অবৈধভাবে কত টাকা নিচ্ছে বিদেশি কর্মীরা
বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশিরা প্রতি বছর অবৈধভাবে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে বলে গবেষণায় জানিয়েছে দুর্নীতি বিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
বুধবার প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলছে, বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগ্রহ করা তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে বৈধ ও অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশির সংখ্যা কমপক্ষে আড়াই লাখ। এর বড় অংশই কর ফাঁকি দিচ্ছে।
টিআইবির ভাষ্য, বিদেশিদের কেউ কেউ অবৈধভাবে বাংলাদেশে কাজ করে কোনো কর না দিয়ে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে প্রতি বছর বাংলাদেশ সরকারের প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।
দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বৈধভাবে প্রেরিত অর্থ ৫৪.৮১ কোটি টাকা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে সম্পদ বিবরণী দিয়েছে ৯ হাজার ৫০০ জন বিদেশি। বিপরীতে আয় দেখানো হয়েছে ৬০৩ কোটি টাকা।
বিদেশিদের টাকা পাঠানোর বিষয়ে সরকারি কোনো সংস্থার কাছেই সঠিক পরিসংখ্যান নেই।
টিআইবি বলছে, বিদেশি নাগরিকদের নিয়োগ ও চাকরি করার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অভাব ও নীতিমালা বাস্তবায়নের নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ না থাকায় এমন ঘটনা ঘটছে।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “বিশ্বের প্রায় সব দেশেই বিদেশি কর্মীদের নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ রয়েছে। বাংলাদেশে আইন থাকলেও সুনির্দিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। ফলে যে যেভাবে ইচ্ছে বিদেশিদের নিয়ে এসে তাদের প্রতিষ্ঠানে কাজ করাচ্ছে।”
দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটির গবেষণায় বলা হয়, বিদেশি নাগরিকরা যেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন, সেখানে তাদের প্রকৃত বেতন গোপন করা হচ্ছে।
গার্মেন্টস খাতে কর্মরত বিদেশিদের উদাহরণ তুলে ধরে টিআইবি বলেছে, একজন বিদেশি নাগরিক সিইও হিসেবে প্রতি মাসে আট থেকে নয় লাখ টাকা বেতন পেলেও কাগজপত্রে সেটি দেখানো হচ্ছে এক থেকে দেড় লাখ টাকা।
বাংলাদেশের বিভিন্ন সংস্থায় বৈধ ও অবৈধভাবে কাজ করা বিদেশি নাগরিকদের প্রকৃত বেতন গোপন করার ক্ষেত্রে তাদের নিয়োগকারী সংস্থা সহায়তা করার কারণে রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে বলে দাবি টিআইবির।
সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশে প্রায় আড়াই লাখ বিদেশি কাজ করে। তবে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই সংখ্যাটি অনুমান করা হলেও প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে।
টিআইবির গবেষণার ফল
বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে কাজ করা বিদেশি কর্মীদের সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক তথ্য না থাকলেও টিআইবির গবেষণা অনুযায়ী সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বিদেশি কর্মী কাজ করে তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল খাতে।
এ ছাড়া বিভিন্ন সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, আন্তর্জাতিক এনজিও, হোটেল ও রেস্তোরাঁর মতো খাতে বিদেশি কর্মীরা কাজ করে থাকেন।
বাংলাদেশে বিদেশি কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো সমন্বিত ও কার্যকর কৌশলগত নীতিমালা না থাকায় এই ধরনের নিয়োগের ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো সুনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষও নেই। ফলে বিদেশি কর্মীদের আসা-যাওয়ায় নজরদারি রাখা, নিয়োগ প্রক্রিয়ার বৈধতা পরীক্ষা এবং অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে নিয়ম-বহির্ভূত অর্থ লেনদেনের অভিযোগ উঠে থাকে।
২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালের তথ্য নিয়ে চালানো গবেষণার ভিত্তিতে টিআইবি বলছে, বাংলাদেশে অন্তত ৪৪টি দেশের প্রায় আড়াই লাখ বিদেশি নাগরিক কাজ করেন।
অবৈধভাবে কীভাবে বিদেশিরা চাকরি করছেন
টিআইবির গবেষণা অনুযায়ী, ভিসা নীতি লঙ্ঘন করার মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ বিদেশি কর্মী অবৈধভাবে বাংলাদেশে কাজ করে। অনেক বিদেশি নাগরিক সাধারণত ট্যুরিস্ট ভিসা বা অন অ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং পরবর্তী সময়ে কাজ করার অনুমতি না নিয়েই চাকরিতে যোগ দিয়ে কাজ করতে থাকেন।
অনেক ক্ষেত্রেই তারা যেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, সেসব প্রতিষ্ঠানের নথিপত্রে বিদেশি কর্মীদের উল্লেখ থাকে না। আয়কর ফাঁকি দিতে বৈধভাবে কাজ করা বিদেশি কর্মীদের বেতনও প্রকৃত বেতনের চেয়ে অনেক কম দেখানো হয়।
এ ছাড়া প্রকৃত বেতনের একটি অংশ বৈধভাবে দেওয়া হলেও সিংহভাগই অবৈধভাবে নগদ দেওয়া হয়ে থাকে।
অবৈধভাবে কাজ করা কর্মীদের পুরো বেতনই নগদ অথবা অন্য কোনো দেশের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দেওয়া হয়ে থাকে। এ ছাড়া কর্মীদের হাতখরচ, আবাসন, পরিবহন ও অন্যান্য সুবিধা দেওয়া হয়ে থাকে বলেও উঠে এসেছে টিআইবির গবেষণায়।
বিদেশি কর্মীর সংখ্যা নিয়ে টিআইবির ব্যাখ্যা
গবেষণায় টিআইবি বলছে, প্রতি বছর ৮ লাখ বিদেশি পর্যটন ভিসায় বাংলাদেশে আসে। এর মধ্যে ৫০-৬০ শতাংশ কাজের উদ্দেশ্যে আসে।
হিসাব অনুযায়ী চার লাখ বিদেশী কর্মী থাকার কথা থাকলেও পর্যটন ভিসার মেয়াদ তিন মাস হওয়ায় এ সংখ্যা কম। প্রত্যেক কর্মীকে তিন মাস অন্তর ভিসা নবায়ন করতে হয়। এমন কর্মীর প্রকৃত সংখ্যা ১ লাখ ৬০ হাজার। এর সঙ্গে বৈধভাবে কর্মরত ৯০ হাজার যোগ করলে এর সংখ্যা দাঁড়ায় আড়াই লাখ।
সরকারি তথ্য
বিদেশি কর্মীর সংখ্যা, তাদের বেতন কাঠামো ও অবৈধভাবে প্রেরিত অর্থ সম্পর্কে তথ্য নেই সরকারের কোনো সংস্থার কাছে। গত ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত তথ্যে স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশে বৈধ বিদেশি কর্মী ৮৫ হাজার ৪৯৬ জন।
২০১৭ সালের শেষ দিকে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশে বৈধ-অবৈধ মিলে ২ লাখ বিদেশি কর্মী রয়েছেন।