একবছর পর সচল হতে শুরু করেছে যশোরের অর্থনীতি
করোনা ভাইরাসে স্থবির যশোর জেলার অর্থনীতি সচল হতে শুরু করেছে। কলকারখানাগুলো উৎপাদন শুরু করেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনার কারণে যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তবে ব্যবসায় মন্দা কাটতে শুরু করেছে। এজন্য ব্যবসায়ীরা সরকারের প্রণোদনার ঋণ সুবিধা আরও এক বছর পেতে চায়।
যশোর শহরের পাশেই ঝুমঝুমপুরে ৫০ একর জমির উপর ১৯৬২ সালে গড়ে উঠে এ শিল্পনগরী। বিসিক কর্মকর্তারা জানান, এই শিল্পনগরীতে মোট ১১৮টি ইউনিট রয়েছে, যারমধ্যে ১১৫টি ইউনিটেই শিল্প-কলকারখানা চালু রয়েছে। এসব শিল্প কারখানায় ৫ হাজার ৯১৮ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। যার মধ্যে পুরুষ শ্রমিক রয়েছে ২ হাজার ৯৩২ জন ও নারী শ্রমিক রয়েছে ২ হাজার ৯৮৬ জন।
বিসিকে অবস্থিত গাড়ির যন্ত্রাংশ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এনায়েত ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানার স্বত্বাধিকারী আকতার হোসেন জানান, গত এক বছরের বেশি সময় ধরে তাদের কোন ক্রেতা ছিলনা। অর্ডার না থাকায় যন্ত্রাংশ উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়। চলতি বছরের ফেরুয়ারি মাস থেকে বিক্রি শুরু হয়েছে। তারা আশা করছেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এক বছরের মধ্যে আর্থিক ক্ষতি সামাল দেয়া যাবে।
যশোর বিসিকের প্রতিষ্ঠান এমইউসিইএ ফুডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্যামল দাস জানান, 'আমরা হিমায়িত চিংড়ি রফতানি করি ১৯টি দেশে। করোনার কারণে সব ধরণের বাণিজ্য বন্ধ হয়ে পড়েছিল। ফেরুয়ারি মাস থেকে রফতানি করছি ৫টি দেশে। ব্যবসা সচল হতে শুরু করলেও ঘুরে দাঁড়াতে কমপক্ষে আরও এক বছর লাগবে। এজন্য সরকারের প্রণোদনা ঋণের সময়সীমা বাড়ালে আমাদের জন্য খুব ভালো হতো'।
যশোর বিসিক শিল্পনগরী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ মোস্তফা আলী বলেন, 'বিসিকের সব প্রতিষ্ঠান কমবেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এখন কিছু প্রতিষ্ঠান আবারও সচল হতে শুরু করেছে। কিন্তু বিসিক কর্তৃপক্ষ আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি। কোন ধরণের চার্জ তারা মওকুফ করছে না। এতে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরা বেকায়দায় পড়েছেন'।
দেশের চামড়াখাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে যশোরের শিল্প শহর নওয়াপাড়ায় অবস্থিত এসএএফ। টানা ৩২ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি ফিনিশিং চামড়া রপ্তানি করছে। এ পর্যন্ত চারবার জাতীয় রপ্তানি ট্রফি অর্জন করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বছরে ৪শ' কোটি টাকার চামড়াজাত দ্রব্য রপ্তানি করে থাকে দেশের স্বনামধন্য এ প্রতিষ্ঠান।
এসএএফ'র জেনারেল ম্যানেজার আবুল ইসলাম জানান, করোনার আগে বছরে ৪শ' কোটি টাকার ফিনিশিং চামড়াজাত দ্রব্য ইটালি, ইউরোপ, চীনসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি করা হতো। কিন্তু করোনা ভাইরাস সব শেষ করে দিয়েছে। বিদেশিরা আসতে না পারায় এখনো আমাদের ব্যবসা মন্দার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আশা করছি চলতি মাস থেকে অর্ডার আসা শুরু হবে।
যশোরের অর্থনীতির বড় বাজার হলো মোটরপার্টস ও মোটরসাইকেল পার্টস। বেনাপোল কাস্টমস শুধুমাত্র এ খাত থেকে বছরে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব পেয়ে থাকে।
শহরের ক্লোডস্টোর এলাকার ফারিয়া মোর্টরসের মালিক রেজোয়ান আহমেদ মুরাদ জানান, 'আমি বড় গাড়ির ইঞ্জিন ভারত থেকে আমদানি করে বিক্রি করি। সারা দেশের ক্রেতারা আসেন আমাদের এখানে। আগে প্রতিদিন এক বা দু'টি করে ইঞ্জিন বিক্রি হতো। কিন্তু গত একবছর ধরে কোন ক্রেতা ছিলনা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে পাটর্স আমদানি শুরু করেছি। ক্রেতারা আসতে শুরু করলেও ব্যবসার গতি নেই'।
যশোর মোটরপার্টস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শাহিনুর হোসেন ঠান্ডু জানান, 'দেশের মধ্যে সবচেয়ে মোটরপার্টসের বড় বাজার যশোর। এখানে দেশের বিভিন্ন জেলার গাড়ির মালিকরা আসেন ইঞ্জিন ও খুচরা যন্ত্রাংশ কিনতে। বছরে এখানে কমপক্ষে ৩ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়ে থাকে। দোকানীরা ব্যাংক ঋণ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। আরও একবছর প্রণোদনার সময় পেলে সবাই উপকৃত হতেন'।
করোনা ভাইরাস আতঙ্কে যশোরের আবাসিক হোটেলগুলোতে চলছে চরম মন্দাবস্থা। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে গত একবছর হোটেল বন্ধ করে রেখেছিলেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, খুলনা বিভাগের মধ্যস্থল হিসেবে যশোর জেলা পরিচিত। এখানে রয়েছে বিমানবন্দর, দেশের সর্ববৃহৎ বেনাপোল স্থলবন্দর, নওয়াপাড়া নৌ-বন্দর, পাশে মোংলা সমুদ্রবন্দর ও ভোমরা স্থলবন্দর। আছে ট্রেন যোগাযোগ ব্যবস্থা। যশোর থেকে ১৮টি রুটে চলে পরিবহন। এছাড়া যশোর বিমানবন্দর ব্যবহার করছেন খুলনা, মাগুরা, ঝিনাইদহ ও কুষ্টিয়ার ব্যবসায়ী, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। সেই সুবাদে যশোরে পাঁচ তারকামানের আবাসিক হোটেল গড়ে উঠেছে। অথচ শুরুতেই তারা হোঁচট খাচ্ছেন।
সিটিপ্লাজা হোটেলের স্বত্বাধিকারী ইয়াকুব আলী জানান, জানুয়ারি মাস থেকে কিছু গ্রাহক পাওয়া যাচ্ছে। তবে তা খুবই অপ্রতুল।
বিসিকে অবস্থিত মদিনা মেটালের স্বত্বাধিকারী ফারুক হোসেন জানান, তাদের উৎপাদিত বাইসাইকেলের রিম সারা দেশে যায়। এখানে শতাধিক মানুষ কর্মরত। করোনার কারণে ব্যবসা মন্দার মধ্যে চলেছে।
যশোর জেলা উইমেন চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি তনুজা রহমান মায়া জানান, 'করোনা ভাইরাস নারী উদ্যোক্তাদের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিয়েছে। জেলায় সাড়ে ৪শ' হস্তশিল্প রয়েছে। যেখানে কমপক্ষে ১০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। প্রায় সব শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছিলেন। বর্তমানে কিছুটা সচল হচ্ছে ব্যবসা'।
এ ব্যাপারে যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান জানান, 'করোনা ভাইরাসের প্রভাবে জেলার অর্থনীতি ধ্সে পড়েছিল। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পথে বসে। সবমিলিয়ে জেলায় হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়। আমাদের দেশে করোনার হার কমে আসা এবং বাণিজ্য চালু হওয়ায় আবারও অর্থনীতির চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। তবে ভালোভাবে সচল হতে আরও একবছর সময় লেগে যেতে পারে। এজন্য সরকারকে আরও সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে'।