ওয়াসার পানিতে মিলেছে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী ক্ষতিকর উপাদান
রাজধানীর ওয়াসার কলের পানিতে ক্যান্সারসহ মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর মারাত্মক সব রাসায়নিক উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ক্ষতিকারক এসব উপাদানের মধ্যে আছে- টেক্সটাইল, জাহাজ ভাঙারি, তেল পরিশোধন, প্রসাধন সামগ্রী, পরিষ্কারক এবং শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ। দূষিত এই পানি গ্রহণ মারাত্মক স্বাস্থ্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্বব্যাপী শিল্প উৎপাদনে বহুল ব্যবহৃত দুই রাসায়নিক যৌগ হল পারফ্লুরোঅকটানোয়িক এসিড (পিএফওএ) এবং পারফ্লুরোঅক্টেন সালফোনিক এসিড (পিএফওএস)। সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় সারফেস বা পৃষ্ঠজল এবং কলের পানি- উভয় জায়গাতেই উপাদান দুটির উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞরা নগরের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা থেকে দ্রুততার সাথে ক্ষতিকর পদার্থগুলো অপসারণের পরামর্শ দিয়েছেন। তা না হলে, বিষাক্ত এই পানি মানবদেহে প্রাণঘাতী প্রভাব ফেলতে পারে।
ঢাকার লালমাটিয়া, বনানী এবং সাভারের পানপাড়া বাজার থেকে ২০১৯ সালে নমুনা হিসেবে পানি সংগৃহীত হয়। পরবর্তীতে বেসরকারী সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও) তত্ত্বাবধানে যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির গবেষণাগারে নমুনা পরীক্ষিত হয়। সম্প্রতি "পিএফএএস বাংলাদেশ সিচুয়েশন রিপোর্ট ২০২০" গবেষণার প্রতিবেদনে ভয়ংকর এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী লালমাটিয়ার পানিতে সর্বোচ্চ ৮ পিপিটি (পার্টস পার ট্রিলিয়ন) মাত্রার পিএফওএ পাওয়া গেছে। অন্যদিকে পানপাড়া এবং বনানীর পানির নমুনায় এ মাত্রা যথাক্রমে ৬.৮ এবং ৫.১৮ ।
অন্যদিকে, পানপাড়া, লালমাটিয়া এবং বনানীতে পিএফওএসের পিপিটি মাত্রা যথাক্রমে ২.৬, ২.৩ এবং ১।
পিএফওএ এবং পিএফওএস দুটো যৌগই মানবদেহের জন্য বিষাক্ত পার এন্ড পলিফ্লুরো অ্যালকাইল সাবটেন্স (পিএফওএস) রাসায়নিক গোষ্ঠীর সদস্য। প্রায় সাড়ে চার হাজারের বেশী মানবসৃষ্ট রাসায়নিক পদার্থ পিএফএওএস গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।
ইএসডিও ঢাকা ও আশেপাশের এলাকায় পৃষ্ঠজল ও ট্যাপের পানিতে পিএফএওএস গোষ্ঠীর সর্বাধিক ক্ষতিকর তেরোটি যৌগের উপস্থিতি নির্ণয়ে গবেষণাটি পরিচালনা করে।
প্রতিবেদনটি পর্যালোচনার পর ওয়াসা পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের পরিচালক ড. গোলাম মোস্তাফা।
"আমাদের হাতে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিবেদন আসেনি। আমরা প্রতিবেদনটি সংগ্রহ করে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে প্রেরণ করব," বলেন তিনি।
স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব
২০১৭ সালে পার্সিস্টেন্ট অরগানিক পলিউট্যান্টসের (পপস) সম্পর্কিত স্টকহোম কনভেনশনের পর্যালোচনা পরিষদ পিএফওএ যৌগের সাথে উচ্চ কোলেস্টেরল, আলসারেটিভ কোলাইটিস, থাইরয়েড, টেস্টিকোলার ক্যান্সার, কিডনি ক্যান্সার এবং গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপসহ মানব দেহের জটিল সব রোগের সম্পৃক্ততা চিহ্নিত করে।
পরীক্ষায় দেখা গেছে, পরিবর্তিত প্রাকৃতিক অবস্থাও পিএফওসের কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। এই দুটি রাসায়নিক পদার্থের সাথে অনান্য পিএফএএস মিলিতভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বহুগুণে বাড়িয়ে তুলে।
বায়ু, পানি ও খাদ্যসহ পারিপ্বার্শিক পরিবেশের মাধ্যমে মানুষ পিএফওএ এবং পিএফওএসের সংস্পর্শে আসতে পারে।
প্রতিবেদনে প্রাপ্ত তথ্য দিচ্ছে সতর্ক বার্তা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন ঢাকার পানিতে পিএফএসের উপস্থিতি এক জরুরি সতর্ক বার্তা বহন করছে। এই পদার্থগুলো সহজে পরিবর্তিত হয় না এবং স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তারা বলছেন, যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে মাটি, পানি ও বায়ুতে এই রাসায়নিক উয়াপাদানের উপস্থিতি আরও বাড়বে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পণ্যের উৎপাদনে এসব ক্ষতিকর পদার্থের ব্যবহার অপসারণ করতে হবে। যেসব শিল্প-কারখানা এসব উপাদান ব্যবহার করছে তাদেরও সরে আসতে হবে।
পিএফওএস এবং এর সংশ্লিষ্ট উপাদানগুলো অগ্নিনির্বাপক ফোম, কার্পেট, চামড়ার পণ্য, গৃহসজ্জা সামগ্রী, প্যাকেজিং, ঘর এবং কারখানা পরিষ্কারকারী পণ্য, কীটনাশক, ফটোগ্রাফ্রিক অ্যাপ্লিকেশনস, সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন, হাইড্রোলিক ফ্লুইডস, ক্যাথেটার এবং ধাতব প্ল্যান্টিং ইত্যাদি পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।
অন্যদিকে পিএফওএ ও সম্পর্কিত যৌগগুলো টেক্সটাইল, ননস্টিক প্যান, অগ্নি-নির্বাপক ও মেডিক্যাল সরঞ্জামাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সাবেক চেয়ারপারসন ড. আবু জাফর মাহমুদ বলেন, "পিএফএএস অত্যন্ত বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ। মানব দেহের রক্ত থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত উপাদানগুলো প্রভাব রাখে। এদের প্রভাবে ক্যান্সার হতে পারে। আমরা মার্কারি এবং সীসার ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কে জানি। তবে পিএফএএসের সংস্পর্শে কী ধরনের ক্ষতি হতে পারে, তা এখনও পুরোপুরি জানা যায়নি। এই উপাদানগুলো জন্মের আগেই শিশুকে আক্রান্ত করতে পারে।"
ইএসডিওর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দীকা সুলতানা বলেন, "বাংলাদেশে কোন কোন পণ্যে এসব পদার্থ ব্যবহৃত হচ্ছে তা আমরা পরিষ্কার জানি না। উপাদানগুলোর উৎস সংক্রান্ত কোনো গবেষণাও নেই। সাধারণত তেল পরিশোধক, শক্তি উৎপাদনকারী, জাহাজ-ভাঙা, প্রসাধন প্রতিষ্ঠান, কাঠ, রঙ, কাগজ এবং পাল্প, পরিষ্কারক, মোম এবং মেঝে পলিশ, অগ্নিনির্বাপক ফোম, পিভিসি এ রাবার কারখানা এবং ফটোগ্রাফি শিল্পে কেমিক্যালগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে।"
"আমরা ঢাকা ওয়াসার কলের পানিতে এই রাসায়নিক উপাদানগুলো পেয়েছি। ঢাকা ইপিজেডে পানির প্রবাহে উচ্চমাত্রায় উপাদানগুলো পাওয়া গেছে। এর অর্থ হল, ইপিজেড শিল্পাঞ্চল থেকে পরিবেশে এই ক্ষতিকর উপাদানগুলো নিঃসৃত হচ্ছে," জানান সিদ্দীকা।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিবেচনায় রাসায়নিক উপাদানের মাত্রা ৭০ পিপিটিতে রাখার নির্দেশনা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি।
এসম্পর্কে সিদ্দীকা সুলতানা বলেন, "পশ্চিমা বিশ্ব বেপরোয়া ভাবে শিল্পায়নের কারণে তাদের পরিবেশকে ধ্বংস করছে। এখন তারা টেক্সটাইল এবং জাহাজ-ভাঙার মতো বিপজ্জনক শিল্পগুলোর ক্ষতিকারক উপাদান থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে কারখানা স্থানান্তরিত করছে। এখনই রাসায়নিক পদার্থগুলো পরিহার করা শুরু করলে, পিএফএএসের ক্ষেত্রে আমরা তাদের থেকে অনেক ভালো অবস্থানে থাকব।"
"প্রথমে আমাদের উৎসগুলো ঠিকভাবে চিহ্নিত করতে হবে। দেরী হয়ে যাওয়ার আগেই উপাদানগুলো সরাতে আমাদের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে," যোগ করেন তিনি।
সিদ্দীকা আরও বলেন, "পলিথিন ব্যাগ বিশ্বে প্রথম নিষিদ্ধ করেছি আমরা। পিএফএএস এবং এ সংক্রান্ত পণ্যগুলো বর্জনের মাধ্যমে আমরা আরেকটি উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করতে পারি।"
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতোমধ্যেই পিএফওএ এবং পিএফওএস নিয়ন্ত্রণে রেগুলেশন জারি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি অঙ্গরাজ্যেও পানীয় জলে পিএফএএসের মাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান স্বেচ্ছায় পিএফওএ এবং পিএফওএস উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে।
পৃষ্ঠজলে পিএফএএস
পৃষ্ঠজলেও উচ্চমাত্রায় ক্ষতিকর এসব উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সাভারের আশুলিয়ার টেক্সটাইল শিল্পনগরীর নিকটবর্তী কর্ণতলী নদীতে পিএফওএর মাত্রা ৫১৫.২ পিপিটি এবং পিএফওএসের মাত্রা ৩৮১.৯ পিপিটি। অন্যদিকে, সাভারের ব্যাংক টাউন অঞ্চলের কাছে নদীর পানিতে ৭০.৬৩ পিপিটি মাত্রার পিএফওএ এবং ৯১.৯২ পিপিটি মাত্রার পিএফওএস পাওয়া গেছে।
এদিকে, তুরাগ নদীর পানির নমুনায়, নদী মধ্যবর্তী অংশের পানিতে ৬৫.৯৬ পিপিটি মাত্রায় পিএফওএ পাওয়া গেছে। পিএফওএ এবং পিএফওএস ছাড়া এই এলাকাগুলোতে কলের পানি ও পৃষ্ঠজলে পিএফএএস রাসায়নিক গোষ্ঠীর আরও ১০ টি ক্ষতিকারক উপাদান পাওয়া গেছে।
স্টকহোম কনভেনশন
পার্সিস্টেন্ট অরগানিক পলিউট্যান্টস (পপস) সম্পর্কিত স্টকহোম কনভেনশন ইতোমধ্যে পিএফওএ উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধে বিভিন্ন দেশকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে আহ্বান জানিয়েছে। এছাড়া পিএফওএ উৎপাদন এবং ব্যবহার সীমিত এবং নিয়ন্ত্রিত করার পরামর্শ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
কনভেনশনের বিশেষজ্ঞ দল (পিওপিআরসি) কোনো রাসায়নিক উপাদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনটি টেকনিকাল বা প্রযুক্তিগত মূল্যায়ন পরিচালনা করে থাকে। উপাদানটি প্রথম তিনটি ধাপ পার করলে বিশেষজ্ঞ দল চতুর্থ ধাপে বিবেচনার প্রস্তাব দিতে পারে। চতুর্থ ধাপে বিবেচনার মধ্য দিয়ে উপাদানটির উৎপাদন ও ব্যবহার পরিহার অথবা নিয়ন্ত্রনের জন্য কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজের (কপ) মাধ্যমে তালিকাবদ্ধ করা হয়।
বাংলাদেশ স্টকহোম কনভেনশনে স্বাক্ষর করলেও এখন পর্যন্ত পার্সিসটেন্ট অরগানিক পলিউট্যান্টস হিসেবে পিএফওএস এবং পিএফওএর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে নেয়নি। তবে আগামী ছয় মাসের মধ্যে অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদানের সাথে পিএফএএসের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।
পরিবেশ অধিদপ্তরের জলবায়ু পরিবর্তন ও আন্তর্জাতিক কনভেনশনের পরিচালক মির্জা শওকত আলী জানান, "স্টকহোম কনভেনশন ইতোমধ্যে রসায়নিক এই উপাদানগুলোকে পারসিসটেন্ট অরগ্যানিক পলিউট্যান্টস হিসেবে চিহ্নিত করছে। আমরা আগামী ছয় মাসের মধ্যে নতুন করে যুক্ত এই উয়াপাদানগুলোর বিষয়ে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিব। পরবর্তীতে আমরা যথাযথ আইনের মাধ্যমে কেমিক্যালগুলোর উৎপাদন এবং ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং পরিহার সংক্রান্ত আদেশ জারি করব।
তবে রাসায়নিক উপাদানগুলো স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক বলে স্বীকার করেন তিনি।
- সংবাদটি ইংরেজিতে পড়ুন: Cancer-causing toxic chemicals found in Dhaka's tap water