করোনার করাল গ্রাসেও ভারতীয়দের চেয়ে সুখে ছিল বাংলাদেশিরা?
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়ে জীবনযাত্রা ও অর্থনীতিতে এক বিধ্বংসী প্রভাব সৃষ্টি করেছে কোভিড-১৯ মহামারি। বাংলাদেশ ও ভারতও মহামারির এই করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পায়নি । তবে, ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টের সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, মহামারির সময় প্রতিবেশী ভারতের থেকে বহুগুণে সুখী ছিল বাংলাদেশ।
শুক্রবার প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট ২০২১ অনুযায়ী, ৯৫ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৮তম। প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতের থেকে ২৪ ধাপ এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।
মহামারির বছরে ভারতীয়দের তুলনায় বাংলাদেশিরা বেশি সুখী কেন ছিল সে বিষয়ে সুর্নিদিষ্ট সিদ্ধান্তে আশা বেশ কঠিন বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, "আমি কেবল একটা জিনিসই বলতে পারি, মহামারি ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে জনবহুল ভারতের এখনও অনেক কিছু করা বাকি আছে।"
তিনি আরও জানান, ভাইরাসটি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন মানুষকে বিভিন্ন ভাবে প্রভাবিত করেছে। তবে, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণের ধরন কেন ভিন্ন ছিল সে সম্পর্কে এখন পর্যন্ত কোনও নির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া যায়নি।
শুক্রবার জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন) ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটিতে সুখী দেশ হিসেবে ক্রমানুসারে বিশ্বের ৯৫টি দেশের তালিকা প্রকাশিত হয়। ২০২০ সালে মহামারি চলাকালীন দেশগুলো কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিল, সেই জরিপের উপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনটি তালিকা প্রকাশ করে।
বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়া তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কোনো দেশ ছিল না।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে সবথেকে সুখী দেশের তালিকার শীর্ষে আছে ফিনল্যান্ড। ফিনল্যান্ডের পর শীর্ষ পাঁচে যথাক্রমে আইসল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড এবং নেদারল্যান্ডসের নাম আছে।
'সুখ কখনো কেনা যায় না'
অধ্যাপক নেহাল করিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, সুখী দেশের তালিকা তাকে খুব একটা আশ্বস্ত করতে পারেনি।
"আমাদের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, তার অর্থ এই না যে সমগ্র দেশ কিংবা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীই সুখে আছে এবং তারা তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারছে। সরকারের ঘনিষ্ট বিশেষ এক গোষ্ঠীর কিছু লোক সমস্ত সুযোগ সুবিধাগুলো ভোগ করছে। আপনি তাদেরকে সুখী বলতে পারেন," বলেন তিনি।
সুখী দেশের জরিপ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে তিনি বলেন, জরিপ কীভাবে পরিচালনা করা হয়েছে তা তিনি জানেন না। নমুনার আকার কী ছিল কিংবা কতজন এখানে অংশ নিয়েছে সে বিষয়টিও তার কাছে স্পষ্ট নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
"তারা জরিপের জন্য আমার পরিচিত কারও কাছে বা আমার কাছে আসেননি। আমার মনে হয় না জাতীয় ভাবে বাংলাদেশের সাথে এই জরিপের কোনও সম্পর্ক বা প্রভাব আছে।"
তিনি সুখ বিষয়টিকে আপেক্ষিক বলেও মন্তব্য করেন। দেশ ও সমাজ ভেদে মানুষের সুখী হওয়ায় তারতম্য আছে। সুখের কোনও নির্দিষ্ট মাপকাঠি নেই।
"উদাহরণস্বরূপ, ঈদের দিন পরিবারের কারও সাথে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে, ঈদও মাটি হয়ে যায়। অন্যদিকে, বিশেষ কিছু ঘটলে সাধারণ দিনও ঈদের মতো আনন্দঘন রূপ ধারণ করে।"
তিনি জানান, মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ হলে, তাদের সন্তানরা সুস্থ পরিবেশ এবং ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠলাভ করলে মানুষ সুখী হবে।
"আমাদের এখানে সেসব ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশিরা কেন বিদেশে পাড়ি জমায়? বাইরে গিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা কায়িক শ্রমভিত্তিক বা ছোটখাটো কম পারিশ্রমিকের কাজ করেন। আমাকেও তাই করতে হত। কিন্তু, তারপরও সেসব দেশে সামাজিক নিরাপত্তা থাকায় মানুষ সেখানে যায়।"
নিশ্চিতভাবেই, সামাজিক নিরাপত্তার সাথে সুখী হওয়ার সুদূর-প্রসারী প্রভাব আছে। সুখী দেশের তালিকায় নর্ডিক দেশগুলোর শীর্ষ অবস্থানে থাকার কারণ হিসেবে দৃঢ় সামাজিক নিরাপত্তাকে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
পূর্ববর্তী প্রতিবেদন অনুযায়ী নর্ডিক দেশগুলোর অনন্যতার অন্যতম প্রধান কারণগুলো হল- কার্যকরী গণতন্ত্র, অপরাধ ও দুর্নীতির নিম্ন হার, নাগরিক এবং সরকারের মধ্যে বিদ্যমান বিশ্বস্ততা এবং উদার সমাজ-কল্যাণ সুবিধাদি ইত্যাদি।
মানুষের আকাঙ্ক্ষার সাথে যখন তাদের পারিপ্বার্শিক বাস্তবতা মিলে যায় তখনই তারা সুখী হয় বলে জানান নেহাল করিম। একই পরিস্থিতিতে কখনো সবাই সুখী হতে পারে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
"আপনি টাকা দিয়ে সুখ কিনতে পারবেন না। আপনাকে সেটা অর্জন করতে হবে।"
কোভিড-১৯ এর জন্য দুটি ভিন্ন র্যাংকিং
পূর্ববর্তী তিন বছরের জরিপ ফলাফলের গড় হিসাবের উপর ভিত্তি করে হ্যাপিনেস রিপোর্ট তৈরি করা হয়। যেমন, ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের তথ্যের উপর ভিত্তি করে ২০২০ সালের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।
তবে, ২০২১ সালে ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে মানুষের সমৃদ্ধির সাথে কোভিড-১৯ এর সম্পর্ক নির্ধারণ করা হয়। এবারের প্রতিবেদনে দুটি ভিন্ন র্যাংকিং যুক্ত করা হয়। এর একটি ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের জরিপের উপর নির্ভরশীল হলেও অপরটি কেবল ২০২০ সালের জরিপের উপর নির্ধারিত হয়েছে।
২০১৮ থেকে ২০২০ সালের তথ্যের উপর নির্ধারিত জরিপে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৯ টি দেশের মধ্যে ১০১তম। আগের বছর তুলনায় এই তালিকায় বাংলাদেশ ছয় ধাপ এগিয়েছে। ভূটান ছাড়া এই তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশও আছে। তালিকায় নেপাল ৮৭তম, মালদ্বীপ ৮৯তম, পাকিস্তান ১০৫তম, শ্রীলঙ্কা ১২৯তম, ভারত ১৩৯তম এবং আফগানিস্তান ১৮৯তম অবস্থানে আছে।
২০১২ সাল থেকে শুরু হওয়া হ্যাপিনেস রিপোর্ট প্রাথমিকভাবে মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), আয়ুষ্কাল, উদারতা, সামাজিক সমর্থন, স্বাধীনতা এবং দুর্নীতির ধারণার ভিত্তিতে নির্ধারিত হত।
- সংবাদটি ইংরেজিতে পড়ুন: As Covid-19 raged, Bangladeshis turned out happier than Indians
- অনুবাদ: তামারা ইয়াসমীন তমা