এখনো হুমকির মুখে টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্য
ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির মুখে পড়ছে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর জলাভূমির বাস্তুতন্ত্র। টাঙ্গুয়ার হাওরের এই জীববৈচিত্র্য নষ্ট হবার ফলে শুধু যে অসংখ্য প্রাণ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, তা-ই নয়; সেইসঙ্গে খাদ্য সরবরাহ, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও পর্যটন খাতেরও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
দেশের অতি পরিচিত ও বৈচিত্র্যময় এই জলাভূমির পরিবেশগত অবনতির জন্য অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন ব্যবস্থাকে দায়ী করা হচ্ছে।
জলজ পরিবেশ ও পর্যটন কেন্দ্র রক্ষার জন্য সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আনসার নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ ছিল। কিন্তু কিছুদিন পরেই তা স্তিমিত হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় বলে জানিয়েছেন পরিবেশবাদীরা।
স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, কিছু লোক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশ করে অবৈধভাবে মাছ ধরা, গাছ কাটা এবং অতিথি পাখি শিকারের মতো বেআইনি কাজ করে যাচ্ছে।
পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার প্রেসিডেন্ট কাশমীর রেজার ভাষ্যে, টাঙ্গুয়ার হাওরের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য এখন চরম হুমকির মুখে।
তার কাছ থেকে আরও জানা যায়, প্রতি বছর দেশের নানা প্রান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ টাঙ্গুয়ার হাওরের চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য উপভোগ করতে হাওরের বুকে রাত কাটাতেও ছুটে আসেন।
রেজার কাছ থেকেই পাওয়া গেল হাওরের এক অপূর্ব চিত্রের বর্ণনা: তিনি জানালেন, বর্ষাকালে হাওর কানায় কানায় যখন পানিতে পূর্ণ হয়ে যায় এবং গাছগুলো এক নবযৌবন পেয়ে সবুজ-সতেজ হয়ে ওঠে, সে এক নয়ানভিরাম দৃশ্য। আবার শীতে প্রায় ২০০ ধরনের অতিথি পাখির আনাগোনায় বদলে যায় হাওরের রূপ।
বার্ডস ক্লাবের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টের উল্লেখ করে রেজা বলেন, 'গত কয়েক বছরে হাওরে পাখির সংখ্যা কমেছে ৮০ শতাংশ। ২০১৫ সালে প্রায় দুই লাখ অতিথি পাখি এখানে এসেছিল, কিন্তু ২০১৮ সালে তা কমে গিয়ে ৫০ হাজারে দাঁড়ায়। ২০০২ সাল পর্যন্তও এখানে পাঁচ লক্ষ অতিথি পাখি আসার হিসেব করা হয়েছিল।'
পরিবেশবাদীরা আরও জানান, মানবসৃষ্ট দূষণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ফলে এই অঞ্চলের মাছ উৎপাদনও অনেকাংশে কমে গেছে এবং জলজ প্রাণী হুমকির মুখে পড়েছে।
অন্যান্য সূত্র থেকে জানা যায়, পর্যটকরা এখানে এসে প্লাস্টিক বোতল এবং পলিথিনসহ এমনসব আবর্জনা ফেলেন, যা পানিতে মিশে যায় না। এছাড়াও ইঞ্জিনচালিত অসংখ্য নৌকা এবং লাউডস্পিকারের উচ্চশব্দ জলজ প্রাণীগুলোকে সচকিত ও অস্থির করে তোলে।
১০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের একটি অদ্বিতীয় জলাভূমি। হাওরকে কেন্দ্র করে রয়েছে ৪৬টি গ্রাম এবং ৪০ হাজার মানুষের বসবাস। এ হাওর দেশের মাছ উৎপাদনের সর্ববৃহৎ একটি উৎস বলেও পরিচিত।
প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর উপর্যুপরি এই আগ্রাসনের কথা চিন্তা করে সরকার ১৯৯৯ সালে এই হাওরকে ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া বলে ঘোষণা দেয়। হাওর অববাহিকাকে একটি র্যামসার সাইট বা আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান বলেও ঘোষণা দেওয়া হয়। সুন্দরবনের পর এটিই দেশের দ্বিতীয় র্যামসার সাইট।
পরিবেশবাদীরা ইতোমধ্যেই হাওরে ইঞ্জিনচালিত নৌকাচালনা এবং পানিতে আবর্জনা ফেলা নিষিদ্ধ করতে সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মীরা পানি দূষণ রোধের জন্য হাওরের মাঝিদের মাঝে ডাস্টবিন বিতরণ করেছেন এবং তাদেরকে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান বাবু বলেন, 'এই হাওর আমাদের দেশের একটি সম্পদ। তাই এটিকে আমাদের নিরাপদ রাখতেই হবে। সেই লক্ষ্যেই আমরা জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্যে প্রচারণা চালাচ্ছি এবং নৌকার মাঝিদের মাঝে ডাস্টবিন বিতরণ করেছি।'