঘকাল ধরে 'ফাইন ডাইনিং' এ ডেজার্ট আইটেম হিসেবে পরিচিত। এই খাবারকে দেশের সকলের কাছে পরিচিত ও জনপ্রিয় করে তুলতে মোহাম্মেদ সালমান এটিকে আবারও স্ট্রিট ফুডের আঙ্গিকে পরিবেশনার উদ্যোগ নেন। গড়ে তোলেন 'ওয়াফেল আপ' রেস্টুরেন্ট।
এই উদ্যোগ নিয়ে কথা হয় ওয়াফেল আপ রেস্টুরেন্টের স্বত্তাধীকারী মোহাম্মদ সালমানের সাথে। তিনি বলেন, "ডেজার্ট হিসেবে পূর্বে অনেক বড় একটি ওয়াফেল পরিবেশন করা হতো। অনেকেই এতো বেশি মিষ্টি একসাথে খেতে অপছন্দ করেন। তাই আকারে এটিকে ছোট করে দামও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলস্বরূপ এটি সকলের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে চলে এসেছে এবং অপচয়ও রোধ হচ্ছে।"
নানান দেশে ঘোরাঘুরি করার অভ্যাস তার স্বভাবজাত। স্বাদ নিয়েছেন বিভিন্ন ধরনের খাবারের; পরিচিত হয়েছেন নতুন নতুন সার্ভিস পদ্ধতির সাথে। সেসব দেশ থেকে বিভিন্ন সময়ে নানান ধরনের নতুন নতুন আইডিয়া বিজনেসে নিয়ে এসেছেন। নতুনত্বের কারণে মানুষের সাড়াও পেয়েছেন উল্লেখযোগ্য হারে। ওয়াফেল আপ রেস্টুরেন্টের ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।
ওয়াফেল আপ রেস্টুরেন্টে একই সাথে তিনটি ধারনার বাস্তবায়ন করেছেন রেস্টুরেন্টের স্বত্তাধিকারী। এখানে কুইক সার্ভিস রেস্টুরেন্ট (কিউএসআর), ড্রাইভ ইন, লেট নাইট ফুড এই তিনটি ধারনার সংমিশ্রণ করেছেন বলে জানান রেস্টেুরেন্টটির মালিক মোহাম্মদ সালমান।
এই কয়দিনেই শহরের তরুণ তরুণীদের ব্যাপক সাড়া পেতে শুরু করেছে রেস্টুরেন্টটি। বিকাল থেকে পরিবেশনা শুরু হলেও সন্ধ্যা থেকে বেশি জনসমাগম ঘটে এর রেস্টুরেন্টে। লেট নাইটে এইখানে সমাগম সবচেয়ে বেশি।
বর্তমানে রেস্টুরেন্টটিতে ৬ ধরনের ওয়াফেল পাওয়া যায়। স্ট্রবেরি অ্যান্ড ব্যানানা উইথ নিউটেলা, ওয়াফেল অন আ স্টিক, ডেথ বাই নিউটেলা, ব্যানানাটেলা অ্যান্ড নাটস, ফ্রুটি ব্লিস উইথ আইসক্রিম এবং বাংলা পিৎজা ওয়াফেল। প্রতিটিরই দাম ১৭০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে।
বাংলাদেশের বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে গতবছরের ১৬ ডিসেম্বর এই রেস্টুরেন্টের যাত্রা শুরু হয়।
ওয়াফেল প্রেমী তাসনীম তাবাচ্ছুম উপমা বলেন, "ওয়াফেল আপের ওয়াফেল বাইরে ক্রাঞ্চি, ভিতরে সফট আর চুইং। যেহেতু নিউটেলা ওয়াফেল ছিল ওপরটা পুরোটাই চকলেটি ছিলো। ওভারঅল সুইটনেস অনেক বেশি।"
তিনি আরও বলেন ভোজনপ্রেমীরা এটা চেখে দেখতে পারেন; নিরাশ হবেন না।
কিউএসআর, ড্রাইভ ইন, লেট নাইট ফুড
কুইক সার্ভিস রেস্টেুরেন্ট এমন একটি ধারণা যা ক্রেতাকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অর্ডাকৃত খাবারটি দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এই ধরনের সেবার ক্ষেত্রে রেস্টেুরেন্টে কোনো ধরনের টেবিল থাকে না বরং ক্রেতার অর্ডারের সাথে সাথেই তা স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ক্রেতার জন্য প্রস্তুত করে দেন।
ক্রেতারা সাধারণত গাড়ি চালিয়ে রেস্টুরেন্টে আসেন এবং রেস্টুরেন্টের একজন কর্মচারী তার কাছে থেকে অর্ডার নিয়ে খাবার গাড়িতেই পৌঁছে দেন। এই ধরনের রেস্টুরেন্টে সাধারণত গাড়িতে বসে খাওয়াকে প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে।
মানুষের দৈনন্দিন জীবনে পরিবর্তন আসছে। মানুষের মাঝে রাত জাগার প্রবণতা বেড়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো অন্য জায়গায়, মাঝ রাতের পর শহরে খাবার কিংবা যে কোনো প্রকারের দোকান খোলা পাওয়া একটু কঠিন হয়ে পড়ে। তাই এই সমস্যা লাঘব করতে ধারণা এসেছে লেট নাইট ফুডের। এই ধরনের রেস্টুরেন্ট সাধারণত বিকেল থেকে ভোররাত পর্যন্ত চালু থাকে।
ওয়াফেল আপ রেস্টুরেন্টটির অবস্থান
ওয়াফেল আপের স্বাদ নিতে হলে আপাতত আপনাকে যেতে হবে বনানী ১৩ এর ই ব্লকে। আরও সহজ করে বলতে গেলে বনানী খান-ই-মজলিশ এর থেকে একটু সামনে গেলেই পাবেন এই রেস্টুরেন্ট। এর বাইরে শহরের যেকোনো প্রান্ত থেকে সহজেই ঘরে বসে অর্ডার করার সুযোগ রয়েছে।
নতুন ব্রাঞ্চ সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বত্তাধীকারী বলেন, "বসুন্ধরায় ইতোমধ্যে আমাদের একটি ব্রাঞ্চ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়াও রাজধানীর ধানমন্ডি, বেইলি রোড, উত্তরা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর এবং ঢাকার বাইরেও এই নতুন ব্রাঞ্চ প্রতিষ্ঠা নিয়ে আলোচনা চলছে।"