করোনার কারণে অ্যাডভান্স স্টেজের ক্যানসার রোগী বাড়ার শঙ্কা
কোভিড-১৯ নেগেটিভ ছাড়া চিকিৎসা পেতে ভোগান্তি ও হাসপাতালে এসে সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শুরুতে দেশে ক্যানসার রোগীরা হাসপাতালবিমুখ হয়েছিলেন। তাই অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে হাসপাতালগুলোতে ক্যানসার রোগী অনেক বেড়েছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে অ্যাডভান্স স্টেজের ক্যানসার রোগী বাড়ার আশঙ্কা চিকিৎসকদের।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ক্যানসার রিসার্চ হাসপাতালের মেডিকেল অনকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, 'দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম চার থেকে পাঁচ মাসে হাসপাতালে তেমন কোনো রোগী আসেননি। এখন রোগীর খুব চাপ বেড়ে গেছে। আগামী তিন-চার মাস যেসব রোগী আসবেন, তারা অ্যাডভ্যান্স স্টেজে আসবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।'
সাধারণ সময়ে ক্যানসার ইনস্টিটিউটের আউটডোরে দিনে এক হাজারের বেশি রোগী চিকিৎসা নিতেন। গত বছর মার্চের পর আগের তুলনায় তিন ভাগের একভাগ রোগী হাসপাতালে আসতেন।
ডা. মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, 'তিন ভাগের এক ভাগ রোগী হাসপাতালে এলেও রোগ তো তিন ভাগের একভাগ কমেনি। করোনার কারণে যে ডায়াগনোসিস, স্ত্রিনিংগুলো হয়নি, সেটার কারণে করোনা পরবর্তী ইফেক্টটা আরও বেশি হবে। করোনার কারণে ক্যানসার রোগীর মৃত্যু আরও বাড়বে এ বছর।'
ক্যানসার রোগীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন এই চিকিৎসক।
তিনি বলেন, 'ক্যানসার রোগীকে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে অনেক দ্বিধা দেখা যাচ্ছে। তবে আইসিইউতে থাকা ক্রিটিক্যাল রোগী বাদে যেকোনো ক্যানসার রোগীকে ভ্যাকসিন দিতে হবে।'
করোনাভাইরাস আঘাত হানার এক বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেলেও ক্যানসারের ওপর এর প্রভাব বেশ কঠিন হয়ে উঠেছে। 'মহামারির কারণে প্রায় ৫০ শতাংশ সরকারি ক্যানসার সেবা খাতের কাজ আংশিক কিংবা সম্পূর্ণ বিঘ্নিত হচ্ছে,' বলে জানান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ননকমিউনিক্যাবল ডিজিজ বিভাগের ডা. আন্দ্রে ইলবোওয়ি।
তিনি আরও বলেন,' রোগ নির্ণয়ে দেরি হওয়া খুবই পরিচিত একটি ঘটনা। কিন্তু থেরাপি দিতে বিলম্ব বা বাধার সম্মুখীন হওয়ার ঘটনা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এর ফলে সামনের বছরগুলোতে ক্যানসারে মৃত্যুর হার অনেক বেড়ে যাবে।'
গত বছরের জানুয়ারিতে ব্রেস্ট ক্যানসারে আক্রান্ত হন গাইবান্ধার শান্তনা খাতুন (৪০)। ক্যানসার শনাক্ত হওয়ার পর নিয়ম করে দুইবার রাজধানীর ক্যানসার ইনস্টিটিউটে এসে কেমোথিরাপি নিয়েছেন। তবে মার্চের পর দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ার কারণে ক্যানসার চিকিৎসা একেবারে থেমে যায় শান্তনা খাতুনের। নিয়ম করে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়নি তার। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আসার পর গত বছরের নভেম্বর মাসে তিনি আবার হাসপাতালে আসা শুরু করেন। এরইমধ্যে শান্তনা খাতুনের শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে।
ক্যানসার রোগীদের কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি নেওয়ার জন্য প্রত্যেকবার কোভিড-১৯ টেস্ট করতে হয়। কারণ কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগীকে কেমোথেরাপি দিলে মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যায়। আবার ক্যানসার রোগীরা ইমিউনো কম্প্রোমাইজড, তাদের কোভিড-১৯ হলে মৃত্যু ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে, করোনাভাইরাস ক্যানসার রোগীদের ভোগান্তি ও ঝক্কি আরও বাড়িয়েছে।
ক্যানসার গবেষণার জন্য ২০১৮ সালে গ্লোবোকোনের করা একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই দেশে প্রতি বছর দেড় লাখ মানুষের শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ে। ২০১২ সালে এই সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২০ হাজার। ২০১৮ সালে ক্যানসারে মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ৮ হাজার ১৩৭।
ক্যানসার রোগীর সংখ্যা নির্ণয় করার মতো কোনো দেশীয় সংস্থাই এখনো কাজ করছে না।
বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির জয়েন্ট সেক্রেটারি ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'সারা দেশে প্রায় ১৪-১৫ লাখ ক্যানসার রোগী রয়েছেন। প্রতি বছর নতুন করে দুই লাখ রোগী এই তালিকায় যুক্ত হচ্ছেন।'
১৪ জানুয়ারি প্রকাশিত ২০১৫-১৬ সালের হাসপাতালের ক্যানসার রেজিস্ট্রি রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, '২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৭৬ হাজার ৫৪৩ জন রোগী ক্যানসার পরীক্ষার জন্য ভর্তি হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৩৫ হাজার ৩৬৯ জনের শরীরে রোগটি ধরা পড়েছে।'
এই তিন বছরে ফুসফুসের ক্যানসার নিয়ে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ৮৮৭ জন। 'এর পাশাপাশি স্তন ক্যানসারের ৪ হাজার ৯৯৮ জন, গল ক্যানসারের ২ হাজার ৭১৯ জন, খাদ্যনালী ক্যানসারের ১ হাজার ৫৮২ জন, পাকস্থলী ক্যানসারের ১ হাজার ৩৬৬ জন, লিভার ক্যানসারের ১ হাজার ২২৪ জন, লিম্ফোমা ক্যানসারের ১ হাজার ১৭৭ জন, রেক্টাম ক্যানসারের ১ হাজার ৫৪ জন, ওরাল মিউকোসা ক্যানসারের ৮৮৪ জন এবং গলব্লাডার ক্যানসারের ৪৮৫ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন,' বলে ওই প্রতিবেদনে জানা যায়।
আরও জানা যায়, ৭২ শতাংশ রোগী কোনো প্রকার চিকিৎসা নেননি।
এনআইসিআরএইচের ক্যানসার এপিডেমিওলজি বিভাগের প্রধান, ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলেন, 'বাংলাদেশের ক্যানসার রোগীদের এক-তৃতীয়াংশ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। আমরা বাকি রোগীদের অবস্থা সম্পর্কে জানিই না। সরকারের উচিত এইসব রোগীর চিকিৎসার সুব্যবস্থা এবং তাদেরকে রোগ থেকে রক্ষা করা। ক্যানসার যদি প্রাথমিক পর্যায়েই ধরা পড়ে, তাহলে তা থেকে সেরে ওঠার অনেক সম্ভাবনা থাকে। তাই জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা আনা প্রয়োজন।'
আজ (৪ ফেব্রুয়ারি) বিশ্ব ক্যানসার দিবস। এই বছরের থিম, 'আমি আছি এবং আমি থাকব' ('আই অ্যাম অ্যান্ড আই উইল')।