আতঙ্ক, ক্ষুধা আর হারানোর বেদনা নিয়ে লকডাউনের সাথে লড়ছেন তারা
কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার পর সোহেব খানের জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। খুলনার টুটপাড়া গাছতলা এলাকার বাসিন্দা সোহেব বেসরকারি একটি সংস্থায় চাকরি করতেন। তবে, করোনা আক্রান্ত হয়ে অফিসে যেতে না পারায় দু'মাস ধরে তার বেতন বন্ধ।
"করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রায় দুইমাস হাসপাতাল আর বাসায় কাটাচ্ছি। অসুস্থতার কারণে অফিসেও যেতে পারি না। বেতন বন্ধ হয়ে গেছে। আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুদের কাছ থেকে ধার-দেনা করে এতদিন চলেছি। এখন আর কারো কাছে ধার-দেনাও করতে পারছি না। দু'মাসের বাড়ি ভাড়াও বাকি পড়েছে। আয় না থাকায় স্ত্রী আর দুই সন্তানকে নিয়ে বেশিরভাগ দিনই উপোস থাকতে হয়। তাদের মুখের দিকে আর তাকাতে পারি না। মহামারি করোনা আমাকে নি:শেষ করে দিয়েছে," এভাবেই চরম হতাশার সুরে কথাগুলো বলছিলেন সোহেব খান।
একটি বেসরকারি এক সংস্থায় (এনজিও) চাকরি করতেন, সুকোমল (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, "চাকরিতে ভালোই বেতন পেতাম। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে দিনগুলো ভালো কাটছিল। মা-বাবাকে মাস শেষে বাড়িতে কিছু টাকা পাঠাতাম। কিন্তু করোনার অজুহাত দিয়ে কর্তৃপক্ষ প্রথমে বেতন অর্ধেক করে দেয়। প্রথম প্রথম মনে করেছিলাম, এই সমস্যা সাময়িক। কিন্তু বলা নেই, কওয়া নেই, একদিন এক নোটিশে চাকরিটাও চলে গেল। এখন বেকার অবস্থায় দিন কাটছে। গ্রামের বাড়িতে চলে আসার পর স্ত্রী-সন্তানও গ্রামীণ পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছে না। জমানো টাকাও শেষ হয়ে গেছে। সামনের দিনগুলো কীভাবে কাটবে জানি না।"
শুধু সোহেব খান আর সুকোমলই নন, কোনো শ্রেণিপেশার মানুষই করোনায় ভালো নেই। সঞ্চিত অর্থও শেষ হয়ে যাওয়ায় নিরুপায় হয়ে পড়েছেন অনেকেই।
খুলনা মহানগরীর দৌলতপুর রেল ক্রসিংয়ের পাশে ছোট একটি দোকানে সিঙ্গাড়া ও পুরি বিক্রি করেন মিঠু মিয়া। কিন্তু এত বেকায়দায় আগে কখনও পড়েননি তিনি। সংসারের খাওয়া-পরা, ঘর ভাড়া, দুই ছেলের লেখাপড়ার খরচসহ সবই চলতো তার এই দোকানের উপার্জনে। তবে লকডাউন ঘোষণার পর থেকে দোকান খুলতে পারছেন না, তাই আয়-রোজগারও বন্ধ। এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে সংসার চালাতে।
খুলনা মহানগরীর এ কে টাওয়ারের ম্যাস ফ্যাশনের মালিক আনিসুজ্জামান জানান, করোনার আগে তার দোকানে টি-শার্ট ও জিন্সের প্যান্টসহ প্রায় ১৫ লাখ টাকার মালামাল ছিল। প্রতিদিন দোকানে ১৪-১৫ হাজার টাকার মালামাল বিক্রি হতো।
তিনি বলেন, "করোনার কারণে অধিকাংশ সময় মার্কেট বন্ধ ছিল। আর এখন তো লকডাউনে দোকান খোলার প্রশ্নই আসে না। দোকান বন্ধ থাকার কারণে তার দুজন কর্মচারীর মধ্যে একজনকে ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছি"।
বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির (বিসিসি) খুলনা শাখার সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল হক সোহেল বলেন, "জলিল টাওয়ারের কম্পিউটার মার্কেটসহ খুলনা মহানগরীতে প্রায় ১০০টি কম্পিউটারের দোকান রয়েছে। এসব দোকানে শ্রমিক- কর্মচারীর সংখ্যা চার শতাধিক। কিন্তু করোনার কারণে দীর্ঘ সময় দোকান বন্ধ ছিল। মাঝে কিছুদিন খুললেও খুলনা অঞ্চলে করোনাভাইরাস বেড়ে যাওয়ায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর লকডাউন দেওয়া হয়েছে। ফলে দোকানপাটসহ ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ রয়েছে।"
তিনি আরও জানান, "কম্পিউটারের দোকান বন্ধ থাকলেও কর্মচারীদের বেতন গুনতে হচ্ছে। এসব কর্মচারীরা বিভিন্ন সফটওয়্যারের ওপর প্রশিক্ষিত। সে কারণে ইচ্ছে করলেই কম্পিউটারের দোকানের কর্মচারীদের ছাঁটাই করা যায় না।"
"ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকায় একদিকে ব্যাংক ঋণের সুদ বাড়ছে, অপরদিকে, কর্মচারীদের বেতন আর সংসার চালাতে গিয়ে কম্পিউটার ব্যবসায়ীদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে," বলেন তিনি।
নগরীর বসুপাড়া এলাকার রেবেকা সুলতানা নামে একজন গৃহবধূ জানান, তার স্বামী একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করেন। গত দু'মাস ধরে তার বেতন বন্ধ। একমাস কোনোভাবে চললেও এখন আর বাজার করার পয়সা নেই। তাদের চারজনের সংসার চলছে খুব কষ্টে।
এদিকে, ইলেক্ট্রনিক ব্যবসায়ী রাজা মোল্লা বলেন, "জানুয়ারি মাসে ২ লাখ টাকা জামানত দিয়ে দোকান ভাড়া নিয়েছি। এছাড়া প্রতিমাসে ভাড়াবাবদ ৫ হাজার টাকা গুণতে হচ্ছে। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে দোকান করেছি। একের পরে এক লকডাউনের কারণে দোকান বন্ধ রাখতে হচ্ছে। মাস শেষে ভাড়ার টাকা দিতে আত্মীয় স্বজন, বন্ধুদের কাছে ধার নিতে হচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, "এখন কি করবো? এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছি, কিস্তি দিতে হবে। টাকা কোথায় পাবো? চরম সংকটে পড়েছি।"
দৌলতপুর ভ্যান স্ট্যান্ডে কথা হয় ভ্যান চালক সাগর, পলাশ হোসেন ও আলমগীরের সঙ্গে। তারা বলেন, লকডাউনের কারণে যাত্রী নেই। দিন শেষে চাল-ডাল কেনার টাকাও হচ্ছে না। ঘর ভাড়া, ছেলে-মেয়ে ও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। প্রথম দিকে বিত্তবানরা খাবার ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করলেও এখন তা পাচ্ছেন না বলেও জানান তারা। ফলে, চরম বেকায়দায় আছে ভ্যান ও রিকশা চালকরা।
রূপসার রহিমনগর এলাকার ষাটোর্ধ্ব নার্গিস বেগম জানান, খুলনার বেলায়েতের ডকইয়ার্ডে কাজ করতেন তিনি। গত রমজানের লকডাউনের পর কাজ হারিয়েছেন। এখন খুব কষ্টে তার দিন কাটছে। একমাত্র সন্তান থাকে ঢাকায়। আর স্বামী অসুস্থ বৃদ্ধ আব্দুল মান্নান এখন কর্মক্ষম নন। বয়স্ক ভাতার সামান্য কিছু টাকা আর স্ত্রীর ডকইয়ার্ডের দৈনিক হাজিরায় চলছিলো তাদের সংসার। কাজ বন্ধ হয়ে পড়ায় তাকে ধরতে হয়েছে ভিক্ষার ঝুলি।
বগুড়ার চার তারকা হোটেল নাজ গার্ডেনে সহকারি ব্যবস্থাপক পদে চাকরি করতেন রাজিবুল ইসলাম। করোনার প্রভাবে গত বছরের ৭ এপ্রিল চাকরি হারান তিনি। এরপর থেকে রাজিবুল বেকার হয়ে বাড়িতেই বসেছিলেন। দিশেহারা রাজিবুলের আয় রোজগার না থাকায় সংকট শুরু হয় সংসারে। সন্তানের পড়ালেখাও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তবে শেষ রক্ষা হয়েছে স্ত্রীর কারণে। স্ত্রীর সাথে অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের পোশাক ও খাবার বিক্রি করে তারা দুজনে মিলেই এখই সংসার চালাচ্ছেন।
রাজিবুলের থমকে যাওয়া জীবনের গল্পে সংসারের টানাপোড়নের কাহিনী বেশ করুণ। গত বছরের এপ্রিলে করোনার সংক্রমণ ও লকডাউন শুরু হলে হোটেল নাজ গার্ডেন বন্ধ হয়ে যায়। বেকার হয়ে পড়েন রাজিবুল। ঘরে স্ত্রী ও দুই সন্তান। অথচ একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি রাজিবুলের রোজগার বন্ধ। এক পর্যায়ে সংসার নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন তিনি।
রাজিবুল ইসলাম বলেন, "করোনায় চাকরি হারিয়ে সংসার নিয়ে অথৈ পানিতে পড়েছিলাম। এভাবে চারমাস চলার পরে একদম সংকটাপন্ন অবস্থা। কোনোভাবে কোনো কূল-কিনারা মেলে না। অসহায় লাগে প্রতিক্ষণ। দিনের বেলায়ও অন্ধকার দেখি। রাতের বেলায় ঘুমও আসে না। চাকরি যাওয়ার পর টাকা ধার চাইলেও কেউ দিতে চান না। কীভাবে সংসার চলবে তার সমাধানও বের করা মুশকিল হয়ে পড়ে। এমন অবস্থায় আমার স্ত্রী মাসুমা পাশে দাঁড়ায়। শুরু করে অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের কাপড় ও আচারের ব্যবসা। এরপর চোখ মেলে স্বস্থির নিঃশ্বাস নেওয়া শুরু হয় আমাদের। অনলাইনে ব্যবসার আয় দিয়েই এখন আমাদের সংসার চলে।"
রাজিবুলের স্ত্রী মাসুমা বলেন, "সংসারের দিশেহারা অবস্থায় অনলাইনে পণ্য বিক্রির চিন্তা মাথায় আসে। ফেসবুকে পেজে বিভিন্ন পণ্যের ছবি আপলোড করা হয়। পরে বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মে ব্যবসা শুরু করার মাধ্যমে এখন সংসার বেশ ভালো চলেছ। তবে মাঝখানে বড় রকমের কষ্ট করতে হয়েছে।"
বর্তমানে বগুড়ায় বসবসাকারি গাইবান্ধার বাসিন্দা মাহফুজ আহম্মেদ (ছদ্মনাম) একটি ওষুধ কোম্পানিতে ১৬ বছরের বেশি ধরে চাকরি করতেন। সর্বশেষ ওই কোম্পানিতে তিনি এরিয়া ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করতেন। করোনার কারণে গত বছরের ডিসেম্বর তাকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয়। এরপর দিশেহারা হয়ে পড়েন এই ব্যক্তি। কীভাবে ভাড়া বাসায় সংসারের খরচ মিটাবেন? একমাত্র ছেলের পড়াশোনাই বা কীভাবে হবে? এমন সব চিন্তার মধ্যেই নিজেই ফের নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন।
মাহফুজ বলেন, "করোনাকালে চাকরি হারানোর পর চাকরি পাওয়া এই বাজারে খুব কঠিন। এ কারণে বাধ্য হয়ে বগুড়া শহরের একমাত্র শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত মার্কেট রানার প্লাজায় একটি কাপড়ের দোকানে ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ব্যবসা শুরু করি। কিন্তু কপালের ফের করোনা আরও বাড়লো। ব্যবসা শুরু করার পর থেকেই প্রায় ওই মার্কেট বন্ধ। এখন আমাদের সংসার কীভাবে চলবে তা নিয়ে সংশয়ে আছি।"
বগুড়ার বাসিন্দা মোস্তাক জামাল ফার ইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্সে চাকরি করতেন কয়েক বছর ধরে। করোনার কারণে তাদের কাজ স্থবির। কোম্পানির অবস্থাও বেশ নাজুক। মোস্তাক বলেন, "ইন্সুরেন্স কোম্পানির নাম শুনলেই মানুষ এমনিতে নাক সিঁটকায়। এর মধ্যে করোনা এসে সব ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। মানুষের জীবন যাত্রা একদম থামিয়ে দিয়েছে। এই অবস্থায় কোম্পানির কাজও বন্ধ। একই সাথে বন্ধ হয়ে গেছে আমাদের কমিশনও। অনেকে ছাঁটাই হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "এখন আমার ওই কেম্পানি থেকে কোনো আয় নেই। বাড়িতে চলে এসেছি। এর মধ্যে আমি এক সময় হোমিও চিকিৎসার উপর ডিপ্লোমা কোর্স করে রেখেছিলাম। করোনায় আমাদের আয় রোজগারের উপর থাবা বসানোর পর হোমিও চিকিৎসা দিয়ে জীবিকার পথ বেছে নিয়েছি। কিন্তু এ পথে আয় করাও কঠিন। মানুষ সহজে বিশ্বাস করতে চায় না। তবুও জীবন তো চালাতে হবে।"
মোস্তাক বলেন, "ব্যবসা তো চাইলেই শুরু করা যায় না। ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য ঢাকায় টাকা পাঠাতে হয়। খরচের দিক বিবেচনা করে কিছু জমি ছিল সেটাও বিক্রি করার পরিকল্পনা করেছি। দুই ছেলে, এক মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে অতল সাগরের মধ্যে আছি। সংসারের চিন্তায় ক্রমাগত অসুস্থ হয়ে পড়ছি। আল্লাহ জানে এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের উপায় কী?"
খাদ্য নাকি ওষুধ?
কঠোর লকডাউনের কারণে বহু মানুষের উপার্জন হারিয়েছে। নিম্ন এবং নিম্ন-মধ্য আয়ের মানুষ প্রতিদিনের খাবারের যোগাড় করতেই হিমশিম খাচ্ছেন। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ওষুধের বাড়তি খরচ।
আর্থিক অবস্থা করুণ হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই কোভিড আক্রান্ত হয়ে সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হন।
বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের কোভিড ইউনিটের একাধিক রোগীর সাথে আলোচনা হলে তারা আর্থিক দুরবস্থার কথা জানান।
"লকডাউনে কাজ হারানোতে আমাকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়। আমার ছেলে জ্বরে ভগছে কিন্তু তারপরেও তাকে ডাক্তার দেখানোর সামর্থ্য আমার নেই," বলেন ঝালকাঠির রাজাপুরের একজন নির্মাণ শ্রমিক।
বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড হাসপাতালের কোভিড-১৯ ইউনিটে চিকিৎসারত পরিবারগুলোর প্রায় ৩০ জনের সাথে কথা বলে। এদের মধ্যে ১২ জন জানান যে, হাসপাতালে আসার জন্য তারা আত্মীয় বা প্রতিবেশিদের কাছ থেকে ধার নিয়েছেন।
লকডাউনের কারণে আমার মাকে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে আনতে আমাকে মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া দিতে হয়েছে," বলেন বরগুনার শাকিলা খানম।
"আমার ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য আমাদের স্বর্নালঙ্কার বেচতে হয়েছে," জানান ভোলার শাহিদা আক্তার। চর ফ্যাশন থেকে হাসপাতালে আসতে তাকে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে বলেও জানান তিনি।
সূত্রানুসারে, বরিশালে মাত্র ২২টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে। অন্যদিকে, ভোলায় আইসিইউ শয্যা সংখ্যা মত্রা তিনটি। তবে, বিভাগের বাকি সব জেলায় কোনো আইসিইউ নেই।
"কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসার জন্য আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি," বলেন শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালের পরিচালক ড. সাইফুল ইসলাম।
সাতক্ষীরার রবিউল ইসলাম বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বাবা মারা গেছেন ১২ বছর আগে। সেই থেকে কৃষিকাজ করে ছোট ভাই আরিফুল ইসলামকে আমি দেখভাল করি। লেখাপড়া শিখিয়ে মাস্টার্স শেষ করিয়েছি। চাকুরির আবেদন করবে এরই মধ্যে করোনার প্রভাব শুরু হয় দেশে। তাই আর কোথাও আবেদন করতে পারেনি। গত ১৭ জুন থেকে সর্দি কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত হয় আরিফুল। ২৪ জুন সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করি। তারপর থেকে এখনও আরিফ সেখানেই চিকিৎসাধীন। এমনিতেই সংসারে অভাব অনটনের মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে চিকিৎসার পেছনে। আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি।"
তিনি আরও জানান, "প্রতিদিন অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করে ২৫০-৩০০ টাকা রোজগার হয়। সব মিলিয়ে মাসে সাত থেকে আট হাজার টাকা রোজগার। সেই টাকাতেই অভাব অনটনে সাত-আট জনের সংসার চলে। ছোট ভাই আরিফুল করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর এ পর্যন্ত ৬০-৭০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। আমার গচ্ছিত কোনও টাকা নেই। পরিচিত ও আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ধারদেনা করিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছি। বিলের মধ্যে তিন বিঘা জমি আছে। যেখানে ধান হয় না। ভেবেছি সেই জমিটা ইজারা দিয়ে পাওনা টাকায় এই ঋণ পরিশোধ করব।"
রবিউল ইসলাম আরও বলেন, "১৪-১৫ দিন আমি হাসপাতালেই আছি। সরকারি কোন সহায়তাও পায়নি আমার পরিবার। শুধু হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে কিছু ওষুধপত্র পাচ্ছি।"
অনেকটা একই রকম গল্প করোনা আক্রান্ত হওয়া প্রত্যেকটি নিম্ন আয়ের পরিবারে। করোনা আক্রান্ত হলেই চিকিৎসার জন্য এ ব্যয়বহুল খরচ জোগাতে হিসশিম খাচ্ছেন তারা।
সাতক্ষীরার তালা সদরের শিবপুর গ্রামের মৃত নছিমউদ্দীন সরদারের ছেলে আব্দুর রশিদ সরদার। কৃষিকাজ করে পরিবার নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। বর্তমানে করোনা আক্রান্ত হয়ে ২৯ জুন থেকে চিকিৎসাধীন রয়েছেন সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
করোনা আক্রান্ত আব্দুর রশিদ সরদারের ছেলে মুকুর সরদার বলেন, "আব্বাকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর ১০ দিনে ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। শারীরিকভাবে এখন সুস্থ হলেও হাতের রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। হাত নড়াচড়া করতে পারছেন না। চিকিৎসক বলেছেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বলা যাবে কি সমস্যা হয়েছে। ধারদেনা করে আব্বার চিকিৎসা করাচ্ছি।"
সাতক্ষীরা জেলা পরিসংখ্যান অফিসের উপ পরিচালক মো. বশির উদ্দীন জানান, "জেলায় জনসংখ্যা রয়েছে ২০ লাখ ৬৬ হাজার ৬৯০ জন। এদের মধ্যে দারিদ্র্য সীমার নিচে রয়েছে ২৫ দশমিক ১ ভাগ মানুষ। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের পরিসংখ্যান নেই। করোনাকালীন সময়ে মানুষের আয় রোজগার অনেক কমে গেছে।"
"কাজ ও চাকরি হারিয়ে ও অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে অনেকেই বেকার হয়ে পড়েছেন। উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কমে যাওয়ায় শ্রম বাজারও কমে গেছে। দিনমজুর শ্রেণির মানুষদেরও আয় কমেছে। যদিও এখন পর্যন্ত কোনো জরিপ করা হয়নি, তবে বলা যায় জেলায় দরিদ্রের সংখ্যা আরও বেড়েছে," বলেন তিনি।