ঐতিহ্যের স্থাপনা এখন জঞ্জাল!
১৯৩৬ সালে সিলেট শহরের সুরমা নদীর তীরের চাঁদনীঘাট এলাকায় নির্মিত হয় 'সারদাস্মৃতি ভবন'। সংস্কৃতি চর্চার বিকাশে সিলেটের একটি ঐতিহ্যবাহী ব্যবসায়ী পরিবার ৩৯ শতক ভূমিতে কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউটের আদলে এই মিলনায়তনটি নির্মাণ করে। এরপর থেকে সিলেটের প্রথম এই মিলনায়তনে গান, নাটকসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। পরবর্তীতে সিলেট পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়ে আসছে এ ভবনটি।
তবে গত কয়েকবছর ধরে ঐতিহ্যবাহী এই ভবনকে রীতিমত ভাগাড়ে পরিণত করেছে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। সারদা হল প্রাঙ্গণে ফেলে রাখা হয়েছে সিসিকের বিকল গাড়িসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। মিলনায়তনের ভেতরে ফেলে রাখা হয়েছে বইয়ের স্তুপ। এতে করে সারদা হলে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড। ঐতিহ্যবাহী এই ভবনটিও অযত্নে নষ্ট হয়ে পড়ছে।
এ নিয়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে। বিভিন্ন স্থানে ধর্না দিয়েও কোনো সুফল পাচ্ছেন না তারা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিলেট-১ আসনের সাংসদ ড. একে আবদুল মোমেন সারদা হল চত্বরের জঞ্জাল সরিয়ে এলাকাটি সংস্কৃতি চর্চার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার জন্য সিসিক মেয়রের কাছে ডিও লেটার প্রদান করেছেন।
কেবল সারদা হলই নয়, এই ভবনের পাশেই সিলেটের আরও দুটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা কিনব্রিজ ও আলী আমজদের ঘড়ির অবস্থান। এসব স্থাপনার আশপাশের এলাকা দখল করে গাড়ি পার্কিংয়ের স্থান হিসেবে ব্যবহার করছে সিটি করপোরেশন। দিনভর সিসিকের বিভিন্ন পরিষেবার গাড়ি দাঁড় করানো থাকে এই এলাকায়। ফলে এখানে বেড়াতে আসা পর্যটকরা পড়েন বিপাকে। বিকেলে সুরমা নদীর তীরে বেড়াতে আসা মানুষজনও সিসিকের গাড়ির কারণে দুর্ভোগে পড়েন।
জানা যায়, সিলেট নগরীর বন্দরবাজার এলাকার পুরনো নগরভবন ভেঙ্গে নতুন ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১২ সালে। এসময় সুরমা নদীর তীরের তোপখানা এলাকায় সিটি করপোরেশন পরিচালিত 'পীর হাবিবুর রহমান' পাঠাগারে সিসিকের অফিস অস্থায়ীভাবে স্থানান্তর করা হয়। আর পাঠাগারের বই এনে স্তুপ আকারে রাখা হয় সারদা হলের ভেতরে। এছাড়া হলের মূল ভবনের পাশের ছোট ভবনগুলোতে সিসিকের কয়েকটি দপ্তরের কার্যক্রম চালু করা হয়। সেসময় সিসিকের কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, নতুন নগর ভবনের কাজ শেষ হওয়ার পর পুনরায় পীর হাবিবুর রহমান পাঠাগার চালু হবে এবং সারদা হল সংস্কৃতি চর্চার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
এরপর ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে সিসিকের নবনির্মিত ভবনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পর স্থায়ী ভবনে নিয়ে আসা হয় সিসিকের কার্যক্রম। তবে স্থায়ী ভবনে আসার প্রায় সাড়ে তিন বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত চালু হয়নি পীর হাবিবুর রহমান পাঠাগার। সারদা হলও সংস্কৃতি চর্চার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়নি। উল্টো এ ভবনকে ভাগাড়ে পরিণত করেছে সিসিক।
গত বৃহস্পতিবার এই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সারদা হল কমপ্লেক্সের ভেতরে এবড়ো-থেবড়োভাবে সিসিকের বিকল হয়ে যাওয়া গাড়িগুলো ফেলে রাখা হয়েছে। পানির গাড়ি, বুলডোজারের যন্ত্রাংশও ফেলে রাখা হয়েছে আঙিনাজুড়ে। সিসিকের কয়েকজন কর্মচারীর আবাসন ব্যবস্থাও করা হয়েছে এই চত্বরে। আর পীর হাবিবুর রহমান থেকে আনা বই দীর্ঘদিন থেকে হল রুমে স্তুপ করে ফেলে রাখার কারণে বেশিরভাগ বই-ই ইতোমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে। একসময়ের সিলেটের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের স্থানটি এখন পরিণত হয়েছে আবর্জনার ভাগাড়ে। মূল ভবনটিও অবহেলায় নষ্ট হয়ে পড়ছে।
সারদা হলের পাশের কিনব্রিজ ও আলী আমজদের ঘড়ি এলাকায় সুরমা নদীর তীর দখল করেও এলোপাতাড়িভাবে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখেছে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ।
যদিও প্রায় এক যুগ আগে নদী তীরের এই স্থানটির অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে নগরবাসীর বেড়ানো ও বিনোদনের জন্য দৃষ্টিনন্দনভাবে সাজিয়েছিলো সড়ক ও জনপথ বিভাগ।
এ ব্যাপারে সম্মিলিত নাট্য পরিষদ, সিলেটের সাধারণ সম্পাদক রজতকান্তি গুপ্ত বলেন, "এই হলটি একজন ব্যক্তি সংস্কৃতি চর্চার জন্যই নির্মাণ করেন এবং দান করেছিলেন। এই ভবনকে ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা অনৈতিক। এটি সিলেটের একটি ঐতিহ্যবাহী ভবন। এটি রক্ষা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব"।
তিনি বলেন, "এই ভবনটি সংস্কার করে পুরো এলাকা নিয়ে একটি সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স করার দাবি জানিয়ে আসছি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের কাছেও এ দাবি জানিয়েছি। তারা সরেজমিনে পরিদর্শন করে আমাদের দাবির সাথে একমতও হয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সিসিকের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে ডিও লেটারও প্রদান করেছেন"।
রজত বলেন, "সিসিক মেয়র আমাদের দাবির সাথে একাত্মতা পোষণ করে ঐতিহ্যবাহী এ ভবন থেকে সিসিকের জঞ্জাল সরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু তিনি কেবল সময়ক্ষেপণ করেই চলছেন"।
তিনি বলেন, "সিলেট শহরে কবি নজরুল অডিটরিয়াম নামে একটি মাত্র সরকারি মিলনায়তন রয়েছে। এটির ভাড়া অনেক বেশি এবং সারাবছর সরকারি নানা অনুষ্ঠান লেগে থাকে। ফলে অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠন ওই মিলনায়তন ব্যবহারের সুযোগ পায় না। এ অবস্থায় সারদা হল দ্রুত সংস্কৃতি চর্চার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি"।
এ ব্যাপারে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিধায়র রায় চৌধুরী বলেন, "সিসিকের নিজস্ব কোনো পার্কিং এলাকা নেই। ফলে আমাদের গাড়িও নদী তীরবর্তী এলাকায় পার্কিং করা হয়। পার্কিং প্লেসের জন্য একটি জায়গা অধিগ্রহণের পরিকল্পনা আমাদের আছে। যেখানে গাড়ি মেরামতের ব্যবস্থাও থাকবে। শীঘ্রই এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ে ডিপিপি পাঠানো হবে। নিজস্ব পার্কিং প্লেস হয়ে গেলে নদী তীরবর্তী জঞ্জাল আর থাকবে না"।
সারদা হল সংস্কার এবং সংস্কৃতি চর্চার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "এ বিষয়টি মেয়র দেখভাল করছেন। তিনিই এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবেন"।
সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, "সারদা হলকে ঘিরে একটি পূর্ণাঙ্গ কালচারাল কমপ্লেক্স গড়ার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। তবে করোনার কারণে এর কার্যক্রম শুরু করতে কিছুটা দেরী হচ্ছে"।