আগুন নেভাতে গিয়ে এক ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা যা দেখলেন...
রাতে জানানো হয়, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের সজীব ফুড কোম্পানিতে যে আগুন লেগেছে, সকালে সেখানে যেতে হবে। এ খবরে রাতে ভালো ঘুম হলো না।
আমাদের ট্রেনিং এখনো শেষ হয়নি; কিন্তু বাস্তবকাজের অভিজ্ঞতার জন্য আমরা কয়েকজন অফিসার সেখানে যাচ্ছি। এতদিন তো তাত্ত্বিক আর সাজানো ফায়ার ফাইটিং করেছি। এবার একেবারে ভিন্ন ফায়ার ফাইটিং। একটু মনের মধ্যে উত্তেজনা কাজ করছে।
সকাল ৮টার মধ্যে স্পটে পৌছে গেলাম। প্রথমেই আমাদের ব্রিফিং দেওয়া হলো। আমাদের দায়িত্ব ৫/৬ তলায় ধিকিধিকি করে যে আগুন জ্বলছে তা নির্বাপন। স্টারভেশন পদ্ধতিতে করতে হবে। মানে দাহ্য বস্তুকে আলাদা আলাদা করে তার উপর পানি দিতে হবে, যাতে স্তুপ করা দাহ্যবস্তুর ভিতরে আগুন না থাকে।
যাইহোক দুইতলা উঠতেই ক্যামিকেল পোড়ার গন্ধ, চারতলায় মানুষ পোড়ার গন্ধ, পাঁচ/ছয় তলায় কাগজ পোড়ার গন্ধ। আমার হার্ট এই প্রথম এত বিভিন্ন ধরনের বাতাস গ্রহণ করছিল।
৫ তলায় গিয়ে দেখি, ভেজা কাগজের স্তুপ আর সাদা ধোঁয়া বের হচ্ছে। ধোঁয়া মানেই ভিতরে আগুন জ্বলছে। রাতে আগুন নির্বাপন করা হয়েছে, তার উপর ফায়ার সুট পরা, তবু শরীরে তাপ অনুভব করছি। ভাবলাম, গতকাল তাহলে এখানে কি ভয়াবহ পরিমাণ তাপ ছিল।
চারদিকে দাহ্যবস্তুর স্তূপ, সবকিছু এলোমেলো, তাপে ছাদের এক জায়গায় ফুটো হয়ে ভেঙে পড়েছে। ছাদের বিভিন্ন জায়গায় রডগুলো বের হয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেকোনো সময় ভেঙে পড়বে। সে এক বিভীষিকাময় অবস্থা।
জীবনের এই প্রথম বাস্তব আগুন নির্বাপনের কাজ। পুরো ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আমার কেমন একা একা লাগল।
মনে সাহস নিয়ে কাজ শুরু করলাম। কাজ করতে করতে ভিতরে ভিতরে ঘেমে যাচ্ছিলাম। পানি মারার সাথে সাথে ফায়ার হুক দিয়ে দাহ্যবস্তুকে আলাদা করতে হচ্ছিল যা প্রচুর পরিশ্রমের কাজ। তাপ আর পরিশ্রমে ভিতরে ঘেমে ইউনিফর্ম ভিজে গেল। প্রচুর পানি পিপাসা লাগছিল। হঠাৎ মনে হলো, আমার দুই কানের উপরের দিকে মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে। কপাল আর মাথার দুই পাশের রগগুলো দেখা যাচ্ছিল। অনেকক্ষণ ধোঁয়ার মধ্যে থেকে কেমন যেন লাগছে। এ অনুভূতি আমার আগে হয়নি।
আমি স্পট থেকে বের হয়ে মুক্ত বাতাসের কাছে এলাম। ওহ! একটু ভালো লাগছে। দূরের গাছপালা বাড়িঘর দেখছি। মনে মনে ভাবছি, কাল যে ফায়ার ফাইটাররা সরাসরি আগুন নির্বাপন করেছে, তারা কিভাবে করেছে। কতটা পরিশ্রমী আর সাহসিক না হলে এ কাজ করা সম্ভব না। পুরো চাকরি জীবনে এ কাজের লিড আমাকে দিতে হবে। সাথে সাথে ভাবছি, কত কষ্ট না পেয়েই ৫২ জন মানুষ মারা গেল! দূর দিগন্তে তাকিয়ে থেকে নিজেকে খুব অসহায় লাগল।
সারাদিন আমরা রোটেশন করে কাজ করলাম। ১৫/২০ মিনিট কাজ করলেই মনে হলো, শরীরে একবিন্দু শক্তি নেই। পানি মারা, আবার প্রায় হাঁটু সমান দাহ্যস্তুপের মধ্যে পা তুলে তুলে সামনে এগিয়ে যাওয়া, সে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। ভাবছি গতকালই আগুন নেভানো শেষ। বলতে গেলে আমরা ডাবরিজ সরাচ্ছি আর অন্য কোনো লাশ আছে কিনা তা চেক করছি। তাতেই যে অবস্থা। কাল তাহলে কি অমানবিক পরিশ্রম করে এই আগুন নির্বাপন করা হয়েছে।
যাইহোক, বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে আবার ফায়ার ফাইটিং করছি। নিচতলা থেকে ৬ তলা পর্যন্ত ফায়ার সুট পরে উঠতেই যে পরিমাণ শক্তি ক্ষয় হয়, সেখানে বারবার উঠানামা আবার ফায়ার ফাইটিং করা, আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম নিজের স্টেমিনা দেখে।
শেষ পর্যন্ত ৩.৩০টার দিকে কাজ শেষ করি। পুরো সময়টা আমার মাথা ব্যথা ও ঝিম ঝিম করছিল। পুরনো সাংবাদিক বন্ধু, ছোটভাইদের সাথে দেখা হয়েছে। খুবই ভালো লেগেছিল। যখন গাড়িতে করে ফিরছিলাম, আমার মনে হয়েছিল একটা বিছানা পেলে এমন ঘুম দেব; কবে জাগব, আমি তা জানি না!
১০ জুলাই, ২০২১
-
লেখক: স্টেশন অফিসার, বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স
[লেখাটি ফেসবুক থেকে নেওয়া]