উচ্চগতির রেল প্রকল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী অস্ট্রেলিয়ান প্রতিষ্ঠান
সম্প্রতি বাংলাদেশে রেলওয়ের দুটি মেগা প্রকল্প ঢাকা-চট্টগ্রাম উচ্চগতির ট্রেন ও লিংক প্রকল্প বাস্তবায়নে আকর্ষণীয় ঋণ প্রস্তাব দিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার প্রভিডাস ইনভেস্টমেস্ট প্রাইভেট লিমিটেড।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো প্রতিষ্ঠানটির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, প্রকল্প দুটির অনুমিত সম্পূর্ণ খরচ প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিবে প্রতিষ্ঠানটি। প্রস্তাবনায় ঋণ পরিশোধের সময় ৩০ বছর জানানো হয়।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সূত্র দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছে, চীনা করপোরেশনগুলোসহ অন্যান্য অনেক বিদেশি ঋণদাতার চেয়ে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিস্কোপ ক্যাপিটাল রাইজিং পদ্ধতিতে বৈশ্বিক পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করে অর্থ সরবরাহ করবে বিনিয়োগকারীরা।
ঋণ প্রদানের আগ্রহ প্রকাশ করে ২০২০ সালের ৭ অক্টোবর রেলপথ মন্ত্রনালয় বরাবর প্রথম চিঠি দেয় প্রভিডাস।
গত ৯ মার্চ রেল মন্ত্রণালয়ে প্রভিডাসপাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে তাদের প্রস্তাব তুলে ধরে। পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে উপস্থিত ছিলেন রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব সেলিম রেজা, বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্রনাথ মজুমদার, রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) মো. কামরুল আহসান, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম।
রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, দাতা সংস্থার প্রস্তাবটি অধিকতর আকর্ষণীয় উল্লেখ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কাছে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে।
রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জনান, "আমরা প্রস্তাবটির ব্যাপারে কী ভাবছি তা গুরূত্বপূর্ণ নয়, ইআরডি-ই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সিদ্ধান্ত নেবে,"
"আমরা ইআরডিকে শুধু জানিয়েছি, প্রকল্প দুটির জন্য আমাদের কী পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন," যোগ করেন তিনি।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের রেলপথকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে ইতোমধ্যে সরকার বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম উচ্চগতির ট্রেন ও ভাঙ্গা-পায়রা রেল লিংক প্রকল্প অন্যতম।
এ দুটি প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ ও প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম উচ্চগতির ট্রেন নির্মাণের সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার এবং ভাঙ্গা হতে পায়রা পর্যন্ত প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার।
প্রভিডাস জানিয়েছ, স্বল্প সুদে এই ঋণ দিতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। গ্রেস পিরিয়ড হিসেবে প্রকল্পের নির্মাণকালে ঋণের সুদ যুক্ত হবে না। পাশাপাশি নির্মাণ শেষে প্রকল্প দুটি রেলওয়েকে সরাসরি হস্তাস্তর করা হবে। এ ক্ষেত্রে ঠিকাদার নিয়োগ-সহ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠানটি রেলওয়েকে কোন শর্তও প্রদান করবে না।
এদিকে প্রভিডাসের সঙ্গে যৌথভাবে অর্থায়নে আগ্রহী দেশীয় এক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান অস্ট্রেলিয়ার ঋণ দেওয়ার নিয়ম-নীতির প্রশংসা করেছে।
একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, "প্রভিডাসের ঋণের প্রস্তাবনা বোঝা খুবই সহজ, আকর্ষণীয় এবং অন্যান্য ঋণদাতার চেয়ে কম সুদে ঋণ দিবে প্রতিষ্ঠানটি,"
বর্তমানে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত হাইস্পিড রেলপথ নির্মাণে 'কুমিল্লা/লাকসাম হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম দ্রুতগতির রেলপথ নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও বিশদ ডিজাইন' প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
নতুন এই রুটের ৭টি স্টেশনের মধ্যে রয়েছে ঢাকা, ঢাকা ডিপো, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, ফেনী, পাহাড়তলী ও চট্টগ্রাম।স্টপেজে থামা সাপেক্ষে প্রতিঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটার গতিবেগে পাথরহীন ট্র্যাকে মাত্র ৭৩ মিনিটে গন্তব্যে পৌঁছাবে ট্রেন। ডাবললাইনে ইলেকট্রিক ট্রেন নন-স্টপ হিসাবে মাত্র ৫৫ মিনিটে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে পৌঁছাবে।
বিরতীহীন প্রতি ঘন্টায় ৩০০ কিলোমিটার বেগে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচলের এই রেল রুটে প্রতিদিন ৫০ হাজার যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা থাকবে। শীঘ্রই চীনের চায়না রেলওয়ে ডিজাইন করপোরেশন ও বাংলাদেশের মজুমদার এন্টারপ্রাইজ নকশা প্রণয়ন শেষে তা রেলওয়ের কাছে জমা দেবে।
অন্যদিকে ভাঙ্গা-পায়রা রেল লিংক প্রকল্পের সর্বমোট দূরত্ব ২১৩ দশমিক ৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে ভাঙ্গা থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত মেইল লাইন রেলপথ হবে ১৮৯ দশমিক ৫ কিলোমিটার। এছাড়াও পায়রা বন্দর থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত শাখা লাইন হবে ২৩ দশমিক ৮ কিলোমিটার। এই প্রকল্পের সর্বমোট স্টেশন হবে ১৯টি, মেজর ব্রিজ (১০০ মিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের) হবে ২২টি, মাইনর ব্রিজ (১০০ মিটারের কম দৈর্ঘ্যের) ৫০টি, বক্স আন্ডারপাস ও কালভার্ট ৪৩৪টি।
রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, এর আগে একাধিক বিদেশি প্রতিষ্ঠান প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপ (পিপিপি) ও বিল্ড-অপারেট অ্যান্ড ট্রান্সফার (বিওটি) পদ্ধতিতে ঋণ প্রদানের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
তাছাড়া চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ জোগাড় করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা জানায়। কিন্তু প্রভিডাসের প্রস্তাব হল স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানের পাশাপাশি ইঞ্জিনিয়ারিং-প্রকিউমেন্ট-কন্সট্রাকশনের (ইপিসি) মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন।
বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, প্রকল্প দুটি নিয়ে ইতোমধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগে প্রস্তাব দিয়েছে।
"নকশা তৈরির কাজ শেষে অধিকতর যোগ্য প্রতিষ্ঠানই প্রকল্প দুটির কাজ পাবে বলে মনে করছি। ," বলেন তিনি।
অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, তানজানিয়া সহ বিভিন্ন দেশে প্রভিডাস ইতোমধ্যে প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা প্রদান করেছে। প্রভিডাসের সাথে উইবিল্ড, লেইং ও'রোর্রক, ব্যাকটেল, হুন্দাই, ফ্লোরের মতো বিশ্বের স্বনামধন্য নির্মাণ প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের নির্মাণ কাজ সম্পাদন কাজ করতে পারবে বলে বাংলাদেশ রেলওয়েকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
চীনা প্রতিষ্ঠানও আগ্রহী
চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিআরসিসি) ও চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) ঢাকা-চতটগ্রাম হাইস্পিড রেললাইন নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
প্রতিষ্ঠান দুটি জানিয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নে তারা যৌথভাবে একটি কোম্পানি গঠন করবে। প্রস্তাবিত কোম্পানি প্রকল্পের ঋণ নেওয়ার কাজ করবে ও পাঁচ বছর কার্যক্রম চলার পর বাংলাদেশ রেলওয়ের কাছে হস্তান্তর করবে।
গত বছরের ৯ অক্টোবর ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাস ও সরকারি- বেসরকারি অংশীদারত্ব কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে এবিষয়ে রেল মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়।
প্রস্তাবনা অনুযায়ী, প্রস্তাবিত কোম্পানির দেওয়া ঋণের প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যয় ও সুদ, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, ট্রেন চলাচল ও কোম্পানির লাভও অন্তর্ভুক্ত হবে।
২০ বছর মেয়াদী ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থাও করবে প্রতিষ্ঠান দুটি। বছরপ্রতি দুই কিস্তিতে মোট ৪০ কিস্তিতে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশ রেলওয়েকে। এই ঋণের জামিনদার হবে অর্থ মন্ত্রণালয়।
ভাঙ্গা-পায়রা রেলে বিনিয়োগে আগ্রহী যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠান
২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আইএম পাওয়ার 'ইন্টিগ্রেটেড রেল অ্যান্ড এনার্জি প্রজেক্ট' শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব দেয়।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (বিডা) দেওয়া ওই প্রস্তাবে পায়রা বন্দর থেকে ভাঙ্গা হয়ে ঢাকা পর্যন্ত ডাবল ট্র্যাক বৈদ্যুতিক রেললাইন নির্মাণের আগ্রহ প্রকাশ করে
আইএম পাওয়ার।
প্রকল্পটিতে তিন ধাপে ১১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দেয় প্রতিষ্ঠানটি। কন্ট্রাক্ট গ্রুপ বা কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমে পিপিপি বা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের ভিত্তিতে প্রকল্প বাস্তবায়নের আভাস দিয়েছে আইএম পাওয়ার।
এছাড়াও ডিজাইন-বিল্ড-অপারেট অ্যান্ড মেইনটেইন পদ্ধতিতে সরকারের কাছ থেকে ৫০ বছর মেয়াদে প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছে আইএম।