অস্তিত্ব টেকানোর লড়াইয়ে দেশের সার্কাস মালিকরা
সার্কাস, বাংলা লোকসংস্কৃতির একটি ঐতিহ্যবাহী বিনোদন মাধ্যম। অধুনাবিলুপ্ত বিনোদনের এই মাধ্যমটি একসময় লোকজীবনের সৃজন ও মননচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও, সময়ের পরিক্রমায় তা আবেদন হারিয়েছে। কোভিড পরিস্থিতিতে এই শিল্পকে মুখোমুখি হতে হয়েছে আরো কঠিন বাস্তবতার। প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এখন অস্তিত্ব টেকানোর লড়াইয়ে দেশের সার্কাস মালিকরা।
সার্কাস মালিকেরা বলছেন, একটি দল পরিচালনা করা বেশ ব্যয়বহুল কাজ। আবার চাইলেও সার্কাসের দল গঠন করা যায়না। যাত্রা বা পুতুলনাচের মতো সহজ নয় এর প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া। এর জন্য দরকার হয় বহু বছরের সাধনার। প্রয়োজন পড়ে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার মিশেলে তারুণ্য ভরা দল। কোভিডকালে ঘরবন্দী জীবনে প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনী থেকে দূরে থাকায় নিদারুণ সংগ্রামে চলছে তাদের জীবন।
বাংলাদেশ সার্কাস মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, দেশে তালিকাভুক্ত মোট সার্কাস দল রয়েছে ২৫টি। এতে কর্মসংস্থান হয়েছে ৫ হাজারের মতো মানুষের। তবে সমিতিভুক্ত এই ২৫ দল ছাড়াও দেশে শতাধিক দল রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ২০ হাজার লোক এখনো এই পেশায় জড়িত।
দেশ যে দলগুলো নিয়মিত সার্কাস প্রদর্শনের করছে তার মধ্যে রয়েছে-দি রায়হান সার্কাস, দি বুলবুল সার্কাস, দি গ্রেট রওশন সার্কাস, দি রাজমনি সার্কাস, দি রয়েল বেঙ্গল সার্কাস, দি সোনার বাংলা সার্কাস, সেভেন স্টার সার্কাস, দি ক্যাপিটাল সার্কাস ও দি লায়ন সার্কাস।
দি গ্রেট রওশন সার্কাসের কর্ণধার শেখ আফতাব উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'জমানো যা টাকা-পয়সা ছিল, তা আরও মাস তিনেক আগেই শেষ করে ফেলেছি। এখন বেশ বাজে অবস্থায় দিন পার করছি। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে'।
এদিকে বেশ কয়েকটি দল ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে কাজ করলেও সময়ের পরিক্রমায় জৌলুস হারিয়ে বহু সার্কাসের দল বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ সার্কাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহিনুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'প্রায় ১১ মাস ধরে সার্কাস বন্ধ। আমাদের পেশা বলতে এটাই। দেশে এখন সবকিছুই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে। তাই আমরাও একইভাবে সার্কাস প্রদর্শনের অনুমতি চাই'।
তিনি বলেন, 'আমার বাবা পাকিস্তান আমল থেকে সার্কাস প্রদর্শনের কাজ করতেন। তারই ধারাবাহিকতায় পেশা হিসেবে আমিও সার্কাস প্রদর্শনকে বেছে নিয়েছি। চাইলেই এখন অন্য কোনো পেশায় সামাজিক কারণে যেতে পারি না'।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, প্রশিক্ষণ না থাকা এবং আরও নানান কারণে সার্কাস দলগুলো গভীর সংকটে পড়েছে। আর সার্কাস মালিকেরা বলছে, যুগোপযোগী হতে না পারাটাও তাদের ব্যর্থতা।
এ ছাড়া অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোনো কোনো দলের মালিক নাম ও আঙ্গিক পরিবর্তন করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। এতে এগুলোর মূল আঙ্গিকে বিকৃতি ঘটছে বলে মনে করছে সার্কাস মালিক সমিতি।
দীর্ঘদিন ধরে সার্কাস নিয়ে অনুসন্ধান ও গবেষণা করছেন লোকগবেষক বাংলা একাডেমির সহ-পরিচালক সাইমন জাকারিয়া। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'সার্কাসের ঐতিহ্যবাহী দলগুলো এখন অস্তিত্বসংকটে। সার্কাস মালিকদের যে সমস্যাটির জন্য জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, তা হলো আয়োজনের জন্য প্রশাসনিক অনুমোদন পাওয়া। আরেকটি বিষয়টি হলো, সময়ের সঙ্গে তালমিলিয়ে চলতে না পারা। আর কোভিড পরিস্থিতি অন্য দশটি পেশায় যেভাবে আঘাত হেনেছে, তাদের বেলাতেও তাই ঘটেছে। সংকট সমাধানে দায়িত্বশীলদের যথাযথ ভূমিকা নেওয়া জরুরি'।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশে সার্কাসের দলগুলো মূলত পরিবারকেন্দ্রিক। একজন মূল মালিক থাকেন। তার পরিবার, জ্ঞাতিগোষ্ঠীদের নিয়েই দল গড়ে ওঠে। বিশাল তাঁবু ফেলতে হয়, অনেক সরঞ্জাম আনতে হয়। বিশালাকার গ্যালারিও নিজেদেরই বসাতে হয়। ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন স্থানে সার্কাসের আয়োজন করতে হলে একটি স্থানে অন্তত ১৫ দিন প্রদর্শনী না করলে লোকসানে পড়তে হয়।
সার্কাস মালিকেরা বলছেন, সার্কাসের জন্য হাতি, বাঘসহ নানা রকম প্রাণীও প্রয়োজন। এসব প্রাণী রাখার অনুমোদন পাওয়া যায় না। এ কারণেও সার্কাসের জনপ্রিয়তায় অনেকটা ভাটা পড়েছে।