করোনাভাইরাস ভ্যাকসিনের ড্রাই রানের পরিকল্পনা নেই
কীভাবে ভ্যাকসিন দেওয়া হবে, তা বুঝতে দেশজুড়ে ড্রাই রান করেছে ভারত। বাংলাদেশে ভ্যাকসিনেশন শুরুর আগে ড্রাই রান করা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এখন পর্যন্ত দেশে ড্রাই রান পরিচালনার পরিকল্পনা নেই। তবে সীমিতসংখ্যক মানুষের ওপর পাইলট টেস্ট করা হতে পারে।
কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ম্যানেজমেন্ট টাস্কফোর্সের মেম্বার সেক্রেটারি ডা. শামসুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমাদের ড্রাই রান বা অন্য কোনো প্র্যাকটিক্যাল রান করব কি না, সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে একটা প্রিলিমিনারি আলোচনা চলছে দেশে ভ্যাকসিন এলে কিছু মানুষের ওপর একটা ট্রায়াল দেওয়া হবে। সেই সংখ্যাটা কম, এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। যারা ভ্যাকসিন দেবে, তাদের ওপর এ ট্রায়াল দেওয়া হবে। এই প্ল্যান আমরা পাবলিক হেলথ এক্সপার্টদের বলেছি। তারা এটি যাচাই-বাছাই করে বিভিন্ন ধরনের মডেলও দিতে পারেন।'
ডা. শামসুল হক আরও বলেন, 'আমরা প্রপোজাল দিয়েছি তিনটি জায়গায় ট্রায়াল দেওয়ার। আবার হয়তো কোনো একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও ট্রায়াল হতে পারে। জাতীয়ভাবে ভ্যাকসিনেশনের আগে কিছু মানুষকে ভ্যাকসিনেটেড করে আমাদের প্রস্তুতি দেখা হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'ভারত অনেক বড় দেশ, ভ্যাকসিনটাও তাদের, তারা ড্রাই রান, ট্রায়াল সবই করছে। আমাদের ভ্যাকসিন ইমপোর্ট করতে হবে।'
'প্রস্তুতি কী রকম তা দেখার জন্য ড্রাই রান। আমি চট্টগ্রামে এসেছি প্রস্তুতি দেখতে। এখানকার ডিভিশনাল ডিরেক্টর, সিভিল সার্জন, যারা কাজ করবে সবাইকে নিয়ে একটা প্রস্তুতিমূলক মিটিং ও প্রাকটিক্যাল করলাম। এভাবে এক-দুইটা ডিভিশন দেখে পরে সারা দেশের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা হবে,' বলেন ডা. শামসুল হক।
এদিকে শনিবার এক অনুষ্ঠানে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. এ. এফ. এম. রুহাল হক বলেন, জাতীয়ভাবে ভ্যাকসিনেশন শুরু করার আগে ভারতের মতো আমাদের ড্রাই রান শুরু করা উচিত, যাতে ভ্যাকসিন দিতে গেলে কোনো সমস্যা থাকলে তা সমাধান করা যায়।
তবে প্রখ্যাত ভাইরোলজিস্ট এবং ন্যাশনাল টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজারি কমিটি অব কোভিড-১৯-এর সদস্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমাদের জন্য ড্রাই রান জরুরি না। আমাদের ভ্যাকসিন সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে আর অ্যাডভার্জ রিঅ্যাকশন ওয়াচ করতে হবে। এছাড়া ভ্যাকসিনেটেড করার পর সীমিতসংখ্যক মানুষের নিয়মিত অ্যান্টিবডি টেস্ট করা উচিত।'
'ভ্যাকসিনেশন নিয়ে সমাজে যেন বিভক্তি তৈরি না হয়'
বিজ্ঞানসম্মত যুক্তির ভিত্তিতে স্বচ্ছতা বজায় রেখে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন দিতে হবে। সব মানুষ ভ্যাকসিন নিতে চায় কি না, তা নিয়ে গবেষণা করতে হবে। ভ্যাকসিনের বিকল্প সোর্স খোঁজার পাশাপাশি ট্রায়ালের মাধ্যমে ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।
শনিবার সকালে রাজধানীর বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) অডিটরিয়ামে বাংলাদেশে হেলথ রিপোর্টার্স ফোরাম আয়োজিত কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনা: প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ' শীর্ষক এক সংলাপে এসব কথা বলেন বিশেষজ্ঞরা।
অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য উপস্থাপনের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, 'কে টিকা পেল আর কে পেল না, এই টানাপড়েনে সমাজে যেন বঞ্চনার অনুভূতি তৈরি না হয়, সমাজ যেন বিভক্তির দিকে না যায়। ভ্যাকসিন কার্যক্রমের সফলতা নির্ভর করে স্বচ্ছতার ওপর।'
জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, 'সমাজের সবাই ভ্যাকসিন নিতে নাও চাইতে পারে, এ বিষয়ে একটি জরিপ হওয়া জরুরি।'
ন্যাশনাম কমিটি অন হেলথ রাইটস মুভমেন্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. রাশিদ-ই-মাহবুব বলেন, 'আমার কাছে মনে হয়েছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিজে স্বচ্ছ নয়। তাদের অব্যবস্থাপনার জন্য জাতি এর আগেও ভুগেছে। আমি মনে করি, তারা আগামীতেও আমাদের ভোগাবে।'
তিনি বলেন, 'আপনারা বলছেন (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়), একটা অ্যাপ তৈরি করবেন। কতদিন লাগবে আপনাদের অ্যাপ তৈরি করতে? মানুষ সেই অ্যাপে ঢুকতে পারবে কি না। কারণ সেই অ্যাপের কোয়ালিটি কী রকম হবে? এগুলো কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। এছাড়া ভ্যাকসিন কাদের ফ্রি দেবে, তা স্পষ্ট করা প্রয়োজন। কারণ প্রথমে করোনা টেস্টও ফ্রি করা হয়েছিল। পরে তো টাকা নিচ্ছে।'
ভার্চুয়ালি সংলাপে যুক্ত হয়ে ডিরেক্টরেট জেনারেল অব হেলথ সার্ভিসেসের অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল অধ্যাপক মীরজাদি সাব্রিনা ফ্লোরা বলেন, 'যাদের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি, যাদের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং সংক্রমিত হলে যাদের মধ্যে জটিলতা বা মৃত্যু ঝুঁকি বেশি, সেই ক্রাইটেরিয়া মাথায় নিয়ে অগ্রাধিকার গ্রুপ ঠিক করেছি।'
তিনি বলেন, 'যারা ভ্যাকসিন পাবেন, তাদের তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে আমরা অনলাইন রেজিস্ট্রেশন নিয়ে কাজ করছি এবং আমাদের যে অ্যাপটা তৈরি করা হবে, তা প্রায় সম্পন্নের পর্যায়ে।'
'ভ্যাকসিন কোথা থেকে দেওয়া হবে, কাদের মাধ্যমে দেওয়া হবে, জনবল কারা হবে, তাদের প্রশিক্ষণের বিষয় সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি', যোগ করেন তিনি।
ভ্যাকসিন কার্যক্রমকে বড় রকমের চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'প্রথম ধাপে আমরা ৫০ লাখ টিকা পাব, যেটা আমরা কিনেছি সেখান থেকে। কোভ্যাক্স থেকে কখন পাব সেটা এখনো নিশ্চিত নয়। বলা হচ্ছে ফেব্রুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে। প্রথম প্রান্তিকের মধ্যে পাব, সেটাও বলা হচ্ছে।'
তিনি বলেন, 'প্রথম দফায় যারা টিকা পাবেন, তাদেরকে আলাদা করে টিকা দেওয়া, কারণ সবার মধ্যে টিকা পাওয়ার একটা প্রত্যাশা রয়েছে। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।'
'কখন কোন গ্রুপ টিকা পাবেন, আমরা প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে তা প্রকাশিত করেই টিকাটা দিব। যারা পাবেন কি পাবেন না, এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছেন, তারা জানতে পারবেন, তিনি পাবেন এবং কবে পাবেন,' বলেন তিনি।
তিনি বলেন, 'যেহেতু টিকাগুলো নতুন, সেহেতু এখান থেকে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হওয়ার আশঙ্কা থাকতেই পারে।'
'যে কোনো টিকা বা ওষুধ থেকে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়, সেটা ব্যবস্থাপনার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া, আমাদের কিছু ভেরিফাই কমিটি আগে থেকে রয়েছে, ইপিআইয়ের, সেটার মাধ্যমে এটা কীভাবে নিশ্চিত করা যায়, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার পর ব্যবস্থাপনা আমাদের পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে,' বলেন অধ্যাপক মীরজাদি সাব্রিনা ফ্লোরা।