তারা একইসঙ্গে সার্কাসের জোকার, জাগলার, ম্যাজিশিয়ান, আবার অন্য কিছু!
চার ফিট লম্বা পা, পরনে লাল-সবুজ-হলুদ পায়জামা- গেঞ্জি, মাথায় সোনালী লম্বা টুপি। বিশাল লম্বা এই মানুষটি মাঠের মধ্যে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। যেমন অদ্ভুত তার উচ্চতা, তেমন অদ্ভুত তার পোশাক। ছোটোরা তার দিকে ছুটে যাচ্ছে, কেউ হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে কোলে ওঠার জন্য, কেউ আবার কাছে গিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে আছে লম্বা সে মানুষটির দিকে। এমন একজন মুনতাহা, বয়স চার। সে ভাবছে, সত্যিই কি এত লম্বা হয় মানুষ?
এই লম্বা মানুষটির নাম মনির। মুনতাহার জন্মদিনে সে 'রনোপা' সেজেছে। লম্বা দুই লাঠির ওপর ভর দিয়ে হাঁটাকে বলে রনোপা। মুনতাহার জন্মদিনের মতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মনির রনোপা সেজে যায়। নানারঙের কাপড়চোপড় আর চার ফিট লাঠির ওপর দাঁড়িয়ে শিশুদের আনন্দ দিয়েই নিজের জীবিকা চালিয়ে যাচ্ছেন ৪৯ বয়সী মনির। নাম মোহাম্মদ মনির হলেও, কাজের দুনিয়ায় সবাই তাকে 'জোকার মনির' নামেই চেনে। বিশ বছর থেকে এ কাজের সঙ্গে জড়িত মনির।
যখন বায়োস্কোপে গান গাই, বাচ্চারা আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকে
তবে শুধু রনোপাই নয়। বায়োস্কোপে গান গেয়ে, ম্যাজিক দেখিয়ে, বেলুন শুট করে মানুষকে আনন্দ দিয়ে থাকেন 'জোকার মনির'। এরমধ্যে তিনি নিজে ভালোবাসেন ম্যাজিক দেখাতে। মাটি থেকে চকলেট, মিষ্টি মুড়ি, কাগজ দিয়ে টাকা, ছেঁড়া কাগজ দিয়ে ফুল, এক রঙের ফুলকে চার পাঁচ রঙের ফুল বানিয়ে শিশুদের চমকে দিতে ভালোবাসেন মনির।
কিন্তু মনির জানান, দর্শকের চাহিদা বেশি রনোপাতে। বাচ্চারা বেশি মজা পায় এতে। অনেকে যেমন ভয় পেয়ে যায়, অনেকে আবার মুনতাহার মতো কোলে উঠতে চায়, একটু ছুঁয়ে দেখতে চায়, হাত মেলাতে চায়। মনির বলেন, 'বড়লোকের পোলাপানরা হাত বাড়ায় দেয়, ওদের কোলে নিই। ছয়-সাত বছরের হলে তো কোলে নিয়ে দাঁড়ানো যায় না, এর চেয়ে ছোটো হলে পারা যায়। ভয় পেয়ে অনেকে চিৎকারও দেয়।'
'আবার যখন বায়োস্কোপে গান গাই, বাচ্চারা আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। আমি বলি, কপালে হাত দিয়া একচোখ বন্ধ করে দেখো। কিন্তু তারা মুখের দিকেই চেয়ে থাকে। হয়তো জোকারের পোশাক পরে থাকি বলে তাকায় মজা পায় বাচ্চারা।
একেক কাজের জন্য একেক পোশাক। রনোপার জন্য ঢোলাঢালা ফতুয়া-পায়জামার তিন সেট কাপড়। ম্যাজিশিয়ানের জন্য আছে দু ধরনের কাপড়- একটি 'স্মার্ট ড্রেস' (ফরমাল পোশাক), অপরটি 'জোকার ড্রেস' (যেটা লাল-নীল-সবুজ-হলুদ বিভিন্ন রঙের হয়, মাথায় নানা রঙের চুল, গোল লাল নাক, মুখে মেকাপ)। বায়োস্কোপের জন্যও একইরকম জোকার পোশাক।
আলগা চুল, জামা, রঙিন চশমা, নাক এসব কিছু তৈরি থাকে তার। যখন যেটা লাগে সে অনুযায়ী নিজেকে সাজিয়ে নেন। ম্যাজিকের জন্য দুইটা আর রনোপার জন্য তিনটে মোট পাঁচ সেট জামা আছে তার।
তবে রনোপা করতে গিয়ে লাঠির ওপর থেকে পড়ে গিয়ে প্রায় চার-পাঁচ বছর বন্ধ ছিল কাজ। কারওয়ান বাজার থেকে ফল এনে বিক্রি করেছেন, দিনমজুরের কাজ করেছেন। কিন্তু দেখলেন, মানুষ তাকে ডাকে বিভিন্ন কাজে। তখন মা কে বুঝিয়ে আবার কাজ শুরু করেন।
শীতের চার মাস কাজ থাকে, বাকি মাস অন্য কাজ করেন
ছোটোবেলায় গাজী কালুর নাটক আর যাত্রা দেখতে ভালোবাসতেন মনির। একটু বড় হওয়ার পর যাত্রায় অভিনয়ও করতেন জোকার বা কমেডিয়ান সেজে। সেখান থেকেই জোকার পেশার প্রতি একটা ঝোঁক বাড়তে থাকে তার। বিভিন্ন মেলা, জন্মদিনের অনুষ্ঠান, কর্পোরেট বিভিন্ন আয়োজন, বিভিন্ন দিবসসহ বিয়েশাদির অনুষ্ঠানগুলোতে কাজ করে থাকেন মনির। কাজে ঝুঁকি থাকলেও এই কাজেই আনন্দ পান। নিজের কাজ দিয়ে যদি দশজন মানুষকে হাসানো যায়, তবে ক্ষতি কী। কাজের প্রতি ভালোবাসাটাই প্রধান তার কাছে।
তবে কাজ তার বারোমাস থাকেনা। শীতের চারমাস আসে কাজের অর্ডার। বিভিন্ন কোম্পানির অনুষ্ঠানে, জন্মদিন, গায়ে হলুদ, বিয়ে, বিভিন্ন মেলা, দিবসগুলোতে অর্ডার আসে। যেমন, কিছুদিন আগেই বিশ্ব খাদ্য দিবসে কাজ করেছেন। হোটেল ওয়েস্টিনে কাজ করে এসেছেন। এসব অর্ডারে দিন হিসেবে মজুরি পান। সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। একদিনে বায়োস্কোপ খেলার জন্য তিন হাজার, রনোপা হলে চার হাজার। জোকার ম্যাজিক পাঁচ হাজার, বেলুন শুটার তিন হাজার টাকা। ঢাকার বাইরে যেতে হলে মালবহনের খরচ দিতে হয়। যেমন ঢাকার বাইরে রনোপা করলে দিনে সাত হাজার হিসেব করা হয়। থাকা, খাওয়া, আসা-যাওয়া তাদের। গতবছর আটদিন কাজ করে এসেছিলেন কক্সবাজার রয়্যাল হোটেলে, রনোপা আর বায়োস্কোপ দেখিয়েছিলেন।
নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী মাস হলো কাজের মৌসুম। তখন মাসে দশটারও বেশি আসে কাজের অর্ডার। বাকি আটমাস প্রায় বসেই থাকেন। তখন জোকার মনির হয়ে যান সবজি বিক্রেতা বা রিকশা চালক। তবে গরমের দিনে বেলুন শুটারের কাজটা চালাতে পারেন। গুলশান দুই নাম্বারের ওদিকে বসেন। দুপুরে নামাজ পড়ে বের হোন, সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেন। কোনো বিশেষ দিন থাকলে ৭০০-১০০০ টাকা নতুবা ১৫০-২২ টাকা পান এই বেলুন শুট করে।
এরশাদের আমলে জমজমাট ছিল মনিরের ব্যবসা, করোনার আগ পর্যন্ত ছিল মোটামুটি। করোনার পর দেড়-দুই লাখ টাকা ঋণ হয়ে যায়। কোরবানির ঈদ ছাড়া গরু খাওয়া হয় না। একবার একদিনে কাজ করে তিন হাজার টাকা পেয়েছিলেন, মেয়ে খুব বায়না ধরেছিল গরু খাওয়ার। তখন এক কেজি কিনে এনেছিলেন। শেষ গরুর মাংস খেয়েছেন তখনই। এছাড়া মাসে একবার চলে মুরগি। আর বাকিদিন শাকসবজি। মনির বলেন, 'একমুঠ ভাত বিসমিল্লাহ করে খাইলেও পেট ভরে যায়।' করোনার এক বছর আধা বেলা অটোরিকশা চালাতেন। তখন পড়ে গিয়ে কোমরে ব্যথা পান। সে চিকিৎসার পেছনেই ঋণ পড়ে যায় দুই লাখ টাকার মতো। যা বাপ-ছেলে মিলে ধীরে ধীরে শোধ করছেন।
টাকা নেই, তবে এ কাজে সম্মান আছে। কোনো পার্টিতে গেলে যখন বড় বড় লোকজনও ডেকে বলে, 'জোকার মামা, আপনিও আমার সাথে বসেন। তখন সম্মান লাগে,' জানান জোকার মনির।
সিনেমায় স্ট্যান্টম্যানের কাজও করেন
মোহাম্মদ রিবনের গোটা পরিবারই যুক্ত এ পেশার সাথে। তবে তারা জোকার বা ম্যাজিশিয়ান না। তারা সার্কাস খেলোয়াড়। আট বছর থেকে এ কাজের সাথে তার হাতেখড়ি। বর্তমানে বয়স ২৮, এরমধ্যেই চারজন নিয়ে নিজের একটি সার্কাস দল রয়েছে। রিবন মোট ২৫টি খেলা পারেন। কীভাবে ছয় বছরের শিশু হাড়গোড় ভেঙ্গে ফুটবল, ব্যাঙ, বাদুড় হয়ে যায়; এছাড়া স্ল্যাকলাইনিং, সাইক্লিং, অ্যাক্রোব্যাটিকস, ছুরির কসরত সহ আরো অনেক রকমের খেলা জানা আছে তার দলের। একেকজন একেক খেলায় পারদর্শী। ছোটোভাই, বড় ভাই, ছেলে পরিবারের সবাই এ কাজে যুক্ত।
তবে সার্কাসের অতীত সোনালী দিন মলিন হয়ে গেছে। স্বাধীনতাপূর্ব এবং উত্তরকালে গঠিত অধিকাংশ সার্কাস দল আজ আর নেই। করোনা মহামারি এসে আরও বিলুপ্তির পথে নিয়ে গেছে। এককালের অনেক সার্কাস খেলোয়াড়ই, যারা একসময় মেডেল বা সেরা খেলোয়াড়ে ভূষিত হয়েছেন, সবাই অন্য পেশায় চলে গেছেন। রিবন একেবারে চলে যাননি। দিনে মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কাজ করেন। এরপর আসরের আজানের পর আর সন্ধ্যার পর খেলা দেখাতে বের হোন। এতে একদিনে যেমন দু-তিন হাজার পান, তেমনি কখনো চার-পাঁচশো উঠাতেও কষ্ট হয়ে যায়। বিভিন্ন খোলা জায়গায়, রাস্তার ওপর একটু জায়গা পেলে গান গেয়ে গেয়ে লোকজন জড়ো করেন। এরপর খেলা দেখান। অনেক সময় পুলিশরা উঠিয়ে দেয়, টাকা দিলে আবার অনুমতি পান। রাস্তা, হাটবাজারে ছাড়া টেলিভিশন অনুষ্ঠানেও কাজ করেছেন রিবন ও তার দল। সিসিমপুর অনুষ্ঠান এবং সিনেমায় স্ট্যান্টম্যানের কাজ করে দশ থেকে বিশ হাজার টাকা উঠে আসে পুরো দলের।
শূন্যের ডিগবাজি দেখাতে গিয়ে দুর্ঘটনা
২০২১ সালের দ্য বিজনেস স্ট্যান্ড্যার্ডের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ সার্কাস মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, দেশে তালিকাভুক্ত মোট সার্কাস দল রয়েছে ২৫টি। এতে কর্মসংস্থান হয়েছে ৫ হাজারের মতো মানুষের। তবে সমিতিভুক্ত এই ২৫ দল ছাড়াও দেশে শতাধিক দল রয়েছে। সবমিলিয়ে প্রায় ২০ হাজার লোক এখনো এই পেশায় জড়িত। যারা নিজেরা নিজেরা ছোট ছোট দল তৈরি করে দেশজুড়েই ভ্রাম্যমাণ খেলা দেখিয়ে থাকে এখন।
এর শুরুটা সার্কাস কমিটির সভাপতি শংকর চন্দ্র মোদকের হাত ধরে। সার্কাস খেলোয়াড়দের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করেছিলেন তিনি। এ কারণে তাকে সার্কাস থেকে বহিষ্কার করা হয়। সাত-আট বছর কাজ ছাড়া ছিলেন। অনেক কষ্টে না খেয়ে খেয়ে জীবন কাটিয়েছেন। একসময় ঝালমুড়ি বিক্রি করে সংসার চালাতে শুরু করেন। তার ছেলে মিঠুন চন্দ্র মোদক নিজেও জড়িয়েছেন এই পেশায়। তার নিজস্ব একটি দল আছে ছোট। মিঠুন বলেন, 'বাবাকে যখন সার্কাস দলগুলো আর নিচ্ছিল না বিশেষ করে মালিকপক্ষগুলো, তখন বাবা শুরু করেন রাস্তায় খেলা দেখানোর। অন্যান্য সার্কাস খেলোয়াড়রাও তাই শুরু করেন। মালিকের অধীনে না থেকে ভ্রাম্যমাণভাবে রাস্তায় আলাদা খেলা দেখানো শুরু হয় তখন থেকেই।'
সাত বছর থেকে এই কাজের সঙ্গে জড়িত তিনি। এখন বয়স ৩৫। তার বাবা ৫৫ বছর সার্কাস দেখিয়েছেন। মিঠুন ও তার দল ২৫টি খেলা পারেন। দলে আছেন চারজন। তিন-চার ঘণ্টা খেলা দেখানোর পর ৬-৭ হাজার টাকা পান। সেটা ভাগাভাগি করে নেন দলের বাকি চারজন। সার্কাস ছাড়া আর কিছু কাজ জানা নেই তার। দৈনিক দুটো করে শো হয় তার- আসরের নামাজের পরে দেড় ঘণ্টা আর মাগরিবের নামাজের পর দেড় ঘণ্টা। বাবুবাজার, নিউমার্কেট, চাঁদনি চক, বাদামতলী, কারওয়ান বাজার, চকবাজার, মিরপুর, হেমায়েতপুর মাঠঘাট যেখানে আছে সব জায়াগায় খেলা দেখিয়েছেন। এ কাজ করেই দৈনিক এক থেকে দেড় হাজার কামান। অর্ডার এলে কী খেলা, তার ওপর নির্ভর করে টাকার হিসেব করেন। যেমন, গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে তিনজনের প্রোগ্রামে দশ হাজার। জনপ্রতি দিন হিসেবে তিন হাজার করে নেন।
তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে তিনবার খেলা দেখিয়েছেন। তবে জানান, গ্রামগুলোতে তিনশো-চারশো দর্শক হয়ে যায় অনায়াসে। শহরে একটু কম। একবার ঢাকার নিউমার্কেটের পোস্ট অফিসের সামনে শূন্যে ডিগবাজি দেখাতে গিয়ে পা উপরে মাথা নিচে দিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। গুরুতর আহত হয়েছিলেন সেবার। দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ ছিল।
কেরানীগঞ্জের শিকারীটোলা গ্রাম থেকেই সার্কাস খেলার উৎপত্তি
সার্কাসের এসব খেলার প্রশিক্ষণ ছয় থেকে দশ বছরের মধ্যেই শুরু হয়ে যায়। ১৬-১৮ বছর বা ২০ হয়ে গেলে এসব কসরত আর আয়ত্ত করা যায়না। সুমা মোদক দশ বছর বয়সে বাবার থেকেই প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। তার বাবা শিখেছিলেন তার দাদার থেকে। সুমা যে গ্রামে থাকেন, সে গ্রামের নাম শিকারীটোলা। কেরানীগঞ্জের শিকারীটোলা গ্রাম থেকেই সার্কাস খেলার উৎপত্তি। এ গ্রামেই এখনো আছে ৪০০-৫০০ খেলোয়াড়। তারা সবাই সারাদেশ জুড়ে ছোটো ছোটো দলে ভ্রাম্যমাণ খেলা দেখান। কোনো খোলা জায়গা, মাঠঘাট, হাটে বাজারে জায়গা করে নিয়ে চালান জীবিকা নির্বাহ।
এ পথে দুই যুগ হয়ে গেছে তার। সার্কাস, জোকার, জাগলার সবই করেন। প্রায় দশ-বারোটার মতো খেলা পারেন সুমা। বাজারে বা হাটে যখন খেলা দেখাতে থাকেন, লোকজন এসে আপনাআপনি জড়ো হয়ে যায় তার চারপাশে। শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ছেলে-বুড়ো সবাই এক অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। "এমনও হয় লোকজন বাজার না করে দাঁড়ায় দাঁড়ায় খেলা দেখে। বা কেউ হয়তো পাশ দিয়ে যাচ্ছে, যাবার সময় চোখে পড়লো, দাঁড়ায় গেল। এই যে দাঁড়ায় গেল আধ ঘণ্টা এক ঘণ্টা পার হয়ে যায়, তাদের হুঁশ থাকেনা। তবে খেলা যদি জমাতে পারি তবেই", জানান সুমা।
নিজে তেমন পড়ালেখা করেননি। ছেলেরাও করেনি সেভাবে। বড় ছেলে সেলুনে কাজ করছেন। ছোটোছেলেকে লেখাপড়া করাবেন এমন আশাও নেই। তার মতে, "লেখাপড়া করার চেয়ে সংসারের হাল ধরা ভালো। লেখাপড়া টাকা থাকলে করা যায়।"
"শুধু খেলাই নয়, কথার জাদু থাকতে হয়, কথা যদি মানুষকে না টানে তবে নীরবে খেলা দেখেও বেশি দর্শক টানা যায়না", বলেন সুমা।
শাকিব খানের 'প্রিয়তমা' সিনেমায় কাজ করেছেন সুমা মোদক
ভ্রাম্যমাণ খেলা দেখানোর পাশাপাশি মাঝে মাঝে কাজের অর্ডারও আসে তার। তবে সে অর্ডার শীতকালে বেশি পান। বিভিন্ন কোম্পানির অনুষ্ঠানে, শিল্পকলায় কাজ করেছেন। তবে একবার সিসিমপুরে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। ভালো উপার্জনও এসেছিল। এছাড়া তিনটি সিনেমায় কাজ করেছেন। প্রিয়তমা, ভয়ংকর গোলমাল ও বনের রাজা টারজান। শেষ কাজ সাকিব খানের প্রিয়তমা সিনেমায়। সেখানে বল ঘুরানোর কাজে শুটিং করেছেন। এসব শ্যুটিংয়ের কাজে সারাদিনের জন্য পান দুই হাজার টাকা।
আগুনের ওপর ঝাঁপ দেয়া, জীবিত-মৃত খেলা, তীর-বর্শার খেলা, দড়ির ওপর হাঁটা, রশি দিয়ে এপাশ থেকে ওপাশে লাফ দেওয়ার মতো নানা খেলা খেলতে হয়। ঝুঁকিপূর্ণ হলেও মানুষ এসবেই আনন্দ পায় বেশি। তাই খেলতে গিয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা হলেও আমলে নেয় না তারা। কারণ এটাই তাদের বাপ-দাদাদের জীবিকা।
তবে কাজের চাহিদা অনেকটাই কমেছে। সুমা মোদক বলেন, "আগে মানুষের প্রতি মানুষের টান ছিল। বাবামায়েরা এসে ধরে নিয়ে যেত বাচ্চাদের। খেলা শেষ হবার পরও বয়স্করা বলতো, আরো দেখাও, আরও দেখাও। দর্শকরাই জিজ্ঞেস করে, আবার কবে আসবেন। বলি, আসব এক মাস পর আবার। তবে সবচেয়ে জমজমাট ছিল এরশাদের আমলে।"
সাড়ে পাঁচ ফিট লাঠির ওপর হাঁটেন
অন্যদের তুলনায় সোহেল রানা নবীনই বটে। কেবল আট বছর ধরে কাজ করছেন এ রাস্তায়। এক মেলায় গিয়ে ওস্তাদের থেকে কাজ শিখেছেন। খুব ভালো পারেন দু'হাতে তিনটি বল বা ছুরি ঘোরাতে। কিন্তু তাতে তেমন কিছু উঠে আসে না। কাজের ডাকের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। কোনো মাসে আসেইনা, কোনো মাসে পাঁচটা আসে। তাই দেশের বাড়িতে গিয়ে ইট-বালু টানার গাড়ি চালানো শুরু করেছেন। পাশাপাশি জোকার এবং জাগলারও তিনি। ছোটো ভাই বেকারীতে কাজ করেন, বাবা মাঠের কৃষক। কাজের অর্ডারে একবার মুন্সীগঞ্জে ওয়াটার পার্কে তিনদিন কাজ করেছেন। রনোপা, জাগ্লিং দেখিয়েছিলেন। হাতে এসেছিল সেবার আট হাজার টাকা। তবে সেটা দলের হিসেবে। মোহাম্মদ রিবনের দলে কাজ করেন তিনি। লেখাপড়া করেছেন পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। সার্কাস বা জোকার বা জাগলার সবই তার শখের কাজ। পাশাপাশি বাড়তি আয়ও হয়। রনোপায় তিনি হাঁটেন সাড় পাঁচ ফিট লাঠির ওপর, যা সবচেয়ে উঁচু। এছাড়া আরো চার-পাঁচটা খেলা পারেন। এই যেমন, এ পাড় থেকে ঐপাড়ে রশির ওপর ঝুলে গিয়ে অপরপক্ষে হাত ধরা, আগুন খেলা, আগুনের গোলা খাওয়া। ভবিষ্যতে ইচ্ছে পাঁচটা ফুটবল একসাথে ভারসাম্যে রাখা। দুই আঙ্গুলে দুটা, মাথার ওপর একটা, পায়ের নিচে একটা ...।
জোকার, খেলোয়াড় বা জাগলার প্রত্যেকেরই কাজ মানুষকে আনন্দ দেওয়া, মনের খোরাক জাগানো। বহু প্রাচীনকাল থেকেই রোম, মিশর, গ্রিসের বিভিন্ন শহরে সার্কাসের খেলা দেখানো হতো। তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে সার্কাস শুরু হয় রোমে সম্রাট জুলিয়াস সিজারের আমলে। আঠারো শতকের দিকে এসে সার্কাস জনপ্রিয় হতে থাকে ধীরে ধীরে। ভারতবর্ষে সার্কাস আসে ইংরেজদের হাত ধরে। এই সার্কাস বাংলা লোকসংস্কৃতির একটি ঐতিহ্যবাহী বিনোদন মাধ্যম। বিভিন্ন গ্রাম বাংলার মেলায়, পশুপাখি দিয়ে সার্কাস, বায়োস্কোপ, সাপ খেলার মতো নানা বিনোদনের উৎস থাকতো সাধারণ মানুষদের জন্য। প্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলে এবং সময়ের পরিক্রমায় এসব মনের খোরাক জাগানিয়া উপাদানগুলো আজ তাদের আবেদন হারিয়েছে। স্বাধীনতাপূর্ব এবং উত্তরকালে গঠিত অধিকাংশ সার্কাস দল আজ আর নেই। কোভিড পরিস্থিতিতে এই শিল্পকে মুখোমুখি হতে হয়েছে আরো কঠিন বাস্তবতার। সার্কাসের খেলোয়াড়রা লোক জড়ো করে মাঠেঘাটে টুকটাক খেলা দেখাতে পারলেও, বেগ পেতে হয় মনিরের মতো জোকার বা রনোপাদের। বিশেষ দিন এবং অর্ডারের দিকেই তাদের চেয়ে থাকতে হয়। তবে তারাও এখন জীবিকা নির্বাহের অন্য পথ খুঁজে নিয়েছে। এভাবেই এই শিল্প ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে...