কুমিল্লা ও চৌমুহনীর ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়: ঢাবি শিক্ষক সমিতির প্রতিবেদন
সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় কুমিল্লা ও চৌমুহনীতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলার ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির ২২ সদস্যের প্রতিনিধি দল।
গতকাল সোমবার (১৮ অক্টোবর) সকাল ৮টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে রওনা দিয়ে কুমিল্লা হয়ে নোয়াখালির চৌমুহনী পরিদর্শন করেন তারা।
পরিদর্শনকৃত এলাকাগুলো হলো: কুমিল্লার নানুয়ারদীঘির পাড় পূজামণ্ডপ এবং নোয়াখালি চৌমুহনীর রাধা-মাধব জিউ মন্দির, রামঠাকুর আশ্রম, ইসকন মন্দির ও গণিপুর পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়।
পরিদর্শনের ভিত্তিতে পর্যবেক্ষণের প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিদর্শক দল স্থানীয় সাধারণ মানুষ, শিক্ষাবিদ, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, ঘটনাস্থলের আশেপাশের ব্যবসায়ী, মন্দিরের পুরোহিত, আশ্রম কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় প্রশাসনের লোকজন, মেয়র, সংসদ সদস্য, পুলিশ প্রশাসন, সাংবাদিকসহ স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলেন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ঘটনাকে পরিদর্শক দলের কাছে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা বলে মনে হয়নি। সুপরিকল্পিতভাবে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে। স্থানীয় রাজনৈতিক গ্রুপিংয়ের কারণে তৃতীয় পক্ষ এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে। এ বিষয়ে সরকারের উচিত হবে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত করা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৪৬ সালের পরে নোয়াখালিতে বড় ধরনের কোনো সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি বলে জানান স্থানীয়রা। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী প্রশাসনের কাছে এ ধরনের ঘটনার পূর্বাভাস ছিল।
প্রশাসনের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে বিজয়া দশমীর দিন সকাল ১১টা থেকে ১১.৩০ মিনিটের মধ্যেই প্রতিমা বিসর্জন শেষ হয়ে যায়। বিসর্জন শেষে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবাই ঘরে ফেরেন।
জুমার নামাজের পর বিভিন্ন মসজিদে কিছু মানুষ দোয়া-মোনাজাতে অংশ না নিয়ে বের হয়ে আসে। তারা বিভিন্ন ধরনের উত্তেজনামূলক স্লোগান দিয়ে মিছিল নিয়ে পর্যায়ক্রমে ইসকন, রাধা-মাধব জিউ মন্দির, রামঠাকুরের সমাধি ও আশ্রম, বিজয় মন্দিরসহ বিভিন্ন পূজামণ্ডপে আক্রমণ চালায়। এমনকি মেয়েদের গণিপুর পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়েও আক্রমণ চালানো হয়।
স্থানীয়দের বক্তব্য অনুসারে, আক্রমণের ধরন ছিল ভয়াবহ। দীর্ঘ সময় ধরে এসব তাণ্ডবলীলা চললেও পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি সদস্যরা নিষ্ক্রিয় ছিল। ঘটনায় মন্দির, আশ্রম ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও লুটপাট করা হয়।
মন্দির ও আশ্রমে রক্ষিত সামগ্রী, নথিপত্র, ধর্মীয় গ্রন্থ, বিগ্রহ, দেব-দেবী ও ধর্মীয় ব্যক্তিদের ছবি, পোস্টার ধ্বংস করা হয়। স্থাপনায় ভয়াবহ ভাঙচুর ও তাণ্ডবলীলা শেষে আশ্রম প্রাঙ্গনে থাকা দুটি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
হামলার ঘটনায় দুজনের প্রাণহানি ঘটে। নিহতরা হলেন, ইসকন মন্দিরের ভক্ত পান্থচন্দ্র দাস এবং জতনু সাহা, যিনি চাঁদপুর থেকে বোন জামাইয়ের বাড়ি বেড়াতে এসেছিলেন।
এ ঘটনায় অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশ অল্পবয়সী মাদ্রাসার শিক্ষার্থী বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থানীয় অনেকের বক্তব্য অনুসারে কোমলমতি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের প্রতিমা, মূর্তিপূজা রোধ ও ভাঙচুর করলে বেহেস্তের পথ সুগম হবে- এমন ধারণা দেওয়া হয়। তাদের মানবিক মূল্যবোধও শেখানো হয় না।
স্থানীয় রাজনৈতিক গ্রুপিং-এর কারণে হামলাকারীরা নির্বিঘ্নে ঘটনা ঘটিয়ে চলে যায়। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও ভবিষ্যতে নির্বাচনে যারা অংশ নিতে যায়, তাদের ঠেলাঠেলিতে আইন শৃঙ্খলাকারী বাহিনী নিষ্ক্রিয় ছিল বলে অনেকে ইঙ্গিত করেন।
স্থানীয় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। সম্পদের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হলেও মানসিক ক্ষতি কোনোভাবেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। সংখ্যালঘুরা নাগরিক মর্যাদা সম্পর্কে আস্থাহীনতার সংকটে পড়েছেন।
প্রতিনিধিদলে অন্যান্যদের সঙ্গে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. রহমত উল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক নিজামুল হক ভূইয়া, প্রক্টর এ কে এম গোলাম রাব্বানী, ঢাবি শিক্ষক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. মো. আবদুর রহিম, শামসুন্নাহার হলের প্রভোস্ট লাফিফা জামাল, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগের অধ্যাপক শফিউল আলম ভূঁইয়া, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক ড. শামীম রেজা ও ড. আবুল মনসুর আহাম্মদ, অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক অধ্যাপক জিয়া রহমান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ুন কবির, ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নাজমুন নাহার, গণিত বিভাগের অধ্যাপক চন্দ্রনাথ পোদ্দার, অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান প্রমুখ।