করোনার ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ মোকাবিলার প্রস্তুতি প্রয়োজন
করোনাভাইরাসকে স্বাভাবিক রোগ হিসেবে নিয়ে চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছেন, অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ভাইরাসটির সেকেন্ড ওয়েভ মোকাবিলার প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন।
শনিবার বিকেল সাড়ে ৫টায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত 'কোভিড-১৯: দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় বাংলাদেশ কি প্রস্তুত' শীর্ষক ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে তারা এই মত দেন।
এতে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক পরামর্শক ডা. এম মুজাহেরুল হক, সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরামর্শক ডা. মো. মুশতাক হোসেন এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ।
ওয়েবিনারটি সঞ্চালনা করেন বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র হেলথ স্পেশালিস্ট ডা. জিয়াউদ্দিন হায়দার।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম নিয়মিতভাবে সাপ্তাহিক এই আয়োজন করে আসছে।
দেশের ২২টি জেলায় এখনো করোনার নমুনা পরীক্ষার জন্য পিসিআর টেস্ট ল্যাব নেই এবং সেটা থাকলে টেস্ট করানো সহজ হতো বলে অধ্যাপক ডা. মুজাহেরুল হক বলেন, তার ওপর ফি ধরে দেওয়া হয়েছে, যাতে জনগণ নিরুৎসাহিত হচ্ছে। যার কারণে 'ডিজিজ কার্ভ স্লোলি রাইজিং, ডেথ কার্ভ রাইজিং'।
'করোনা এখন একটা জায়গায় ওঠা-নামা করছে নমুনা পরীক্ষা সেভাবে না হবার জন্য, একইসঙ্গে করোনা মোকাবিলায় কোনো কৌশল আমি দেখতে পাইনি' জানিয়ে তিনি বলেন, 'করোনা মোকাবিলায় সমন্বয়হীনতা সবার নজরে পড়েছে।'
অধ্যাপক মুজাহেরুল হক বলেন, 'শুরু থেকে আমরা বিভিন্ন মুখ থেকে শুনলাম বাংলাদেশ প্রস্তুত, অথচ দীর্ঘদিন পর্যন্ত একটি প্রতিষ্ঠানে পিসিআর মেশিনে টেস্টের সুযোগ ছিল। আবার কতগুলো পিসিআর মেশিন ব্যবহারযোগ্য, সেটা পর্যন্ত জানা ছিল না।'
"'ফার্স্ট ওয়েভ' আমাদের চলছে, কতদিন চলবে জানা নেই' জানিয়ে তিনি বলেন, 'জনগণের যেভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানা উচিত এবং জনগণকে যেভাবে মানানো উচিত- সেই সমন্বয় হচ্ছে না। বাংলাদেশের মানুষ সচেতন; কিন্তু মোটিভেটেডে না। তারা জানে মাস্ক না পরলে সমস্যা হবে; কিন্তু তারা পরছে না।' আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে জনগণকে বাধ্য করার চেষ্টা- তাতেও সরকার ব্যর্থ হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
'আবার দেশে একটানা সংক্রমণ হয়ে আসছে' বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করে তিনি বলেন, 'স্বাস্থ্যমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার ফলে একটি করে সমস্যার উদ্ভব হয়েছে; যে ব্যাখ্যা হয়েছে, সেগুলো করোনা মোকাবিলায় ক্ষতিকর হয়েছে। মন্ত্রী যখন একটা কথা বলেন, তখন আমরা ধরে নিতে পারি এটি স্বাস্থ্য বিভাগের সর্বোচ্চ কথা। আমরা ধরে নিতে পারি, তার বক্তব্যে মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তরের সমর্থন আছে।'
তিনি আরও বলেন, 'সেকেন্ড ওয়েভ' আসার আগে একটি শর্ত, প্রথম ওয়েভটাকে কার্যকরভাবে কমিয়ে আনা; কিন্তু বাংলাদেশ প্রথম ওয়েভ নিয়ন্ত্রণ করার কাছাকাছিও নেই। যদি ধরে নিই, বাংলাদেশ সামনে প্রথম ওয়েভ নিয়ন্ত্রণ করবে, তাহলে দ্বিতীয় ওয়েভ এলে তিনটি সমস্যা দেখছি। ব্যবসায়ী, পোশাক ও পরিবহন সংগঠন নেতাদের কাছ থেকে বাধা আসবে। দীর্ঘদিন তারা নানা বিধিনিষেধ মেনে চলেছে। সীমিত আকারে কিছু বিধিনিষেধ এখনো আছে। বহু লোক চাকরিচ্যুত হলো, ফল পেল কী? পরে গিয়ে আবারও একই ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করতে গেলে স্বাভাবিক কারণেই বাধা আসবে।'
'আবার, স্বাস্থ্যকর্মীদের চরমভাবে ডিমোটিভেট করা হয়েছে, তাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে এবং হোটেল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তাই তাদের রেসপন্স কেমন হবে বলা মুশকিল' মন্তব্য করে অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, 'সিদ্ধান্ত হয়েছে করোনা হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়ার। কিন্তু সেকেন্ড ওয়েভ এলে সেগুলো আবার ফাংশনাল করা কঠিন হবে।'
"এমনিতেই অব্যবস্থাপনার কারণে অনেকে সরকারি হাসপাতালে যায় না, আবার বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা খরচ বেশি; তাই করোনাকে 'স্বভাবিক রোগ' হিসেবে নিয়ে চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী যেভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এই ধারা চলতে থাকলে সেকেন্ড ওয়েভ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না,' বলেন অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ।
'দেশে করোনা মোকাবিলায় পরিকল্পনা হয়েছে একটা, কিন্তু কাজ হয়েছে আরেকটা,' বলে মন্তব্য করেছেন আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, 'পরিকল্পনা ছিল যখন মহামারির চতুর্থ স্তরে যাব, কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হবে, তখন সোস্যাল ডিসটেন্সিং করা হবে। কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ে সব কিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।'
বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত ব্রিফিং বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'করোনা পরিস্থিতি নিয়ে ব্রিফিং হলেও সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সপ্তাহে অন্তত দুবার প্রশ্নোত্তর পর্ব থাকা উচিত, এতে করে জনগণের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব হয়, জবাবদিহিতাও হয়।'
'আবার, যারা কাজ করেছেন জানুয়ারি থেকে, তাদের পরিশ্রম ম্লান হয়েছে জেকেজি ও রিজেন্টের দুর্নীতির কারণে। তবে দুর্নীতিই একমাত্র সমস্যা না। লোক বদল হয়েছে, কিন্তু সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধান করা হয়নি,' বলেন ডা. মুশতাক হোসেন।