কেমন আছেন মিন্নি
বরগুনার বাইশ বছরের তরুণ রিফাত শরীফকে হত্যা করা হয় গত জুনে। শহরের সরকারি কলেজের সামনে তাকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে তারই প্রজন্মের সন্ত্রাসী কিশোর-তরুণরা। রিফাতের পাশে তখন ছিলেন স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। চেষ্টা করেছেন সন্ত্রাসীদের হাত থেকে স্বামীকে বাঁচাতে। পারেননি। আহত রিফাত মারা যান সেদিন বিকেলে, বরিশাল সদর হাসপাতালে।
তারপর থেকে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরব-মুখর সারাদেশ। আসল খুনি কে, নির্দেশদাতা কে এসব নিয়ে সব পক্ষের কথায়-যুক্তিতে ক’মাস ধরে সতেজ মূলধারার গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোও।
এই মঞ্চে শুরুর দিকে যিনি ছিলেন এক ভূমিকায় পরে তিনিই রূপান্তরিত হলেন ভিন্ন চেহারার মানুষে। কিংবা বিভ্রমও তৈরি হল। অথবা পুরোটাই ছিল যেন এক ভ্রান্তি-বিভ্রান্তির মোড়কে ঠাসা জগত।
এ জগতে শেষ পর্যন্ত নিহত রিফাতের স্ত্রী মিন্নি আসামী হলেন এবং জামিন না পেতে পেতেও পেলেন। আক্ষরিকভাবেই নানা আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন তার আইনজীবিরা ও তার পরিবার। শেষে হাই কোর্টের কাছ থেকে পেলেন জামিনের আদেশ।
কিন্তু সঙ্গে দিয়ে দেওয়া হল শর্ত— কথা বলা যাবে না মিডিয়ার সঙ্গে। সেটি মেনেই বরগুনা পৌরসভার মাইঠা এলাকায় মিন্নি দিন কাটাচ্ছেন তার নিজের বাড়িতে। বাবা মোজ্জাম্মেল হোসেন কিশোরের জিম্মায় দিয়েছেন কোর্ট তাকে। মা-ও রয়েছেন সঙ্গে।
ঠিক জানার উপায় নেই কীভাবে কাটছে তার দিনগুলি, তার রাতগুলি। সামান্য কথা হয়েছে তার স্বজনদের সঙ্গে।
বয়সে তরুণ, চঞ্চল, সদহাস্যোজ্জ্বল মেয়েটি। সদালাপীও ছিলেন বরাবর। এত ঘটনার টানাপড়েনে এখন অসুস্থতা তার নিত্যসঙ্গী। মানসিকভাবে সুস্থির নেই খুব। স্বামী রিফাত শরীফের স্মৃতিও তাকে তাড়িত করছে। আর নিঃসঙ্গতার এ সময়ে তাকে ঘিরে রেখেছে একরাশ বিষন্নতা।
স্বজনরা, অভিভাবকরা এতে উদ্বিগ্ন বোধ করছেন এটাও জানা গেল। মোজাম্মেল হোসেন কিশোর জানালেন, তার মেয়ের মন ভালো নেই। তাই কথা বলে না কারও সঙ্গে। খেতেও চায় না কিছু। নিজের ঘরে সবসময় চুপচাপ বসে থাকে। কখনো-সখনো কাঁদতেও দেখা যায় তাকে।
জানা গেল, যে ঘরে মিন্নি এখন থাকছেন সেখানেই রিফাতের সঙ্গে তার অনেক স্মৃতি। এসব স্মৃতি কি তাকে তাড়িত করে? নইলে ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে ওঠেন কেন?
মিন্নির বাবা মনে করছেন, তার মেয়ের কিছু চিকিৎসা দরকার। বললেন, “আমরা মিন্নির আইনজীবীর কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছি। কয়েকদিন পর রিফাত হত্যা মামলার তারিখ রয়েছে। সে তারিখে মিন্নিকে আদালতে হাজির হতে হবে। এরপর ওর উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করব।”
আপাতত চিকিৎসকের পরামর্শে বাড়িতে মিন্নির চিকিৎসা চলছে বলে জানান তিনি।
মিন্নির চাচা আবু সালেহ জানালেন, “নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, ঘুম নেই ওর। আছে শুধু বিষন্নতা। উদাসভাবে একেক সময় একেক দিকে তাকিয়ে থাকে। আমরা মিন্নিকে নিয়ে চিন্তিত, উদ্বিগ্ন।”
আবু সালেহ এটাও জানালেন, মিন্নির জামিনে কারামুক্ত থাকার জন্য আদালতের যেসব নির্দেশনা রয়েছে সেসব মেনেই চলছেন তারা। ওর স্বাভাবিক জীবনযাপন ও চিকিৎসায় যাতে ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য ওর বিষয়ে সাধারণ মানুষকে ঔৎসুক্য প্রকাশ থেকেও সরে আসতে অনুরোধ করলেন তিনি।
বরগুনার আদালতে মিন্নির আইনজীবী মাহবুবুল বারী আসলামের সঙ্গে কথা হল। বললেন, “মিন্নির অসুস্থতার বিষয়টি জানি। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে মিন্নির আইনজীবী জেড আই খান পান্নার সঙ্গেও কথা বলেছি। ওর চিকিৎসার জন্য ওর বাবাকে পারামর্শ দিয়েছি। ১৮ সেপ্টেম্বর রিফাত হত্যা মামলার তারিখ রয়েছে। ওই তারিখে মিন্নিকে আদালতে উপস্থিত থাকতেই হবে।”
মিন্নির বিষয়ে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্ববধায়ক সোহবার উদ্দীন বলেন, “মিন্নির মানসিকভাবে ভেঙে পড়াটা স্বাভাবিক। তার এই স্বল্প সময়ের জীবনে কত কী যে ঘটে গেল! গণমাধ্যমে এসব দেখেই তো আমরা ঘাবড়ে যাই।”
তিনি মনে করছেন, মিন্নিকে কাউন্সেলিং এর পাশাপাশি একজন মানসিক বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা করানো দরকার। এতে তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবেন। পাশাপাশি, তার শারীরিক কোনো অসুস্থতা থেকে থাকলে সেটিরও চিকিৎসা দরকার।