যদি জল-জঙ্গল আর চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গলে হয় একদিনের ভ্রমণ
জল-জঙ্গলের কাব্যের সঙ্গে পাহাড় আর চা বাগানের মিতালী। পাহাড়ি মেঘের আনাগোনায় সারাদিন যখন তখন বৃষ্টি, সেই কল্যাণে সারাবছর বয় শীতল বাতাস। বাঙালি, মণিপুরী, খাসিয়া, টিপরা, গারোসহ নানান জাতির বসবাসে বৈচিত্র্যময় জনারণ্য গড়ে উঠেছে ছোট্ট উপজেলাটির আশেপাশে। দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ, শ্রীমঙ্গল যেন ভ্রমণার্থীদের কাছে এক স্বর্গপুরী।
ধুলো-ধোঁয়ার শহর ছেড়ে স্বস্তির বাতাস নিতে চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গলে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল অনেকদিনের। ব্যস্ত দিনের ফাঁকে কখনো সময় মেলে তো সঙ্গী মেলে না, আবার কখনো সঙ্গী মেলে তো সময় মেলে না। এরই মধ্যে ব্যাটে-বলে মিলে যাওয়ায় স্থির হলো একদিনের জন্য শ্রীমঙ্গল ভ্রমণের দিনক্ষণ। ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গলের দূরত্ব ১৮৫ কিলোমিটারের মতো। যাতায়াতে সময় লাগে ৫ ঘণ্টার কাছাকাছি। তাই রাতে রওনা হলে পুরো ছুটির দিন ঘুরাঘুরি শেষে আবার পরের রাতেই ফিরে আসা যায় ঢাকায়।
প্রথমবার শ্রীমঙ্গল যাওয়ার জন্য আমরা রেলভ্রমণকেই বেছে নিয়েছিলাম। নিশ্চিত টিকিট পেতে চাইলে যাত্রার পাঁচদিন আগেই কাটতে হয় টিকিট। ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল ট্রেনের টিকেট ভাড়া ২৪০ টাকা। অনলাইনে কাটলে চার্জ যোগ হবে ২০ টাকা। উপবন এক্সপ্রেস ঢাকা ছেড়ে যায় রাত সাড়ে আটটায়। শ্রীমঙ্গল পৌঁছায় রাত একটা থেকে দেড়টার ভেতর।
মধ্যরাত, অচেনা স্টেশন, অপরিচিত পরিবেশ, নিরাপত্তা নিয়ে ছিল কিছুটা সংশয়। ট্রেন থেকে নামতেই অবশ্য সেই সংশয় দূর হয়ে গেল। গভীর রাতেও জমজমাট স্টেশন। সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুরু হওয়ায় টুরিস্টদের সংখ্যা ছিল চোখে পড়ার মতো। স্টেশনের বাইরে সিএনজি, জিপগাড়ি নিয়ে অপেক্ষারত ড্রাইভারেরা। যাত্রার আগেই আমরা জিপ গাড়ি বুক করে রেখেছিলাম, তাই সেদিকে আর আগাইনি।
রাত দুটোতেও স্টেশনের পাশের হোটেলে ভাজা হচ্ছিল গরম গরম পরোটা। সেখানেই হাল্কা নাস্তা করতে বসে গেলাম কয়েকজন। নাস্তা শেষে আবার স্টেশনে বসে ভোর হওয়ার অপেক্ষা।
ভোর হতেই জিপ এসে হাজির আমাদের নিয়ে যেতে। স্টেশন থেকে ৫ মিনিটের দূরত্বে পানসি হোটেলে নাস্তা সেরে জিপে করে চা বাগানের পথে যাত্রা শুরু। এক জিপে জায়গা হয় ৮-১০ জনের। খোলা জিপে চা বাগানের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে চোখ হারিয়ে যায় অবিরাম সবুজের মাঝে।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান
চা বাগানের রাস্তা ধরে এগিয়ে আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। পথেই দেখা মিললো রাবান বাগানের। শহর থেকে গাড়িতে আধঘণ্টার দূরত্বেই লাউয়াছড়া। শ্রীমঙ্গল আর কমলগঞ্জ উপজেলা মিলে ১২৫০ হেক্টর জায়গা জুড়ে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ এই বন। টিকিট কেটে উদ্যানের ভেতরে ঢুকে দেখা যায় আকাশ ছেয়ে যাওয়া বিশাল সব বৃক্ষরাজির। জঙ্গলের কিছু কিছু জায়গায় গাছের ছায়া ভেদ করে পৌঁছাতে পারে না রোদ। এখানকার কোনো কোনো গাছ লাগানো হয়েছিল সেই ব্রিটিশ আমলে।
চিরহরিৎ এই বর্ষাবনে হুটহাট নামে বর্ষা। বনের মাঝে হাঁটতে হাঁটতেই হঠাৎ বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিয়েছিল আমাদের। কিছুদূর এগোতেই বিচিত্র এক শব্দ কানে এলো। জানতে পারলাম বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের ডাক এটা। সেই ডাক অনুসরণ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম জঙ্গলের ট্রেইল ধরে। বিচিত্র আর অচেনা গাছের ফাঁক থেকে নানা পাখির ডাকও ভেসে আসছিল কানে। জনমানুষের কোলাহলের বাইরে পশুপাখির এই অভয়ারণ্যে নিজেদের পথচলার শব্দটাও ছিল বেমানান।
লাউয়াছড়া বনের ভেতর দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। সবুজের সমারোহে অপরূপ সৌন্দর্য এই রেলপথকেও করে তুলেছে অনন্য। ফরাসি লেখক জুলভার্নের বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি হলিউডের সিনেমা "অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ"-এর একটি দৃশ্যের শ্যুটিং হয়েছিল এই রেললাইনে। হুমায়ূন আহমেদের সিনেমা "আমার আছে জল"-এ দিলুও হেঁটে বেরিয়েছিলো এখানে।
রেললাইন ছাড়িয়ে ট্রেইল ধরে চলতে চলতেই দেখা পেলাম পাহাড়ি ঝিরিপথের। জুতো খুলে খালি পায়ে ঝিরির ঠান্ডা পানিতে পা ডুবিয়ে এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। নরম বালির মাটিতে পা দেবে যেতেই ভয় জাগে, চোরাবালি নয়তো! বালির উপর আঁকাবাঁকা সরু দাগে সাপের চলার পথ দেখেও গা শিউরে উঠলো। আমার প্রচন্ড সাপ ভীতি। ঝিরি পথ পেরিয়ে কিছুদূর পর খোলা মাঠের দেখা মিললো। জিপের ড্রাইভার দিকনির্দেশনায় জানিয়েছিল মাঠের পরেই খাসিয়াপুঞ্জি।
টিলার গায়ে সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছালাম আলো ঝলমলে খাসিয়াপুঞ্জিতে। মাটির ঘরের পাশাপাশি ইট-কাঠের দালানেও খাসিয়াদের বাস। ঘরের বারান্দায় বসে নারীরা পান বাছাইয়ের কাজ করছিলেন। ৪-৫ বছরের ছোট্ট বাচ্চারা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে পড়তে যাচ্ছিলো টিলার গায়েই এক স্কুলে। বংশানুক্রমে এখানকার বনের ভেতরই জীবনযাপন এই খাসিয়া জাতির।
খাসিয়াপুঞ্জি দেখে আবার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। পথে এক খাসিয়া নারীর কাছ থেকে পাহাড়ি আনারস কিনে খেলাম। পুরো বনে কোথাও মোবাইল নেটওয়ার্ক পাইনি আমরা। দলছুট হয়ে গেলে আবার দলের দেখা পাওয়া ছিল মুশকিল। গহীন বনে গেলে অনেকেই তাই গাইড নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
মাধবপুর লেক
লাউয়াছড়া উদ্যান থেকে জিপে চড়ে আধঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম মাধবপুরে। মাধবপুর চা বাগান পেরিয়ে ঢুকতে হয় লেক এলাকায়। চা বাগানের জন্য পানির ব্যবস্থা করতে ১৯৬৫ সালে বাগান কর্তৃপক্ষ টিলায় বাঁধ দিয়ে পানি জমিয়ে তৈরি করেছিলেন এই লেক। টিলা-পাহাড়ে চা বাগানের ফাঁকে ফাঁকে বয়ে চলা এই লেকের শান্ত পানি আর রঙিন শাপলা মিলে তৈরি করেছে স্নিগ্ধ পরিবেশ।
লেকের পাশে পৌঁছাতেই হুড়মুড়িয়ে নামলো বৃষ্টি। পাহাড়ি বৃষ্টির ঠান্ডা জলে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে গেলাম উঁচু টিলার দিকে। কর্দমাক্ত পথে কাকভেজা হয়ে টিলার ওপর উঠতে গিয়ে বারবার পিছলে যাচ্ছিলো পা। তবু অক্ষতভাবে উপরে উঠতে পেরে সার্থক মনে হয়েছিলো কষ্টটা। উঁচু থেকে লেকের পানি আর চা বাগানে বৃষ্টি পড়ার দৃশ্য অবর্ণনীয় সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছিল। পাশে থেকে স্থানীয় একজন হেসে বললেন, "আমাদের এখানে বৃষ্টির কোনো ঠিকঠিকানা নাই।"
টিলার উপরে কথা হয়েছিল এক চা শ্রমিকের সাথে। বৃষ্টিতে একটু সময় পেয়ে জিরিয়ে নিচ্ছিলেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে ৬০-১০০ টাকা আয় হয় তার। বংশ পরম্পরায় চা বাগানে কাজ করে যাওয়া এই শ্রমিকদের জীবন আটকে থাকে চা-চক্রেই।
বৃষ্টি থামলে টিলা বেয়ে লেকের পাড়ে নামার পথ ধরলাম। পিচ্ছিল পথে অনভ্যস্ত এক সঙ্গী ডিগবাজি খেয়ে পড়লো, একটুর জন্য রক্ষা বড় দুর্ঘটনা থেকে। পা টিপে টিপে নিচে নেমে লেক ঘেঁষে হাঁটতে লাগলাম। সাথে অতিরিক্ত কোনো জামা-কাপড় না নিয়ে আসায় গায়েই শুকোলো কাপড়। লেক থেকে বের হওয়ার আগে এক ফেরিওয়ালার কাছ থেকে খেলাম চা পাতা ভর্তা!
নূরজাহান টি-এস্টেট
মাধবপুর লেকের পর নূরজাহান চা বাগানের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চললো আমাদের জিপ। পাহাড়ের গায়ে চা বাগানের সারির এই পথে চলতে চলতে চলতে অজান্তেই মনে বাজছিলো "এই পথ যদি না শেষ হয়"! চা বাগানের ভেতরেই খড়ের ছাউনির মতো বানানো। সেখানে বসে চা শ্রমিকেরা দুপুরের খাবার সেরে নিচ্ছিলো। চা বাগানের পাশেই চোখে পড়েছিল আনারস বাগান ও লেবু বাগান। নূরহাজান চা বাগানের পুরো পথ জিপ দিয়েই ঘুরে শেষ করলাম আমরা। এরপর গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্টের সামনের রেস্টুরেন্টে সেরে নিয়েছিলাম দুপুরের খাওয়াদাওয়া।
উপমহাদেশের অন্যতম পুরানো চা গবেষণা কেন্দ্র "বাংলাদেশ চা গবেষণা ইন্সটিটিউট" ঘুরে দেখার ইচ্ছা ছিল এরপর। কিন্তু শুক্রবার দুপুরের সময় সেখানে ঢোকার অনুমতি পাওয়া যায়নি।
লাল পাহাড়
চা গবেষণা কেন্দ্র পেরিয়ে কিছুদূর এগিয়ে গেলাম ফুলছড়া চা বাগানের ভেতরে অবস্থিত লাল মাটির পাহাড়টিতে। চা বাগানের ভেতর দিয়ে মাটির পথে হেঁটে যেতে হয় সামনে। পাহাড়ে ওঠার আগে পার হতে হয় সরু ঝিরি পথ।
লাল মাটির বেশ কয়েকটি পাহাড়ের পাশাপাশি অবস্থান এখানে। উঁচুনিচু পাহাড় আকাশের গায়ে আঁকা তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে আছে। পাহাড়ের চূঁড়ার দু'দিকে দুটি মন্দির। বিকাল ৪টা পর্যন্ত ঘুরে বেড়ানো যায় এখানে। আমরা পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় ৫টা বেজে যাওয়ায় আর উপরে যাওয়ার অনুমতি পেলাম না। লাল মাটির উপর বসেই কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলাম সদলবলে। নিস্তব্ধ পাহাড়ের উপর আমাদের কথাবার্তা প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছিলো কানে। লাল পাহাড়ের গায়ে সূর্য ঢলে পড়তে পড়তেই আমরা পা বাড়ালাম নীলকণ্ঠের পথে।
আদি নীলকণ্ঠ টি কেবিন
নীলকণ্ঠ কেবিনের বিখ্যাত সাত রঙের চা, অসংখ্য গল্পে শুনেছি যার নাম। শ্রীমঙ্গল এসে এই চায়ের স্বাদ না নিয়ে তো ফেরা যায় না। সন্ধ্যার আগেই হাজির হলাম মণিপুরী পাড়ার রামনগরের আদি নীলকণ্ঠ টি কেবিনে। এই টি কেবিনের দুইটি শাখা, আরেকটি কালীঘাট রোড, ৪৬ বিজিবি ব্যাটেলিয়নের ক্যান্টিনে।
দোকানের সামনেই বেশ কয়েকটি জিপ দাঁড়িয়ে, চা-প্রেমী পর্যটকদের আড্ডা জমেছে টেবিল ঘিরে। সাত রঙের চা, মালাই চা আর স্পেশাল পাতা চায়ের অর্ডার দিয়ে দোকানের আশপাশ ঘুরে দেখছিলাম। দোকানের এক দেয়াল জুড়ে দেশ-বিদেশের বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের ছবি, যারা এখানে চা খেতে এসেছিলেন। আরেক দেয়ালজুড়ে দেশি-বিদেশি পত্রিকায় এখানকার চা নিয়ে করা নানান রিপোর্ট সাজানো। দেখা হয়ে গেল এই চায়ের আবিষ্কারক রমেশ রাম গৌড়ের সাথে। গল্পে গল্পে জানলাম অনেক কথা।
শুরুতেই বললেন বিখ্যাত চা-টা কিন্তু সাতটা রঙের না, সাতটা স্তরের। কোনো কৃত্রিম উপকরণ না মিশিয়ে বানানো হয় সাতটা স্তর। এই চা বানানোর গোপন প্রক্রিয়া শুধু তার পরিবারের কয়েকজন সদস্যই জানেন। হোয়াইট টি, লেমন টি, গ্রিন টি, আরও অনেক ধরনের চা আর মশলার সংমিশ্রণে তৈরি হয় এই চা। এখন দশ স্তরের চা-ও পাওয়া যায় এখানে।
গরম পানির কাপের ভেতর করে আরেকটি স্বচ্ছ কাপে হাজির হলো আমাদের সাত স্তরের চা। সাধারণত চা বলতে আমরা যা বুঝি তার সাথে মিল নেই এর স্বাদের। দারুচিনি, লেবু, লবঙ্গ, আদা নানা ধরনের মশলার স্বাদ পাওয়া যায় একেকটি স্তরে। নাম-ডাক যা শুনেছি সে অনুযায়ী, স্বাদের দিক থেকে আশা পূরণ করতে পারলো না সাত স্তরের এই চা। দর্শনধারীতেই এর চমক। তবে নীলকণ্ঠ টি কেবিনের স্পেশাল পাতা চা আর মালাই চায়ের স্বাদ সহজেই মন জয় করে নিল সবার।
বধ্যভূমি ৭১
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-র সদর দপ্তরের সাথেই অবস্থিত বধ্যভূমি ৭১। মুক্তিযুদ্ধের দুঃসহ স্মৃতির সাক্ষী শ্রীমঙ্গলের ৫টি বধ্যভূমির মধ্যে কেবল এই বধ্যভূমিটিই সংরক্ষিত আছে। ফিনলে চা বাগান আর ভুরভুরিয়া ছড়া (পাহাড়ি ছোট নদী)-র পাশে অবস্থিত এই বধ্যভূমিটি এখন পার্কে রূপান্তরিত হয়েছে।
ঝুলন্ত সেতু, কৃত্রিম ফোয়ারা, মৃত্যুঞ্জয়ী ৭১ ভাস্কর্য আর স্মারক স্তম্ভ দিয়ে সাজানো হয়েছে বধ্যভূমি এলাকা। শ্রীমঙ্গলের স্থানীয় মানুষ ও পর্যটকদের প্রধান বিনোদন কেন্দ্র এখন এই জায়গা। মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য শহীদের প্রাণ হারানো আর নির্যাতিত মানুষের স্মৃতি অনেকটাই বিস্মৃত মনে হলো এখানকার আনন্দঘন পরিবেশ দেখে।
ভ্রমণ পরিকল্পনায় হাইল হাওরের বাইক্কা বিল ঘুরে দেখার ইচ্ছাও ছিল আমাদের। শুরুর কয়েকটি স্পটে বেশি সময় কাটানোয় সে পরিকল্পনা বাদ দিতে হলো। বধ্যভূমি ঘুরে দেখা শেষেই জিপওয়ালাকে ছুটি দিয়ে দিলাম আমরা। এরপর নিজেদের মতো করে শ্রীমঙ্গল শহরের অলিগলি ঘুরে বেড়ালাম।
ঠিকঠাক সময় মানিয়ে নিতে পারলে শ্রীমঙ্গলে একদিনের ভ্রমণে দেখার মতো আছে আরোও বেশ কয়েকটি জায়গা। একসময়ের শ্রীমঙ্গলের দুর্দান্ত শিকারি সিতেশ রঞ্জন দেবের ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলা বন্য প্রাণী সেবা ফাউন্ডেশনে আছে নানা প্রজাতির দুর্লভ পশু-পাখি। স্থানীয়দের কাছে যা সিতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা হিসেবেই পরিচিত। মণিপুরী বাজার ঘুরে দেখতে পারবেন স্থানীয় আদিবাসীদের হাতে বোনা শাড়ি, ওড়না, গামছা, জামার সমাহার। বেশ কমদামে এখান থেকে কেনাকাটা করা যাবে মনমতো। বিচিত্র প্রজাতির সব পাখি দেখার জন্য যাওয়া যায় শ্রীমঙ্গল বার্ড পার্ক ও ব্রিডিং সেন্টারে। মাধবপুর লেকের কাছেই ধলই চা বাগানের ভেতর অবস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে করতে এখানেই শহীদ হয়েছিলেন হামিদুর রহমান। বীরশ্রেষ্ঠের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যেতে পারেন এই স্মৃতিসৌধে।
দুই-তিন দিনের মতো সময় নিয়ে শ্রীমঙ্গল বেড়াতে গেলে হামহাম জলপ্রপাত, বাইক্কা বিল, নিরালা পুঞ্জি, আদমপুর মণিপুরীপাড়াসহ আশেপাশের সব দর্শনীয় স্থান ঘুরে আসা যাবে। শ্রীমঙ্গলে থাকার জন্য আছে উন্নতমানের বেশ কিছু হোটেল, রিসোর্ট আর ডাকবাংলো। ভ্রমণসঙ্গী কম হলে জিপের বদলে সারাদিনের জন্য সিএনজি ভাড়া করেও বেড়ানো যায়। দৈনিক হিসেবে জিপ ভাড়া ২০০০-২৫০০ টাকা, আর সিএনজি ভাড়া ১০০০-১২০০টাকা।
শ্রীমঙ্গল থেকে উপবন এক্সপ্রেসে ঢাকায় ফিরতে আমরা রেলস্টেশনে অপেক্ষা করলাম রাত ২:১৫ মিনিট পর্যন্ত। রেলস্টেশনে অপেক্ষার সময়টুকু এড়াতে চাইলে বাসে যাতায়াতের পরিকল্পনা করাই ভালো। দিন ও রাতের বিভিন্ন সময়ে ঢাকাগামী বাস ছেড়ে যায় শহরের বাসস্ট্যান্ড থেকে। বাস ভাড়া ৪৭০ টাকা।
বর্ণিল প্রকৃতি আর বৈচিত্র্যময় জীবনধারার শহর শ্রীমঙ্গল খুব সহজেই আপন করে নেয় সব ধরনের ভ্রমণপ্রিয় মানুষকে। সবুজের স্নিগ্ধতায় ডুবে যেতে চাইলে একদিনের ভ্রমণে শ্রীমঙ্গলের চেয়ে আদর্শ গন্তব্য আর হয় না।