গভীর সঙ্কটে সিলেটের রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীরা
গত বছর সিলেটের দক্ষিণ সুরমায় 'অতিথি' নামে একটি রেস্টুরেন্ট খুলেছিলেন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা আবদুল কাদির। ব্যবসা হচ্ছিল ভালোই। কিন্তু বাধ সাধলো করোনাভাইরাস। করোনার কারণে প্রায় চার মাস ধরে বন্ধ তার রেস্টুরেন্ট। ব্যবসা বন্ধ থাকলেও ভবন ভাড়া, বিদ্যুৎ-গ্যাস বিল, কর্মচারী বেতন দিয়ে যেতে হচ্ছিল তাকে। ফলে মাসে মাসে গুণতে হয়েছে লোকসান।
এ অবস্থায় নিজের রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আবদুল কাদির। গত ১৫ জুলাই থেকে স্বাস্থবিধি মেনে সিলেটের সব হোটেল-রেস্টুরেন্ট খোলার অনুমতি দেওয়া হলেও নিজের রেস্টুরেন্ট খোলেননি কাদির।
তিনি বলেন, এই চারমাসে আমি প্রায় সর্বসান্ত হয়ে পড়েছি। রেস্টুরেন্ট চালানোর মতো সঙ্গতি আমার নেই। তাছাড়া রেস্টুরেন্ট খোলার অনুমতি দেওয়া হলেও ব্যবসা হওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চালাতে খরচও অনেক বেড়ে যাবে। ফলে রেস্টুরেন্ট বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
কেবল আবদুল কাদির নন, করোনার ধকল সামলাতে না পেরে এমন আরও অনেকেই নিজেদের রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অন্তত এক ডজন রেস্টুরেন্ট ইতোমধ্যে বন্ধ বা বিক্রি হয়ে যাওয়ার তথ্য জানা গেছে। নগরীর কুমারপাড়া, নয়াসড়ক, জিন্দাবার ও মেডিকল রোড এলাকার রেস্টুরেন্ট স্পাইচ চিকেন, বাফেট হাউস, ডক্টরস কাফে, ফেট বেলি ও ক্যালোরি হাইট এরকম কয়েকটি রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে।
সিলেটে বছর পাঁচেক ধরে রেস্টুরেন্ট তৈরির একটি ট্রেন্ড চলছে। যা করোনা সংক্রমণের পর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। পাড়ায়-পাড়ায়, বিভিন্ন গলিতে গড়ে ওঠে অনেক রেস্টুরেন্ট। গত পাঁচ বছরে সিলেট নগরীতেই অন্তত দুইশ' রেস্টুরেন্ট গড়ে ওঠে। নতুন হওয়া এসব রেস্টুরেন্টগুলো মূলত দুটি টাইপের।
এক ধরনের রেস্টুরেন্ট ফাস্টফুড, চাইনিজ, থাইসইসহ বিভিন্ন অঞ্চলের খাবারের। আধুনিক সাজসজ্জার এ সব রেস্টুরেন্টের গ্রাহক মূলত তরুণ-তরুণীরা। আর অন্য ধরনের রেস্টুরেন্ট দেশীয় খাবারের। বিশাল জায়গা নিয়ে উন্মুক্ত পরিসরে খাবার ব্যবস্থা রয়েছে এসব রেস্টুরেন্টে।
'পাঁচ ভাই' নামক একটি রেস্টুরেন্টের মাধ্যমে এমন ব্যবসার ট্রেন্ড শুরু হয়। এসব রেস্টুরেন্টের গ্রাহক মূলত পর্যটক এবং কর্মজীবী ও সীমিত আয়ের মানুষ। এই দুই টাইপের মিলিয়ে সিলেটে পাঁচ শতাধিক রেস্টুরেন্ট রয়েছে।
সিলেটের রেস্টুরেন্টগুলোর প্রধান ক্রেতাই মূলত পর্যটক ও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণরা। করোনার কারণে পর্যটক আসা বন্ধ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও তাই। ফলে দীর্ঘদিন পর খুলেও ক্রেতা পাচ্ছে না রেস্টুরেন্টগুলো। এ ছাড়া করোনার কারণে পরিবার নিয়ে বাইরে খাওয়ার প্রবণতাও কমেছে। একান্ত বাধ্য না হলে কর্মজীবীরাও রেস্টুরেন্টমুখী হচ্ছেন না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিলেটে রেস্টুরেন্টের বেশিরভাগই গড়ে উঠেছে প্রতিযোগিতা করে। মার্কেট যাচাই-বাছাই না করে অনেক তরুণরা রেস্টুরেন্ট খুলেছেন। গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে খাবারের দাম কমানোর প্রতিযোগিতাও ছিল। এ সব কারণে অনেক রেস্টুরেন্ট ভালো ব্যবসা করলেও খুব বেশি লাভবান হতে পারেনি। ফলে তারা এখন বিপাকে পড়েছে।
নগরীর বারুতখানা এলাকার এরকম একটি রেস্টুরেন্ট 'ইথোপিয়া'। সিলেটের বেশ নামডাক রয়েছে রেস্টুরেন্টটির। কিন্তু গত চারমাস বন্ধ থাকায় অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গত ১৫ জুলাই থেকে সিলেটের অন্যান্য রেস্টুরেন্ট খুললেও খোলেনি এ রেস্টুরেন্ট।
ইথোপিয়ার ব্যবসায়ীক অংশীদার মঞ্জুর আহমদ বলেন, রেস্টুরেন্ট খোলার অনুমতি দেওয়া হলেও ক্রেতা নেই। মানুষজন রেস্টুরেন্টে খেতে আসছে না। অথচ রেস্টুরেন্ট খুললেই সব কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করতে হবে। ব্যবসা না হলে তা কোথা থেকে দেব। তাই আমরা আপাতত রেস্টুরেন্ট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
সিলেটের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দিব্য জ্যোতি শী। কয়েকজন বন্ধু মিলে নগরীর জিন্দাবাজার এলাকায় খুলেছিলেন 'রয়েল ডাইন' নামের একটি রেস্টুরেন্ট।
দিব্য বলেন, বাসা থেকে টাকা এনে রেস্টুরেন্ট করেছিলাম। ফলে এখন আর নতুন করে বিনিয়োগ করা সম্ভব না। সিলেটে সাম্প্রতিক হওয়া রেস্টুরেন্টগুলোর বেশিরভাগেরই উদ্যোক্তা আমাদের মতো তরুণ। যাদের খুব বেশি মূলধন নেই। করোনার কারণে আমরাই সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে পড়েছি।
করোনা সংক্রমণ রুখতে গত ২৩ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। ওইদিন থেকেই বন্ধ হয়ে যায় সিলেটের সব রেস্টুরেন্ট। তবে ক্রেতা কমে যাওয়ায় কয়েকটি রেস্টুরেন্ট কয়েকদিন আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর গত ১৫ জুলাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে রেস্টুরেন্ট খোলার অনুমতি দেয় জেলা প্রশাসন।
সিলেট নগরীর জিন্দবাজার এলাকার জনপ্রিয় বাংলা রেস্টুরেন্ট পানসী। সবসময়ই ক্রেতাদের ভিড়ে সরগরম থাকে রেস্টুরেন্টটি। এখানে খেতে হলে ক্রেতাদের দাঁড়িয়ে সিট খালি হওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয় অনেকক্ষণ।
তবে শনিবার দুপুরে ওই রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখা যায়, অনেকটাই ফাঁকা রেস্টুরেন্ট। নেই আগের সেই জমজমাট অবস্থা। হাতেগোনা কয়েকজন মধ্যাহ্নভোজ করছেন রেস্টুরেন্টে।
এই রেস্টুরেন্টের কর্মী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমাদের গ্রাহকদের বড় অংশ সিলেটে আসা পর্যটকরা। এ ছাড়া রয়েছে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণরা। পর্যটক আসা বন্ধ, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ। ফলে আমাদের ক্রেতা একেবারে কম। তাছাড়া মানুষ এখন রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে অনেকটা ভয় পায়।
বন্ধ থাকা অবস্থায় বেশকয়েকটি রেস্টুরেন্টে চবালু ছিল হোম ডেলিভারি সার্ভিস। তবে সিলেটে 'টেক-ওয়ে' ব্যবস্থা এখন জনপ্রিয় না হওয়ায় তেমন সুবিধা করতে পারেননি ব্যবসায়ীরা।
নগরীর নয়াসড় এলাকার 'ম্যাডগ্রিল' রেস্টুরেন্টের উদ্যোক্তা শাহীরাজ চৌধুরী বলেন, মার্চের প্রথম থেকেই আমাদের ক্রেতা কমতে শুরু করে। পরবর্তী সময়ে লকডাউন ঘোষণার আগেই আমরা রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেই। তবে আমাদের টেকওয়ে ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সিলেটের মানুষের তাতে খুব একটা আগ্রহ নেই। ফলে টেকওয়ে দিয়ে রেস্টুরেন্ট টিকিয়ে রাখা অসম্ভব। বর্তমানে যা ব্যবস্যা হচ্ছে তা দিয়ে রেস্টুরেন্টের খরচ মেটানোই সম্ভব হচ্ছে না। প্রতি মাসে পকেট থেকে বড় পরিমাণ অর্থ দিতে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে নগরীর চোহাট্টা এলাকার 'কারাগার' রেস্টুরেন্টের ব্যবসায়ীক অংশীদার আমিনুল ইসলাম ফারহান বলেন, টেক ওয়ে দিয়ে রেস্টুরেন্ট টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। সাধারণ সময়ে যেখানে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকার ব্যবস্যা হতো এখন সেখানে পাঁচ হাজারের বেশি হয় না।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছে আধুনিক এই রেস্টুরেন্টগুলো।
নয়াসড়কে অবস্থিত কাবাব কারিগর-এর স্বত্ত্বাধিকারী ইমাম মোহাম্মদ জহির বলেন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বা মেসে যারা থাকতেন তারা বাড়িতে চলে গেছেন। ফলে ক্রেতা নেই। বর্তমানে রেস্টুরেন্ট শুধু খোলা রেখেছি যাতে কর্মচারীদের বেতন দিতে পারি। তবে এভাবে খুব বেশিদিন চালানো যাবে না।
সিলেটে রেস্টুরেন্টগুলোর দুটি সংগঠন রয়েছে। বাংলা খাবারের রেস্টুরেন্টগুলো বাংলাদেশ রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতির অন্তর্ভূক্ত। আর ফাস্টফুডসহ বহুজাতিক খাবারের রেস্টুরেন্টগুলোর সংগঠন সিলেট জেলা ক্যাটারার্স গ্রুপ।
জেলা ক্যাটারার্স গ্রুপের সভাপতি শান্ত দেব বলেন, আমাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে রেস্টুরেন্ট চালাতে হচ্ছে। ফলে যে রেস্টুরেন্টে ১০০ জনের বসার ব্যবস্থা আছে সেখানে ৫০ জনও বসানো সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবস্থা করতে হয়েছে। ফলে পরিচালনা ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু খাবারের দাম বাড়ানো যায়নি।
তিনি বলেন, করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে পড়েছে রেস্টুরেন্ট সেক্টর। কবে এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে তাও বলা যাচ্ছে না। কিন্তু আমরা কোনো প্রণোদনা পাচ্ছি না। ব্যাংকে যোগাযোগ করলে বলা হয় রেস্টুরেন্ট ক্যাটাগরিতে প্রণোদনা দেওয়ার নির্দেশনা নেই।
শান্ত বলেন, সিলেটে আমাদের টাইপের প্রায় ৩০০ রেস্টুরেন্ট রয়েছে। অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। এগুলোর মালিকরা আমাদের সঙ্গেও এ ব্যাপারে যোগাযোগ করছেন।
রেস্টুরেন্ট খাতের কর্মীদের অর্ধেকেরই চাকরী চলে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে আমাদের ব্যবসাও স্বাভাবিক হবে না। ফলে বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেওয়ার মতো সামর্থ বেশিরভাগ উদ্যোক্তারই নেই।
নগরীর জিন্দাবাজারে স্পাইশি নামের একটি রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শান্ত। নিজের রেস্টুরেন্টের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, আমার রেস্টুরেন্টে ৫৩ জন কর্মী ছিলেন। কিন্তু এখন রেস্টুরেন্ট চালু হলেও ক্রেতা না থাকায় অর্ধেক কর্মী দিয়ে চালাচ্ছি। অন্য কর্মীদের আনলে তাদের বেতনের পাশপাশি থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও করতে হয়। এটা এখন অসম্ভব।
বাংলাদেশ রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতি সিলেট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, লকডাউনের শুরুতেই আমরা সিলেট জেলা প্রশাসকের কাছে প্রণোদনার দাবিতে একটি স্মারকলিপি দেই। তবে এখনো আমাদের প্রণোদনার বিষয়ে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। এ ছাড়া আমাদের ভ্যাট মওকুফের জন্যও আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দিয়েছি। এ বিষয়েও আমাদের কোনো কিছু জানানো হয়নি।