আইসিইউ ফাঁকা নেই, মরিয়া হয়ে ছুটছেন স্বজনরা
করোনার সেকেন্ড ওয়েভের প্রকোপ বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়ে চলেছে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সংকট। প্রিয় মানুষকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় নিয়ে আইসিইউর সন্ধানে বহু মানুষ পাগলের মতো এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটে বেড়াচ্ছেন।
আইসিইউ খালি না থাকায় রোগীদের নিয়ে আতঙ্ক ও দুশ্চিন্তায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন স্বজনরা। রাজধানীতে কোভিডের জন্য নির্ধারিত প্রায় প্রতিটি হাসপাতালে এখন একই চিত্র।
বৃহস্পতিবার বিকালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্রবেশ পথে গিয়ে দেখা গেল অ্যাম্বুলেন্সগুলোর কোনো অবসর নেই। কখনো অ্যাম্বুলেন্সগুলো কোভিড রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে আসছেন, আবার মুহূর্তেই অন্য হাসপাতালে রোগীদের স্থানান্তরের জন্য ছুটতে হচ্ছে।
বেলা দুইটার দিকে রোগীকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠার সময় একজন নারীকে কাঁদতে দেখা যায়। রোগী ওই নারীর বাবা। আশঙ্কাজনক অবস্থায় আইসিইউ সেবার জন্য হাসপাতালে আসলেও, এখানে তিনি কোনো আইসিইউ বেড ফাঁকা পাননি। হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেওয়ার কারণে এখন তিনি আইসিইউর সন্ধানে অন্যত্র ছুটছেন।
হাসপাতালের রেসিডেন্ট চিকিৎসক ডা. ডাক্তার মোহাম্মদ আল আমিন জানান, "আইসিইউ বেডের ব্যবস্থা করা সহজ বিষয় নয়। এখন পর্যন্ত করোনা রোগীদের জন্য বিশেষায়িত সাতটি আইসিইউ স্থাপন করা হয়েছে।"
"কেবলমাত্র আইসিইউ বেড খালি না থাকায় প্রতিদিন গড়ে আমাদের দুই-একজন রোগীকে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে।"
ডা. আল আমিন আরও জানান, সম্প্রতি সোহরওয়ার্দী হাসপাতালের সাতটি আইউসিইউ বেডই করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ, করোনা ব্যতীত অন্যান্য সংকটাপন্ন রোগীরাও এখানকার আইসিইউতে স্থান পাবেন না। তাদের অন্য কোথাও যেতে হবে।
৫৪ বছর বয়সী কিডনি ডায়ালাইসিস রোগী স্বামীকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন আইরিন পারভিন।
গত ৫ এপ্রিল পপুলার ডায়াগনিস্ট সেন্টারের পারিবারিক চিকিৎসকের পরামর্শে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে কোভিড-১৯ সহ স্বামীর বেশ কিছু পরীক্ষা করান তিনি। পরদিন, তার করোনা ফলাফল নেগেটিভ আসে।
কিন্তু, কিছু সময় পরই রোগীর অক্সিজেন মাত্রা নামতে থাকে। ফুসফুসের স্ক্যানে করোনা সংক্রমণের ইঙ্গিত মেলে।
৮ এপ্রিল পরিবারটি রোগীকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কাছেই পার্ক করা গাড়িতে বালিশ, স্ট্যান্ড ফ্যান ইত্যাদি ব্যবহার্য জিনিস তুলতে তুলতেই দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে পারভিন জানান, "আমরা তাকে ডা. আজমল হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। আমার স্বামীর আইসিইউতে ভর্তি হওয়া জরুরি।"
আইসিইউ বেডের জন্য পরিবারটি আগে থেকেই ডা. আজমল হাসপাতালে যোগাযোগ করে। হাসপাতালটির মোট আটটি আইসিইউ এবং এইচডিইউ (হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট) বেডই তখন খালি ছিল। তবে, কোভিড রোগীদের জন্য এই হাসপাতাল পূর্ব-নির্ধারিত নয়।
রোগীর ভাই মিজানুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, "আমার ভাই করোনা সংক্রমিত কি না, বিষয়টি এখন পর্যন্ত পরিষ্কার না হলেও আমরা তাকে আইসিইউ ট্রিটমেন্টের জন্য সেখানে (মিরপুরে অবস্থিত ডা. আজমল হাসপাতাল) নিয়ে যাচ্ছি। আশঙ্কাজনকভাবে তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে। অক্সিজেন সাপোর্ট ছাড়া এখন তিনি নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না।"
হাসপাতালের রেসিডেন্ট চিকিৎসক আরও জানান, কেবল আইসিইউ বেডই নয়, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত 'রেড জোন' অংশটিতেও এখন সাধারণ করোনা রোগীদের জন্য কোনো ফাঁকা জায়গা নেই।
৭৫ বছর বয়সী করোনা আক্রান্ত বাবাকে নিয়ে হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে বসে ছিলেন কাজী ওবায়দুল রহমান। বুধবার রাতে করোনা ধরা পড়লেও তখন পর্যন্ত রোগীর অবস্থা ছিল শঙ্কামুক্ত। আইসিইউ না লাগলেও ডাক্তাররা চিকিৎসার জন্য তাকে হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দিয়েছেন।
তবে এখানকার করোনা রোগীদের বিশেষায়িত রেড জোন ফাঁকা নেই বলে জানিয়ে দিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আর তাই ওবায়দুল ফোনেই জরুরিভাবে হাসপাতাল খুঁজে চলেছেন। তিনি জানান, "আমি আমার বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতদের সাথে কথা বলছি। আমি শুনেছি মুগদা হাসপাতাল কিংবা সিটি হাসপাতালে হয়তো বাবার জন্য জায়গা পাওয়া যাবে।"
আইরিন পারভিনের চোখে যে অবর্ণনীয় দৃষ্টি ছিল, ওবায়দুলের কাঁপা কাঁপা গলাতেও যেন তেমনই অনিশ্চয়তা পাওয়া পেল।
ডাক্তার আল আমিন আরও জানান, "গতবছর প্রথমবার সংক্রমণ বৃদ্ধির পর আমরা কোভিড রোগীদের জন্য রেড জোনে একশটির বেশি সাধারণ বেড যোগ করি। বর্তমানে, এখানকার ধারণক্ষমতা পরিপূর্ণ। কোভিড রোগীদের জন্য বেডের সংখ্যা দ্বিগুণ করে ২০০ করা হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। আমাদের হাত বাঁধা।"
প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরবর্তী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বৃহস্পতিবার বিকালে মাকে নিয়ে হাসপাতালের এক বিল্ডিং থেকে অন্য বিল্ডিং এ ছুটছিলেন ফরহাদ সরকার। ফরহাদের ৬৫ বছর বয়সী নানীর জন্য আইসিইউ বেডের প্রয়োজন। এ সপ্তাহের শুরুতে তার কোভিড-১৯ ধরা পড়ে। সময়ের সাথে অবস্থার অবনতি ঘটে।
নগরে যে কয়টি হাসপাতাল অধিকাংশ কোভিড আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করছে তাদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অন্যতম। এখানে ২০ টি আইসিইউ বেড থাকলেও বৃহস্পতিবার দুপুর নাগাদ সব পূর্ণ হয়ে যায়।
হাসপাতালের একজন কর্মচারী এক টুকরো হলুদ কাগজ দিয়ে ফরহাদ ও তার মাকে কমপ্লেক্স-থ্রি আইসিইউতে পাঠান। আইসিইউ বেডের অনুমতি পেতে কমপ্লেক্স-থ্রি ইউনিটের হাসপাতাল কর্মচারীকে এই রিসিট দিতে হবে।
তবে, বিল্ডিং এর নিচে অবস্থানরত দারওয়ানরা তাদের ফিরিয়ে দেন। তারা জানান এখানে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয় না। তবে, মা ও ছেলে ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানান।
কয়েক মিনিট ধরে অনিশ্চিত কথাবার্তা চলে। এরপর চোখে পানি নিয়েই ছেলেকে অনুসরণ করেন মা।
কমপ্লেক্স থ্রির আইসিইউ ইউনিটে পৌঁছালে তাদের পাশের ঘরে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে বলা হয়। তবে সেখানে কেউ ছিলেন না। আইসিইউর নার্স জানান ডাক্তারকে অন্য ওয়ার্ডে গিয়ে খুঁজে দেখতে হবে।
আইসিইউ ফ্লোরে ২০ মিনিট ধরে পায়চারি করতে করতে বিভিন্ন জায়গায় ফোন কল করার পাশাপাশি তারা আইসিইউ বেড লাভের আশায় প্রবেশ পথে থাকা নিরাপত্তাকর্মীর সাথেও কথা বলেন। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত নিরাশ হয়েই অপর বিল্ডিং এ থাকা রোগীর কাছে ফিরে যান।
পরবর্তীতে কী করবেন এই বিষয়ে দুজনের কারও কাছেই কোনো সদুত্তর ছিল না।
তবে ফরহাদ সরকার এবং তার মা একাই নন, রাজধানীতে এরকম অসংখ্য পরিবার আপনজনের জন্য হন্যে হয়ে আইসিইউর সন্ধান করে চলেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে কোভিড শনাক্ত এবং সংকটাপন্ন রোগীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় আইসিইউতে আশঙ্কাজনক রোগীদের স্থান দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র অনুযায়ী, শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত দেশের ৬০০ টি আইসিইউ বেডের মধ্যে ১৫৫ টি বেড খালি ছিল।
তবে কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য নির্ধারিত ঢাকার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ৩০৫ টি আইসিইউ শয্যার মাঝে কেবলমাত্র ১৭টি শয্যা ফাঁকা আছে। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে মাত্র তিনটি আইসিইউ শয্যা খালি ছিল।