রানার থেকে ডিজিটাল স্পিড: বাংলাদেশের ডাক ব্যবস্থার সেকাল-একাল
পোস্টালপিডিয়া, ডাক প্রবাহ (ডাকঘরের ত্রৈমাসিক প্রকাশনা) তো আছেই, বিমল কর, সত্যজিৎ রায়, অবন ঠাকুরের বইও আছে। আছে কিডস কর্নার, বঙ্গবন্ধু কর্নার, শেখ হাসিনা কর্নার, স্বাধীনতা কর্নার। মোটকথা দারুন সব বইপত্র দিয়ে সাজানো আগারগাঁও ডাক ভবনের তৃতীয় তলার গ্রন্থাগার। এর অঙ্গসজ্জাও চমৎকার। লালরঙের ডাকবাক্সের আদলে গড়া ১৩ তলা ডাক ভবনটিও সুন্দর। তবে দুঃখের বিষয় লাইব্রেরিটি সপ্তাহের মাত্রই দুই দিন সোম ও বুধবার দুপুর আড়াইটা থেকে আড়াই ঘণ্টার জন্য খোলা থাকে। আর ডাক জাদুঘরটি তো এখনো পুরো সেজে ওঠেনি।
যাহোক আজ বলবো গ্রন্থাগারটির ছোট্ট কিন্তু সুন্দর এক গ্যালারির কথা। সেটি গ্রন্থাগারে ঢুকতেই বাম দিকে। গ্যালারিটির নাম, কালের আবর্তে বাংলাদেশ ডাক ব্যবস্থা।
লাল রঙের খামের ওপর বড় বড় স্ট্যাম্প দিয়ে গড়া এ গ্যালারি। প্রতিটি স্ট্যাম্পে আছে ইতিহাস। আড়াআড়ি মোটা একটা রেখা দিয়ে দুই ভাগ করা এ গ্যালারি।
ওপরভাগ শুরু হয়েছে ১২১ খিস্টপূর্বে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলের কথা দিয়ে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমল অবশ্য শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩২২ অব্দে আর তা শেষ হয় ২৯৮ অব্দে। তবু তার সময়ে ভারতবর্ষে কুরিয়ার শুরু হওয়ার উল্লেখটি সম্ভবত সত্যি। কারণ মহাস্থানগড়ের খননে প্রাপ্ত ব্রাহ্মীলিপি ফলক থেকে জানা যায়, চন্দ্রগুপ্ত স্থানীয় সামন্তরাজাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রজাদের যেনো রাজভাণ্ডার থেকে সম্পদ দেওয়া হয়। নির্দেশনাটি ক্যুরিয়ার মারফতই পাঠিয়েছিলেন বলে ধারণা করা যায়। ক্যুরিয়ার শব্দের বাংলা হলো দূত, ধাবক বা সংবাদবাহক।
উল্লেখ্য, চন্দ্রগুপ্ত তার আমলে আলেকজান্ডারের চেয়েও বড় সামাজ্যের অধিকারী ছিলেন। প্রাচীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ তক্ষশিলা তার আমলে ব্যাপক সমৃদ্ধি লাভ করে। অর্থশাস্ত্রের লেখক চাণক্য বা কৌটিল্য ছিলেন তারই প্রধানমন্ত্রী। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর চন্দ্রগুপ্ত উত্তর ভারত থেকে গ্রিক সৈন্যদের উৎখাত করেন। আলেকজান্ডারের সেনাপতি সেলিউকাস চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে মৈত্রীচুক্তি করতে বাধ্য হন। নিজের মেয়ে হেলেনাকে বিয়েও দেন। তবে চন্দ্রগুপ্ত মাত্র ৪২ বছর বয়সে রাজ্যপাট ছেড়ে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন। স্বেচ্ছাউপবাস শুরু করে তপস্যারত অবস্থায় মারা যান। চন্দ্রগুপ্ত অবশ্য আগে থেকেই বিশ্বাস করতেন ঈশ্বর ইট, কাঠ, পাথরে বসবাস করেন না, তার বাস আত্মায়।
তারপর নিচের দিকে আছে ৬০২-৬৮০ খ্রিস্টাব্দের কথা। বলা হচ্ছে, খলিফা মুয়াবিয়া দাপ্তরিক ডাক যোগাযোগের জন্য দেওয়ান-ই-বারইদ বা ডাক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তখন কাবুল থেকে দিল্লি হয়ে ৬টি মেইল রুটে ৯৩০টি পোস্টাল স্টেশন ছিল। মুয়াবিয়া ইবনে সুফিয়ানের জন্ম ৬০২ খ্রিস্টাব্দে। তিনি উমাইয়া সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে তার শাসনামল শুরু হয় আর তা অব্যাহত ছিল ৬৮০ পর্যন্ত। মুয়াবিয়ার চালু করা ডাক ব্যবস্থা আরেক উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক (৬৮৫-৭০৫ খ্রি.) সাম্রাজ্যজুড়ে বিস্তৃত করেন এবং নিয়মিত ডাক বিভাগ গঠন করেন।
আরেকজন খলিফা উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (৭১৭-৭২০) খোরাসান মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে সরাইখানা স্থাপন করেন। খলিফার কাছ থেকে বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের কাছে সংবাদ পাঠানোর জন্য ১২ মাইল অন্তর ঘোড়া বা উট বা গাধা বদল করা হতো। উল্লেখ্য ৭১২ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়া সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু ও পাঞ্জাব অঞ্চল জয় করে।
সুলতানি আমল
গ্যালারির পরের স্ট্যাম্পটির সময়কাল দেওয়া আছে ১১৮৬-১২০৬, ঘুরি সাম্রাজ্য। উটের মাধ্যমে সংবাদ আদান প্রদানের ব্যবস্থা তখন শুরু হয়। উল্লেখ্য, ঘুরি সাম্রাজ্যের অন্যতম সুলতান ছিলেন মুইজউদ্দিন মুহাম্মদ বা শিহাউদ্দিন মুহাম্মদ ঘুরি। তার শাসনকাল ১১৭৩ থেকে ১২০৬ খ্রি.।
আফগানিস্তানের ঘুর অঞ্চলে তার জন্ম ১১৪৯ সালে। বলা হয় তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল আফগানিস্তান, ভারত, পাকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, বাংলাদেশ ও ইরান। তার প্রিয়ভাজন একজন দাস কুতুবুদ্দিন আইবেক (১২০৬-১২১০) ছিলেন দিল্লীর প্রথম সুলতান। গ্যালারিতে তার নামেও একটি স্ট্যাম্প আছে। সেখানে বলা হচ্ছে, কুতুবুদ্দিনের শাসনামলে দিল্লী থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত আরবদের অনুকরণে এক ধরনের ডাক ব্যবস্থা বা ঘোড়ার ডাক চালু হয়। কুতুবুদ্দিন কতগুলো নতুন শব্দও চালু করেছিলেন যেমন কাসিদ মানে দূত, ধাওয়া মানে রানার, উলাপ বা ঘোড়ায় বহনকারী ইত্যাদি।
পরের স্ট্যাম্পটিতে বর্ণনা করা হচ্ছে, সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির আমলের কথা। বলা হচ্ছে, ১২৯৬ সালে পাঠান শাসক খিলজি যুদ্ধক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর সংবাদ ও সাধারণ ডাক নিয়মিত বহনের জন্য ডাক ঘোড়া ও ডাক রানার সংস্থা গঠন করেন। দুইজন অফিসারের তত্ত্বাবধানে গুপ্তচর ডাক বিভাগও গঠন করেন। তিনি শহরে সংবাদলেখক নিয়োগ করেছিলেন। উল্লেখ্য আলাউদ্দিন ছিলেন খিলজি বংশের দ্বিতীয় ও শক্তিশালী শাসক। ১২৯৬ থেকে ১৩১৬ পর্যন্ত ছিল তার শাসনকাল। তিনি ছিলেন উচ্চাভিলাষী, নিজেকে দ্বিতীয় আলেকজান্ডার বলে উল্লেখ করতেন। দেশে শান্তি শৃংখলা বজায় রাখার প্রতি মনোযোগী ছিলেন। দিল্লী ছিল তার রাজধানী।
পরের এন্ট্রিটি মোহাম্মদ বিন তুঘলকের। সময়কাল ১৩২৫ থেকে ১৩৫১ খ্রিস্টাব্দ। স্ট্যাম্পটিতে বলা হচ্ছে, তুঘলক তার শাসনামলে দুই ধরনের ডাক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন, তার একটি ঘোড়সওয়ার ডাকবাহক আর অন্যটি পায়ে হাঁটা সাধারণ ডাকবাহক। এতে সিন্ধু থেকে দিল্লী পর্যন্ত ডাক বহনের সময় অনেকটাই কমে যায়। ওই আমলে ডাক কর্মকর্তারা পুলিশের দায়িত্বও পালন করতেন। উল্লেখ্য তুর্কি তুঘলকরা প্রায় শত বছর (১৩২০ থেকে ১৪১৩) দিল্লীর শাসক ছিলেন। গিয়াসউদ্দিন ছিলেন এ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তার মৃত্যুর পর ছেলে মুহাম্মদ বিন তুঘলক গদীতে আসীন হন। তার আমলে সাম্রাজ্যের পরিধি বিস্তৃত হয় বেশি। প্রজাবৎসল হওয়া সত্ত্বেও তাকে অস্থির আর বদমেজাজী বলে চিত্রিত করেছেন ইবনে বতুতা।
শেরশাহ ও মুঘল আমল
পরের স্ট্যাম্পটিতে আছেন সম্রাট শেরশাহ সূরী। সময়কাল ১৫৩৮ থেকে ১৫৪৫। এতে বলা হচ্ছে শেরশাহের ডাক পরিবহন ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য সংযোজন ছিল রিলে পত্রবাহক পদ্ধতি।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থেকে সিন্ধুনদের তীর (পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া হয়ে পাকিস্তানের পেশোয়ারের মধ্য দিয়ে কাবুল) পর্যন্ত তিনি ৪,৮০০ কিলোমিটার গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড পুনঃনির্মাণ করেন। তিনি প্রতি দুই মাইল অন্তর একটি করে চৌকি তৈরি করান যেগুলি সরাইখানা এবং ডাকচৌকি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। শেরশাহ ১৭০০টি ডাকঘর নির্মাণ করেন এবং ঘোড়াসহ প্রায় ৩৫০০ ডাকচৌকি নিযুক্ত করেন। এগুলোর অধিকর্তাকে বলা হতো দারোগা–ই ডাকচৌকি। মুঘল শাসকেরাও দারোগা ব্যবস্থা বহাল রাখেন।
পরের অন্তর্ভুক্তি ১৬১০ সালের। স্ট্যাম্পটিতে বলা হচ্ছে, সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে বাংলার রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দিল্লির ডাক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ডাক গ্রহণ ও প্রেরণের জন্য ডাকচৌকির দারোগা বা সুপারিনটেনডেন্ট নিয়োগ করা হয়। তার সময়েই বাংলা থেকে উড়িষ্যা এবং রাজমহল থেকে মুর্শিদাবাদের মধ্যে কবুতরের সাহায্যে ডাক যোগাযোগ স্থাপিত হয়।
আরো উল্লেখ্য জাহাঙ্গীরের আমলে চিঠিগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হতো যেমন ফরমান মানে বাদশাহর আদেশ; শুক্কুক মানে সরাসরি কোনো ব্যক্তির প্রতি বাদশাহর পত্র; নিশান মানে বাদশাহ ছাড়া রাজ পরিবারের কোনো ব্যক্তির পত্র; হসবুল হুকুম মানে সম্রাটের নির্দেশক্রমে লেখা মন্ত্রীর পত্র; পরওয়ানা মানে নিম্নপদস্থ কর্মচারীর প্রতি প্রশাসনিক নির্দেশ ইত্যাদি।
ব্রিটিশ আমল
পরের স্ট্যাম্পটি রবার্ট ক্লাইভের, সময়কাল ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দ। তাতে বলা হচ্ছে, ক্লাইভের সময় কলকাতায় একজন পোস্টমাস্টার নিয়োগ দেওয়া হয়। কলকাতার সঙ্গে ৬টি ডাক যোগাযোগ কেন্দ্রের সংযোগ স্থাপন করা হয়। তবে প্রধান সংযোগ ছিল ঢাকা ও পাটনার সঙ্গে।
তার পরের অন্তর্ভুক্তি ওয়ারেন হেস্টিংসের, ১৭৭৪ সালের। কলকাতায় জেনারেল পোস্ট অফিস স্থাপন করা হয়। এ সময়ে নিয়মিত ডাক ব্যবস্থার আওতায় মাত্র দুই আনার বিনিময়ে বাংলাদেশের মধ্যে ১৬০ কিলোমিটার সীমানায় ডাক প্রেরণের ব্যবস্থা করা হয়। এ জন্য ১৩৯টি এলাকায় ৪১৭ জন ডাক হরকরা, ১৩৯ জন মশালচি এবং ১৩৯ জন ঢুলি নিয়োগ দেওয়া হয়।
তারপর আসে পালকি ডাকের স্ট্যাম্প। সেটি ১৯৮৪-১৯৮৫ সালের কথা। পালকি ডাকে চিঠিপত্রের বান্ডিলের সঙ্গে মানুষও বহন করা হতো। বর্ষা মৌসুম মানে জুন থেকে সেপ্টেম্বর, এই চার মাস ছাড়া সারা বছর এই ডাক ব্যবস্থা চালু থাকত। ১৭৮৫ সালে ডাক চৌকিগুলোর মাধ্যমে পার্সেল পাঠানোর ব্যবস্থাও চালু হয়। একেই আধুনিক পার্সেল সার্ভিসের আদিরুপ ধরা হয়।
উল্লেখ্য ওয়ারেন হেস্টিংস ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর ছিলেন ১৭৮৫ পর্যন্ত ১১ বছর। তার জন্ম ১৭৩২ সালে। তার পরিবার ছিল অভাবী। এক চাচা তাই তার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। চাচা তাকে লন্ডনে নিয়ে গিয়ে ওয়েস্টমিনস্টারের এক স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। স্কুল শেষে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীতে এক সামান্য চাকরিতে যোগ দেন। কলকাতায় পৌঁছান ১৭৫০ সালে। সিরাউদ্দৌলা ১৭৫৬ সালে কলকাতা আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হলে কাশিমবাজার কুঠিও দখল করে নেন। বন্দি হয়েছিলেন হেস্টিংসও। পরে পলাশিতে বাংলার সূর্য অস্তমিত হলে হেস্টিংস হন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর প্রথম গভর্নর জেনারেল।
উল্লেখ্য ১৭৮১ সালে কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ডাক মাশুল ছিল ৪০ টাকা আর সময় লাগত ৬০ দিন, ঢাকা পর্যন্ত ছিল ২৯ টাকা। ১৭৯৯ সালে কলকাতা জিপিওর যে ৯টি শাখা অফিস ছিল সেগুলো হলো ঢাকা, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, রংপুর, নাটোর, কুমারখালী, রঘুনাথপুর, সিলেট এবং রামু। ১৮৫৪ সালে দূরত্বভিত্তিক মাশুলের পরিবর্তে ওজনভিত্তিক মাশুল আদায় ব্যবস্থা চালু হয়। এসময়েই প্রথম সর্বভারতীয় ডাকটিকিট চালু হয়।
পরের এন্ট্রি ১৮৫৬ সালের। প্রথম চিঠি ফেলার বাক্স বা ডাক বাক্স চালু হয়। উল্লেখ্য ১৮৬৬ সালে পোস্ট অফিস আইন পাস করা হয়।
তার পরের স্ট্যাম্পে (১৮৭৩-৭৯) বলা হচ্ছে ১৮৭৩ সালে এক আনা মূল্যের এমবোসড খাম চালু করা হয়। ১৮৭৭ সালে রেজিস্ট্রার ডাক এবং ভ্যালু পেয়েবল ডাক চালু হয়। ১৮৭৮ সালে বীমাকৃত ডাক চালু হয়। এই বছরের সেপ্টেম্বর মাসেই ঢাকায় পোস্ট অফিসের সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। ১৮৭৯ সালে চালু করা হয় এক পয়সা মূল্যের পোস্ট কার্ড।
তার পরের স্ট্যাম্পে ১৮৮০ সালে ভারতের সব ডাকঘরে মানি অর্ডার ব্যবস্থা চালু করার কথা বলা হচ্ছে। এইসময় অবশ্য টেলিগ্রাফ ব্যবস্থাও প্রধান ডাকঘরগুলিতে চালু করা হয়ে গিয়েছিল। রেলওয়ে মেইল সার্ভিসকে জাহাজ যোগাযোগের সঙ্গে যুক্ত করার কাজও চলছিল। ১৮৮৪ সালে আসাম স্টিমার সার্ভিসের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা চালু করা হয়।
পরের এন্ট্রিটি ১৯৩০ থেকে ১৯৩৩ সালের। ত্রিশের দশকটি ছিল বিমানে ডাক পরিবহনের যুগ। ১৯৩৩ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে ঢাকা-কলকাতার মধ্যে বিমানে ডাক পরিবহন শুরু হয়। একই দিনে চট্টগ্রাম হয়ে কলকাতা-রেঙ্গুন রুট চালু হয়।
উল্লেখ্য ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ডাকবিভাগকে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়। চট্টগ্রামে স্থাপিত হয় অভ্যন্তরীণ ডাক সেন্সর স্টেশন। ১৯৪৩ সালে ময়মনসিংহ, ঢাকা ও চাদপুরে সেন্সর সাবস্টেশন স্থাপন করা হয়। তার আগে ১৯৪২ সালের মে মাসে পূর্ববাংলার প্রথম ফিল্ড পোস্ট অফিস যশোরের ঝিকরগাছায় স্থাপিত হয়। তারপর আসাম, আরাকান ও বার্মায় যুদ্ধরত সেনাদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরির লক্ষ্যে আরো অনেক ফিল্ড অফিস স্থাপন করা হয়।
দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালের ৯ জুলাই পাকিস্তানের নিজস্ব ডাকটিকিটের প্রচলন হয়।
পরের স্ট্যাম্পটির সময়কাল ১৯৫৬। ওই বছর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর ডাকটিকিট ও কাগজপত্র বাংলা হরফে মুদ্রিত হয়। প্রধান ডাকঘরগুলোতে ইংল্যান্ড থেকে আনা নতুন ফ্রাঙ্কিং মেশিন সরবরাহ করা হয়। পূর্ব ও পাকিস্তানের মধ্যে ডাক পরিবহনের জন্য ঢাকা-করাচি-ঢাকা রুটে দৈনিক ফ্লাইট চালু হয়।
পরের স্ট্যাম্পটি ১৯৭১ সালের। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রবাসী সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গেই সীমান্ত এলাকাগুলোয় ৫০টি ফিল্ড পোস্ট অফিস চালুর মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীর পরিচালনায় ডাক ব্যবস্থা চালু করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর সেগুলোকে স্থায়ী ডাকব্যবস্থার সঙ্গে একীভূত করা হয়।
১৯৭২ সালে সারা দেশে মোট ডাকঘরের সংখ্যা ছিল ৬৬৬৭টি। একই বছর ডাকটিকিট সংগ্রাহক সমিতি গঠন করা হয়। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়নের সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৮৪ সালে প্রথম জাতীয় ডাকটিকিট প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। তারপর ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ নিজস্ব নিরাপত্তা ছাপাখানা স্থাপন করে যেখান থেকে দেশের সকল ডাকটিকিট, খাম, পোস্টকার্ড ছাপানো হতে থাকে।
পরের স্ট্যাম্পটি ২০০০ সালের। ডাক বিভাগ এ বছর ইলেকট্রনিক মেইল সার্ভিস চালু করে। ই-পোস্ট সার্ভিস নামের এই সেবা বিশেষ করে দেশের প্রধান ১৬টি পোস্ট অফিসে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে পোস্ট অফিসের ইমেইল ব্যবহার করে মানুষ ছবি বা ডকুমেন্টস পাঠাতে পারে।
পরের স্ট্যাম্পটি থেকে ২০১০ সালের খবর জানা যাচ্ছে। এ বছর ডাক বিভাগ ইলেকট্রনিক মানি ট্রান্সফার সার্ভিস (ইএমটিএস) চালু করেছে যার মাধ্যমে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে অল্প খরচে বিভিন্ন অঞ্চলে টাকা পাঠানো যায়। এর মাধ্যমে দুস্থ, বয়স্ক, রোহিঙ্গা ভাতা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বেতন বা ভাতা পরিশোধের সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিচ্ছুদের ফিও এর মাধ্যমে আদায় করা হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পেনশনও এর মাধ্যমে বিতরণ করার সুযোগ আছে।
সর্বশেষ স্ট্যাম্পটি ২০১৮ সালের। নগদ নামের ডাক বিভাগের ডিজিটাল আর্থিক সেবার কথা বলা হচ্ছে এতে। থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস এটি পরিচালনা করে। এটি আগেকার ইলেকট্রনিক মানি ট্রান্সফার সিস্টেমের নতুন সংস্করণ। যেকোনো মোবাইল ফোনে নগদ অ্যাকাউন্ট খুলে একজন গ্রাহক দেশের যে কোনো স্থান থেকে নিজের মোবাইলে অর্থ জমা, উত্তোলন এবং অর্থ স্থানান্তরসহ বিভিন্ন বিল পরিশোধ করতে পারে।
নতুন যুগের ডাক
আজকের এই ডিজিটাল যুগেও ডাক ব্যবস্থা কিন্তু থেমে নেই। কাগজের মুদ্রার পাশাপাশি যেমন প্লাস্টিক মানি বা কার্ড আধুনিক যুগে হয়ে উঠেছে লেনদেনের অন্যতম মাধ্যম। ডাক বিভাগ তাই চালু করেছে পোস্টাল ক্যাশ কার্ড। ২৬টি ব্যাংকের ১৪০০টি এটিএম বুথে এ সেবা চালু আছে। এছাড়া দেশের জেলা-উপজেলা পোস্ট অফিস এবং বিভাগীয় গুরুত্বপূর্ণ সাব পোস্টঅফিসগুলোর প্রায় দেড় হাজার অফিসে পিওএস মেশিনের মাধ্যমে এ সেবা চালু আছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ২১৭১ জন প্রান্তিক কৃষককে পোস্টাল ক্যাশ কার্ডের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ ভাতা প্রদান করে থাকে। ইউএনডিপিও অতিদরিদ্র নারী ও তাদের পরিবারের জীবনমান উন্নয়নে এর মাধ্যমে অর্থ সহায়তা প্রদান করে।
ডাক বিভাগের আরেকটি আধুনিকায়িত সেবা স্পিড পোস্ট। পার্সেল দ্রুত পৌঁছানোর লক্ষ্য ২০১৮ সালে চালু হয়েছে এ সেবা। মোবাইল অ্যাপসভিত্তিক সফটওয়্যারের মাধ্যমে এটি পরিচালিত হয়।
এছাড়া আন্তর্জাতিক মেইল প্রেরণের জন্য চালু করা হয়েছে ইএমএস সেবা। ৪৩টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ইএমএস চালু আছে আর গমনপথ ইন্টারনেটে ট্র্যাক করা যায়। ২০ কেজি পর্যন্ত এর ওজন সীমা।
চিঠিপত্র তো বটেই পার্সেল, ব্যবসায়িক কাগজপত্র আর নমুনা বা স্যাম্পলও পাঠানো যায় ইএমএস সেবার মাধ্যমে। খরচও কম যেমন, অস্ট্রেলিয়ায় ২৫০ গ্রামের ইএমএস পাঠাতে খরচ হবে ২১৫০ টাকা, তার পরের প্রতি ২৫০ গ্রামে যোগ হবে ১৮০ টাকা করে। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ খরচ হয় ব্রাজিলে মেইল পাঠাতে, ২৫০ গ্রাম পর্যন্ত ২৫৮০ টাকা।
ডাক বিভাগ ইতোমধ্যে ১৮৬৩টি ডাকঘরকে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর গ্রামীণ ডাকঘরে রুপান্তরিত করেছে। অটোমেশন প্রকল্পের আওতায় ৭১টি প্রধান ডাকঘরে সঞ্চয় ব্যাংকের দৈনন্দিন লেনদেন ডিজিটাল পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে। ডাক জীবন বিমার প্রিমিয়ামও অনলাইনের সম্পন্ন করা হচ্ছে। ই-কমার্স সেবা চালু করা হয়েছে সাড়ে ৪০০ ডাকঘরে।
পরিশেষে
বাংলাদেশে এখন ডাকঘরের প্রায় ৯ হাজার আর এর গমনপথ ৫০ হাজার কিলোমিটার। এখন দেশে সাড়ে ১৩ হাজার মানুষের জন্য আছে একটি ডাকঘর। সাধারণত প্রতিটি ডাকঘরে পোস্ট মাস্টারসহ তিনজন কর্মী থাকেন।
আগের দিনে স্থানীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা পোস্টমাস্টার হতে আনন্দ বোধ করতেন। মহাকবি কায়কোবাদও ছিলেন একজন পোস্টমাস্টার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পোস্টমাস্টার এক অনন্য ছোটগল্প। সে গল্পের রতনকে ভুলে যাওয়া মুশকিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি প্রতীকী বা রূপক নাটকের নামও দিয়েছেন ডাকঘর। সুকান্ত ডাক হরকরাদের সংগ্রামী জীবন নিয়ে লিখেছেন কবিতা 'রানার'। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এক নীতিবান ডাক বাহক ও তার বিপথগামী সন্তানকে নিয়ে ডাক হরকরা নামের গল্প লিখেছেন।
এখনো বিশ্বব্যাপী চিঠি লিখন প্রতিযোগিতা হয়। মহামারির সময় তেমন একটি প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ পুরস্কারও জিতেছে। পত্রমিতালি নব্বইয়ের দশকেও একটি জনপ্রিয় যোগাযোগপ্রক্রিয়া ছিল। ডাকটিকিট জমানো এখনো অনেকের কাছেই মূল্যবান শখ। শত শত স্মৃতি জমা করেছে ডাকঘর, রানার, পোস্টমাস্টার, চিঠি, খাম বা পোস্টকার্ড। তাই সাধু সাবধান, ডাকঘরের দরজা বন্ধ থাকলে স্মৃতির ঘরেও ধুলো জমবে।