অর্থ সংকটে ব্যাহত হচ্ছে বেড়িবাঁধ মেরামত
উপকূলীয় সমুদ্রতীরবর্তী প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ জেলা বরগুনা। এ জেলার বুকচিড়ে বয়ে গেছে খরস্রোতা পায়রা ও বিষখালী নদী। যা জেলার ছয়টি উপজেলাকে বিচ্ছিন্ন করেছে তিন ভাগে। এছাড়াও এ জেলা থেকে সুন্দরনকে পৃথক করেছে বলেশ্বর নদী। আর সমুদ্রের তীরজুড়ে রয়েছে পাথরঘাটা ও তালতলী উপজেলা।
প্রায় প্রতিবছরই বরগুনায় আঘাত হানে কোন না কোন ঘূর্ণিঝড়। নড়বড়ে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে প্লাবিত হয় সহস্র একর ফসলী জমি। জলোচ্ছ্বাসের স্রোতে ভেসে যায় শত শত মাছের ঘের। মুখ থুবড়ে পড়ে জেলার কৃষি ও মৎস্য খাত। নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ। যুগ যুগ ধরে চলা প্রকৃতির এমন নিষ্ঠুরতার পরও জেলায় মজবুত ও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় ক্ষুব্ধ এ জেলার মানুষ।
সদর উপজেলার ডালভাঙা গ্রামের বৃদ্ধ হাসেম মিয়া বলেন, বন্যার আগে বেড়িবাঁধের কেউ খবর নেয় না। বন্যা আসলেই তখন বেড়িবাঁধের খোঁজ নিতে আসে। তিনি বলেন, বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ থাকায় পানি ঢুকে প্রতিবছর আমাদের ফসল নষ্ট হয়। ঘরসহ আসবাবপত্র ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বেড়িবাঁধ নিয়ে এরকম তামাশা আমাদের সাথে আর কতকাল চলবে?
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ফনির প্রভাবে বরগুনার সাড়ে ২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যা সংস্কার করতে ব্যয় হয় নয় কোটি ৮৮ লাখ টাকা। জরুরী ভিত্তিতে এ কাজ পানি উন্নয়ন বোর্ড সমাপ্ত করার পর দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত এ কাজের মাত্র ৪০ ভাগ বিল পেয়েছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো।
এরপর ঘূর্ণিঝড় বুলবুল এর প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় আট কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। যা সংস্কার করতে ব্যয় ধরা হয় চার কোটি তিন লাখ টাকা। কিন্তু এতে বরাদ্দ দেয়া হয় দুই কোটি ৫৮ লাখ টাকা। চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ না পাওয়া ঠিকাদারদের কাজে দেখা দেয় ধীরগতি। তারপরেও নানা ভাবে ঠিকাদারদের চাপ প্রয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধের মধ্যে ৬০ ভাগ বেড়িবাঁধ সংস্কার করেছিল জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আগে সম্ভব হয়নি বুলবুলের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কার করা।
বরগুনার পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার বিভিন্ন সময় কাজ করেছেন ঠিকাদার মোঃ মাইনুদ্দিন আসাদ।
তিনি বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ করলে সেই বিল পেতে দুই থেকে আড়াই বছর পর্যন্ত লেগে যায়। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে যেসব বেড়িবাঁধ নির্মাণ করার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়, সেসব কাজে ঠিকাদারদের কোন আগ্রহ নেই।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম সোহাগ বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পানে জেলার ২১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আংশিক ভেঙ্গে গেছে। পুরোপুরি ভেঙ্গে গেছে প্রায় ২০০ মিটার বেড়িবাঁধ। এতে জেলার ৬টি উপজেলার ৮২টি স্থানে বেড়িবাঁধের ক্ষত হয়েছে; যা মেরামত করতে ২০ কোটি টাকার প্রাক্কলন ব্যয় ধরা হয়েছে।
তিনি বলেন, জেলার প্রধান তিনটি খরস্রোতা নদী বিষখালী, পায়রা ও বলেশ্বরসহ বঙ্গোপসাগরের পানি থেকে সদর উপজেলাসহ ছয়টি উপজেলাকে নিরাপদ রাখতে মোট ৮০৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের আগেই ২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ছিলো ঝুঁকিপূর্ণ।
প্রকৌশলী সোহাগ আরো বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ পরিদর্শনে ইতোমধ্যেই মাঠে নেমেছেন চিফ মনিটরিং কর্মকর্তা প্রকৌশলী কাজী তোফায়েল। বর্তমানে তিনি পটুয়াখালী জেলার ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ পরিদর্শন করছেন। এরপর তিনি বরগুনা এসে বরগুনার ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধগুলো পরিদর্শন করবেন। এরপর আমরা এই বেড়িবাঁধের সংস্কার কাজ শুরু করব।
পাথরঘাটা উপজেলার বলেশ্বর নদীর তীরবর্তী কাঠালতলী ইউনিয়নের ইউপি সদস্য মনমথ রঞ্জন খরাতী বলেন, এই ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের বেড়িবাঁধ ভেঙে চারটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে এই দুই গ্রামের মাছের ঘের প্লাবিত হয়ে অন্তত ৩০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও চর গ্রামের অন্তত দুইশ' একর জমির ফসল সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়ে নষ্ট হয়ে গেছে।
বরগুনা সদর উপজেলার আয়লা পাতাকাটা ইউনিয়নের জাঙ্গালিয়া গ্রামের কৃষক হাবীব হাওলাদার বলেন, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে আমাদের এখানের বেড়িবাঁধ ভেঙে ফসলের ক্ষেত মাছের ঘের তলিয়ে যায়। তখন আমাদের এই এলাকার কৃষকদের কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়। এবার ঘূর্ণিঝড় আম্পানেও এই একই অবস্থা হল।
তিনি বলেন, আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি- আমাদের সরকারি সহযোগিতা দরকার নেই। আমাদের টেকসই বেড়িবাঁধ দরকার। কিন্তু আমাদের এ কথা কখনো কারো কানে পৌঁছায়নি। তাই প্রতি বছরই আমাদের সর্বস্বান্ত হতে হয়।
বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ফাতিমা পারভীন বলেন, পাথরঘাটা উপজেলার অধিকাংশ বেড়িবাঁধ এখন ঝুঁকিপূর্ণ। টেকসই এবং মজবুত বেড়িবাঁধের জন্য পাথরঘাটার ১০ হাজার স্থানীয় অধিবাসী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি স্মারকলিপি দিয়েছিলেন। এরপর পাথরঘাটায় পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল বেড়িবাঁধ সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ এর জন্য। কিন্তু পাথরঘাটা উপজেলায় টেকসই এবং মজবুত বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য এই অর্থ পর্যাপ্ত ছিল না।
তিনি আরো বলেন, পাথরঘাটা উপজেলাকে সুরক্ষিত রাখতে আমরা দীর্ঘদিন ধরে টেকসই বেড়িবাঁধ এর জন্য নানা প্রচেষ্টা চালিয়েছি। কিন্তু আমাদের প্রচেষ্টা সফল হয়নি। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবেও আমাদের এলাকার কৃষি এবং মৎস্য খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এজন্য নাজুক বেরিবাধ দায়ী। মূলত ঘূর্ণিঝড়ের পরবর্তী সময় ছাড়া বেড়িবাঁধের কেউ কোনো খোঁজ-খবর নেয় না বলেও জানান তিনি।
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন বরগুনা জেলা শাখার সভাপতি জাকির হোসেন মিরাজ বলেন, উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ঘূর্ণিঝড়ে যে ক্ষতি হয় তার থেকে অন্তত দশগুণ বেশি ক্ষতি হয় জলোচ্ছ্বাসে। তাই উপকূলীয় এলাকায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা আমাদের কয়েক যুগের দাবি। কিন্তু জনসাধারণের জন্য কল্যাণকর এ দাবি আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি।
তিনি বলেন, সামনে ঝড়ের মৌসুম। কিছুদিনের মধ্যেই ছোট বড় কোন না কোন ঝড় আবার হানা দেবেই। তার আগেই যদি ভাঙ্গা বেড়িবাঁধগুলো জরুরি ভিত্তিতে মেরামত না করা হয় তবে স্বাভাবিক জোয়ারের আঘাতেও সেসব ভাঙ্গা বেড়িবাঁধ আরও ভাঙতেই থাকবে। আর এভাবে বেড়িবাঁধ ভাঙতে থাকলে সরকারের শত কোটি টাকা গচ্ছা যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী কাইসার আলম জানান, অর্থসঙ্কটের কারণে আমাদের বেড়িবাঁধ মেরামত এবং সংস্কার বেশ ব্যাহত হচ্ছে। বরগুনার বেড়িবাঁধগুলোকে টেকসই এবং মজবুত রাখতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তা আমরা কখনই পাচ্ছি না। আমাদের শুধু অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে জরুরি মুহূর্তে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ মেরামত ও সংস্কারের জন্য।
তিনি বললে, কাজ শেষ করার পরও আমাদের কাছে বিভিন্ন ঠিকাদারদের প্রায় ১০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এ পাওনা টাকা পরিশোধের বরাদ্দও পাচ্ছি না আমরা। এছাড়াও বিভিন্ন সময় আমরা বেড়িবাঁধ মেরামতের জন্য অর্থ বরাদ্দ চেয়ে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় আমরা টেকসই বেড়িবাঁধ মেরামত করতে পারছি না।
ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ সংস্কারের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত এই ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের মেরামতের অনুকূলে কোনো বরাদ্দ পাইনি। তাই উপকূলীয় জনপদ রক্ষার জন্য বকেয়া বিলের মাধ্যমেই এই বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার কাজ শুরু করব।