যেখান থেকে নিজেই শিখুন গাড়ির যত্নআত্তি
শৌখিন জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ গাড়ি। তাছাড়া একটি ব্যক্তিগত গাড়ি থাকলে স্থানিক দূরত্ব কমিয়ে আনা সম্ভব অনায়াসেই। কিন্তু এই ব্যবস্থাপনা জটিলতার কারণে অনেকেই গাড়ির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। কেমন হয় যদি আপনি নিজেই গাড়ির প্রাথমিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে সক্ষম হন?
এমন সুযোগই তৈরী করছে বাংলা অটোমোবাইল স্কিলস নামের প্রতিষ্ঠানটি।
২০১৩ সালে যাত্রা শুরু করে 'বাংলা অটোমোবাইল স্কিলস'। খুব ছোটবেলা থেকেই গাড়ির প্রতি অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করতো এর প্রতিষ্ঠাতা মেহরাব মাসাঈদ হাবিবের। যে কোনো গাড়ি সম্পর্কে জানার জন্যে নিজের মধ্যে প্রবল আগ্রহ দেখতেন। তবে তখনও জানতেন না, এ নিয়েই একদিন ভবিষ্যত গড়ে তুলবেন।
ক্রমেই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত 'লাইফ গোল' নেওয়ার সময় আসলো। 'প্যাশন'কে পেশা হিসেবে বাছাই করার মতো চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা দুই-চারজনের মধ্যে মাসাঈদও ছিলেন। তিনি ভাবলেন অটোমোবাইল নিয়েই কিছু করবেন।
আসলে স্কুলে থাকাকালীনই এ নিয়ে নানান ধরনের ভাবনা তাকে ঘিরে রাখতো।
আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশে (এআইইউবি) ভর্তি হয়ে বেছে নিলেন ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ে অটোমোবাইল নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা অনেকের কাছে অদ্ভুত ঠেকলেও মাসাঈদ জানতেন তিনি ঠিক পথেই আছেন। কারণ তিনি জানতেন ইলেক্ট্রিক গাড়ির বিষয়ে, জানতেন স্বনির্ভর গাড়ির বিষয়েও। তিনি সবসময় সর্বশেষ আপডেট রাখার চেষ্টা করতেন। তিনি জানতেন সামনে অটোমোবাইল শিল্পে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অবদান রাখার সুযোগ থাকবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের গাড়ি নিয়ে জানার তৃষ্ণা মেটাতে অটোমোবাইল সম্পর্কিত বিভিন্ন বই পড়তেন- কখনো নীলক্ষেত থেকে, আবার কখনো বাইরের বইয়ে। বাইরের বইয়ের ক্ষেত্রে নির্ভর করতেন দেশের বাইরে থাকা আত্মীয়দের উপর।
তবে অটোমোবাইল নিয়ে কাজ করার আকাঙ্খার কথা জানালে বন্ধুরা এ নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক বা কাঠামোবদ্ধ শিক্ষার সুযোগ নেই বলে পিছিয়ে যেতেন। তবে হাল ছাড়েননি মাসাঈদ।
এবার শুরু হলো নতুন যাত্রা। নিজের একান্ত ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় যা জানতে পেরেছেন তা-ই মানুষকে শেখানোর তাড়না থেকে শুরু করেন এ যাত্রা। ভাবলেন ফেসবুকের মাধ্যমে মানুষকে জানাবেন। ঠিক সেসময়ে তার সামনে আসে আরেকটি বাধা। কিন্তু লক্ষ্য যার অটুট তাকে রুখবে সাধ্য কার? তাকে এ বিষয়ে সাহায্য করার জন্যে এগিয়ে আসেন তার চাচাতো ভাই। ভাইয়ের দেওয়া ইউটিউবের টিউটোরিয়াল লিঙ্ক থেকেই শেখেন ভিডিও বানানোর পদ্ধতি।
শেখার পর মূল কাজে হাত দেন মাসাঈদ। মাইক্রোসফট্ পাওয়ার পয়েন্ট ব্যবহার করে শুরু করেন কাজ। স্লাইডের মাধ্যমে অটোমোবাইল সম্পর্কিত বিভিন্ন জিনিস দেখাতেন আর তার বর্ণনা দিয়ে বানাতেন ভিডিও। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ফেসবুকে তার প্রথম ভিডিও প্রকাশ পায়। সেখানে তিনি চেসিস সম্পর্কে মানুষকে ধারণা দেন।
মানুষের প্রবল সাড়া পান তিনি। এরপর একে একে আসতে থাকে তার বাকি ভিডিওগুলো। ধারণা দেন ক্লাচ, অটো গিয়ার, ম্যানুয়াল গিয়ারসহ আরও নানান বিষয়ে।
ভালোই চলছিলো তার শিক্ষা কর্মসূচি। কিন্তু তিনি একে নিছক অপ্রাতিষ্ঠানিক রাখতে চাননি।
দেশের প্রথম অটোমোবাইল বিষয়ক কর্মশালা
এই স্কুলের যাত্রা শুরুর এক বছরের মধ্যেই মাসাঈদ ভাবলেন এটিকে কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। ভাবলেন প্রশিক্ষণ কর্মশালা করবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। আর্থিক পৃষ্ঠপোষক খুঁজতে থাকেন তিনি। অনেকবার 'না' শুনতে হলেও থেমে যাননি তিনি। জোগাড় করেই ছাড়েন স্পন্সরশিপ। ২০১৫ সালের জুন মাসে তিনি ট্রেনিং কর্মশালার মধ্য দিয়ে গাড়িপ্রেমীদের বিভিন্ন খুঁটিনাটি সম্পর্কে জানান। ত্রিশের অধিক মানুষের অংশগ্রহণে শেষ হয় দেশের প্রথম অটোমোবাইল বিষয়ক প্রশিক্ষণ কর্মশালা। এরপর তাকে ডেকে নেয় ঢাকা মোটর শো'র আয়োজকরা। ২০১৬ সালে ঢাকা মোটর শোতে তিনি দ্বিতীয় কর্মশালা করান।
এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। একে একে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ও তাকে ডেকে নিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য কর্মশালার আয়োজন করে। এই তালিকায় আছে প্রধান প্রধান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেমন- ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউআইইউ), আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ (এআইইউবি), ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি (আইইউবিএটি), এসিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটিসহ আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়। তালিকায় আছে নিজের বহুল প্রতীক্ষিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ও (বুয়েট), যেখানে তিনি নিজেই একসময় পড়তে চাইতেন। বুয়েটের অটোমোবাইল ক্লাবের আয়োজিত এক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় প্রশিক্ষক হিসেবে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি।
এরপর ভাবনায় আসে তার প্রতিষ্ঠানটিকেই প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় নিয়ে আসার। তিনি ভাবলেন অটোমোবাইল স্কুলই হবে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান, যা মানুষকে প্রশিক্ষণ দিবে এবং এর স্বীকৃতিস্বরূপ তাদেরকে সার্টিফিকেটও প্রদান করবে। সেই ভাবনার আলোকে কাজ করতে শুরু করেন তিনি।
শুরু প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম
২০২০ সালের এপ্রিল মাসে করোনার সময়ে প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিরা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই কোর্সকে আবারও মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে শুরু করেন। তখন জুমের মাধ্যমে আগ্রহীদের নামমাত্র মূল্যে কোর্স করার সুযোগ করে দেয়া হতো। সেখানেও প্রতিষ্ঠানটি ভালোই সাড়া পায়। ক্রমান্বয়ে ব্যাচের সংখ্যা বাড়তে থাকে। নিয়মিত এতোগুলো ব্যাচকে সামলানো তাদের জন্যে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
মানুষের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে তারা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তাদের এই কোর্সগুলো সংরক্ষণের চিন্তা করেন। সেখানে মানুষ তাদের প্রয়োজনমতো কোর্স কিনতে পারবেন, থাকছে মূল্যায়নেরও সুযোগ। মূল্যায়নের মাধ্যমে সনদপত্র প্রদান করা হয়।
পরে আরও বৃহৎ পরিসরে কাজ করার জন্যে বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞদের নিয়ে টিম গঠন করতে শুরু করেন তারা।
বাংলা অটোমোবাইল স্কুল থেকে বাংলা অটোমোবাইল স্কিলস
সাল ২০১৩। অটোমোবাইল নিয়ে কিছু করার স্বপ্নের দিকে মাসাঈদের প্রথম পদক্ষেপ। নিজ আগ্রহে যতটুকু জানতে পেরেছেন তা কাজে লাগিয়ে তিনি ভিডিও তৈরি করতে শুরু করেন। এই ভিডিওর উদ্দেশ্য ছিলো মানুষকে অটোমোবাইল সম্পর্কে জানানো। এজন্যে তিনি প্রাথমিকভাবে বেছে নেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক। একটি পেইজের মাধ্যমে চলছিলো তার এই কার্যক্রম। পেইজের নাম দিয়েছিলেন 'বাংলা অটোমোবাইল স্কুল'। প্রথম কন্টেন্ট প্রকাশের পরই মানুষের সাড়া পেতে শুরু করেন তিনি। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ের বর্ণনা নিয়ে আসতে থাকে নতুন নতুন ভিডিও।
প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে এই নামেই। এরপর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গিয়ে সেই নামের পরিবর্তন করে প্রতিষ্ঠানটি। নাম দেওয়া হয় 'বাংলা অটোমোবাইল স্কিলস'। আগের থেকে শক্তিশালী কাঠামো ও সুন্দর সব কোর্স নিয়ে এবারে নতুন নামে নতুন যাত্রা শুরু হয় প্রতিষ্ঠানটির। এখন এই নামেই সকলের কাছে বেশি পরিচিত প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সহযোগী টিউটোরিয়াল
অনলাইনে প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী নাসিমুল ইমন দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় অটোমোবাইল কোম্পানীতে চাকরি করছেন। তিনি বাংলা অটোমোবাইল স্কুলের কোর্সগুলোতে যা জানতে পেরেছেন তা কর্মক্ষেত্রে যোগদানের সময় মৌখিক ও লিখিত পরীক্ষায় শতভাগ সাহায্য করেছে।
এছাড়াও তাদের নিয়মিত দর্শকদের একজন ছিলেন কলকাতার এক বাঙালি। তিনি ইন্ডিয়ান আর্মির যানবাহন বিভাগের একটি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। সেখানে 'বাংলা অটোমোবাইল স্কিলস' এর ভিডিও টিউটোরিয়াল থেকে শেখা বিষয়াদি কমন পাওয়ার দাবি করেছেন। পলিটেকনিকের বিভিন্ন পরীক্ষায়ও কমন পড়ছে এর টিউটোরিয়াল থেকে, দাবি প্রতিষ্ঠানের।
চলছে টিমওয়ার্ক
মেহরাব মাসাঈদ হাবিবের সাথে এই প্রতিষ্ঠানকে সামনে এগিয়ে নেবার লক্ষ্যে কাজ করছেন বাংলাদেশ-সুইডেন পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের সাবেক শিক্ষার্থী পিয়াল বড়ুয়া। তিনি প্রতিষ্ঠানের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। তার নিজের রয়েছে অটোমোবাইল সম্পর্কিত আরও একটি প্রতিষ্ঠান 'অটোমোবাইল পাঠশালা'।
পাশাপাশি রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের দায়িত্বে আছেন শ্বাশ্বত বড়ুয়া। এছাড়াও রিসার্চ এক্সিকিউটিভ হিসেবে আছেন ইব্রাহিম খলিল অপূর্ব, অর্ণব দত্ত, জয় বর্মণ সাগর। শফিউল আলম শুভ কাজ করছেন বিজনেস ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে এবং সিস্টেম ডেভেলপার হিসেবে কাজ করছেন মো. আসিমুজ্জামান।
কোর্সসমূহ
বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে মোট চারটি কোর্স করানো হয়। কোর্সগুলো হলো- সবার জন্য মোটরসাইকেল মেইন্টেন্যান্স, বেসিক অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, কার ডিজাইন কোর্স এবং সেলফ ড্রাইভিং গাড়ির অ, আ, ক, খ। এই কোর্সগুলো নামমাত্র মূল্যে অফার করে থাকে তারা। একবারের সাবস্ক্রিপশনে দেখা যাবে আজীবন! আগামী মাসে আরও কয়েকটি কোর্স আসবে বলেও জানান প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা মেহরাব মাসাঈদ হাবিব। সেগুলোর মধ্যে থাকছে হাইব্রিড ভেহিকল, সেলপ ড্রাইভিং কারসহ আরও নানা বিষয়।
দেশ-বিদেশের বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি করা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তারা অটোমোবাইল সম্পর্কিত বিভিন্ন নতুন নতুন কোর্স ডিজাইন করছেন। শীঘ্রই তাদের সেই কোর্সগুলোও ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে। এছাড়াও কয়েকটি টেকনিক্যাল কোম্পানির সাথে প্রতিষ্ঠানটির কথা হয়েছে। দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ভিত্তিতে তারা কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অটোমোবাইল সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ দিবেন।
লক্ষ্য
এখানে শুধুমাত্র কারিগরি বিষয়ই শেখানো হয় না। অটোমোবাইল শিল্পে যেসব সফট স্কিলের প্রয়োজন রয়েছে সেসবও শেখানোর পরিকল্পনা তাদের। অটোমোবইল সম্পর্কে কারও কিছু জানার থাকলে সে যেন এই প্রতিষ্ঠানেই আসে, সে কথা মাথায় রেখে সাজানো হবে প্রতিষ্ঠানটির কোর্সগুলো।
এ শিল্পে এখনও যে অনেক বাঙালি কাজ করে তা বলার সুযোগ নেই। কোম্পানির লক্ষ্য তাই এর মাধ্যমে বাংলাভাষীদের অটোমোবাইল সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়া, যাতে করে তারা বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজের সুযোগ পায় এবং নিজেদের প্রমাণ করতে পারে।