এটা পরিষ্কার হত্যাকাণ্ড
'প্রত্যেক ফ্লোরে একটা করে বাধা।'
'জানালার এই গ্রিলগুলো দেখেন। এগুলো তো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।'
'ঘটনাটা একদম তাজরিন অগ্নিকাণ্ডের মতো।'
ইলেকট্রনিক সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটিজ অফ বাংলাদেশ (ইএসএসএবি)-এর একটি পরিদর্শক দলের একেবারে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ এগুলো।
নারায়ণগঞ্জের সেজান জুস ফ্যাক্টরির ধ্বংসস্তূপে প্রবেশ করেই ওপরের মন্তব্যগুলো করেন তারা। এখানেই শুক্রবার আগুনে পুড়ে মারা গেছেন ৫২ জন শ্রমিক। নিরাপত্তা ও অগ্নি প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর অনীহার সংস্কৃতির নির্মম বলি হয়েছেন তারা।
সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. আবুল হাসেম গতকাল দাবি করেছেন, তিনি নিজের হাতে আগুন লাগাননি। এই ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে দাঁড়িয়ে তার দাবিটাকে নির্মম ব্যঙ্গ মনে হয়।
ইএসএসএবি-র পরিদর্শক দল অবশ্য মো. হাসেমের দাবির সঙ্গে একমত নয়।
পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া ভবনের দেয়ালগুলো তখনও গরম। আগুন লাগার আটচল্লিশ ঘণ্টা পরও ধোঁয়া উড়ছে ওই ভবন থেকে।
আগুনে গলা যাওয়া প্লাস্টিকের স্তূপ পরীক্ষা করতে শুরু করে পরিদর্শক দল। হাজার হাজার পোড়া কার্টন, প্লাস্টিকের বোতল, প্লাস্টিকের ছোট ছোট প্যাকেট ও অজস্র ললিপপের গাদা পরীক্ষা করে দেখেন তারা।
প্লাস্টিক। প্লাস্টিকই আসল কালপ্রিট—পরিদর্শক দলের এক সদস্যের মন্তব্য।
জানালাগুলোর কোনোটা আগুনে ভেঙেছে, কোনোটা শ্রমিকরা জীবন বাঁচানোর জন্য ভেঙেছেন। ওই ভাঙা জানালা দিয়ে আলো আসছিল অন্ধকার কারখানার ভেতরে। তাতে আলোকিত হয়ে উঠেছে ঘরের মেঝে।
সাদা মার্বেল পাথরের টাইল করা সিঁড়ি এমনভাবে পুড়ে ফেটে গেছে যে, টাইল আর চেনার উপায় নেই। সিঁড়ি টপকে যত ওপরে উঠবেন, অন্ধকার ততই বাড়তে থাকবে।
অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠলে পাবেন নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু সেই আশ্রয়টাও নিষ্ঠুরভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল ইস্পাতের বেড়া দিয়ে।
ইমন নামে এক দমকল কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শ্রমিকরা ছাদে উঠতে পারলে সবার জীবন বাঁচানো যেত।
তিনি বলেন, 'প্রথমদিন আমরা ছাদ থেকে ২৫ জনকে উদ্ধার করেছি। আরও শ্রমিক ছাদে উঠতে পারলে, আরও বেশি প্রাণ বাঁচানো যেত।'
ইমন জানান, আশপাশের পুকুর ও জলাশয়ের মতো প্রাকৃতিক উৎসগুলো থেকে দ্রুত পানি আনা গেছে বলে আগুন দ্রুত নেভানো সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, 'আমরা একবারে মাত্র ২ হাজার লিটার পানি বহন করতে পারি। এই পুকুরগুলো না থাকলে আগুন নেভাতে কয়েকদিন লেগে যেত।'
পুকুরগুলো অবশ্য প্রকৃতির আশীর্বাদ। কারখানা কর্তৃপক্ষ ওগুলো খনন করায়নি।
কারখানা কর্তৃপক্ষকে আসলে তাদের দায় এবং কারখানার বিভিন্ন তলার অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খল অবস্থা সম্পর্কে কোনো প্রশ্নই করা যায়নি। কিন্তু নিরাপত্তা সরঞ্জাম কিংবা শ্রমিকদের সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা না থাকার দৃশ্য দেখে একটা শব্দই আসে মাথায়—'হত্যাকাণ্ড'।
ইএসএসএবির সহসভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ মনজুর আলম বলেন, 'এখানে কোনো স্প্রিঙ্কলার নেই, হাইড্র্যান্ট নেই, নেই ইভাকুয়েশন প্ল্যানও। এখানে কোনো নিয়মকানুন মানা হয়েছে বলে মনে হয় না।'
বিষণ্ণ হাসি দিয়ে মনজুর আলম বললেন, তারা শুনেছেন শ্রমিকরা যাতে তাদের নিজের হাতে বানানো ললিপপ ও জুস চুরি করতে না পারেন, সেজন্য নাকি প্রতি তলায় তালা মারা ছিল।
একমাত্র জরুরি নির্গমন পথটাও বানানো হয়েছে নামমাত্র। সেটা দেখিয়ে মনজুর আলম বলেন, 'আইন অনুসারে, চারটা সিঁড়ি রাখা বাধ্যতামূলক। মাত্র একটা নয়।'
কোনো এগজস্ট ফ্যান না থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এখানে প্রত্যেকটি মৌলিক নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়েছে।'
একটা কারখানা এরকম মৌলিক নিয়ম কীভাবে লঙ্ঘন করতে পারে, এ প্রশ্ন তুলে মনজুর আলম বলেন তিনি নিজেও বিভ্রান্ত বোধ করছেন। কারখানার ব্লুপ্রিন্ট কীভাবে অনুমোদন পেয়েছে, কিংবা আদৌ অনুমোদন পেয়েছে কি না, তা-ও বুঝতে পারছেন না তিনি।
একটা ভবন কীভাবে একইসঙ্গে উৎপাদন ইউনিট ও স্টোরেজ দুটো হিসেবেই ব্যবহৃত হয়—এ প্রশ্ন তুললেন ফায়ার সার্ভিসের আরেক কর্মকর্তা।
ঝুলকালি মাখা এই হলঘরগুলোতে তাদের প্রশ্নের উত্তর নেই। ঘটনাস্থলে কারখানার কোনো কর্মকর্তাকে দেখা যায়নি। নানা গুজব আর উড়ো খবর ভেসে বেড়াচ্ছে চারপাশের বাতাসে। অবশ্য সবচেয়ে সোজাসাপটা ব্যাখ্যাগুলোই বেশিরভাগ সময় সত্য প্রমাণিত হয়: এখানে কোনো ষড়যন্ত্র হয়নি; হয়েছে কেবল চরম উদাসীনতা ও অযোগ্যতার প্রদর্শনী।