গাছের উপরে গ্যাস লাইন, নিচে মৃত্যুঝুঁকি
রাস্তার দুই পাশে গাছের উপর ঝুলছে প্লাস্টিকের পাইপ। সেই পাইপ দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার মজলিশপুর ইউনিয়নের বাকাইল গ্রামের চিত্র এটি।
কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গাছের উপর গ্যাসের পাইপ ঝুলে থাকার কারণে গ্রামটি এখন উড়াল গ্যাসের গ্রাম হিসেবে বেশি পরিচিত। মাঝে-মধ্যে অভিযান চালিয়ে এসব উড়াল গ্যাসের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলেও পরবর্তী সময়ে আবারও সংযোগ দেওয়া হয়। ফলে গ্যাসের এই ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহার রোধ করতে না পারায় যে কোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।
জানা গেছে, এক যুগেরও বেশি সময় আগে বাকাইল গ্রাম সংলগ্ন তিতাস নদীর কয়েকটি স্থানে গ্যাসের উদগিরণ শুরু হয়। মূলত তিতাস গ্যাস ফিল্ডের ৩নং কূপ খননের সময় লিকেজের কারণেই এই গ্যাসের উদগিরণ হয় বলে জানা গেছে। কূপের গ্যাস মাটির উপরের স্তরে চলে আসে এবং মাটির ফাঁক-ফোকর দিয়ে নলকূপ, নদীর পাড়, জমির আইল এবং বাড়ির আঙিনা দিয়ে গ্যাস উদগিরণ হতে থাকে। গ্যাসের এই উদগিরণ বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়ে ২০০৮ সালে ৩নং কূপটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস্ কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল)। এরপর থেকে গ্যাসের উদগিরণও কমে আসে।
বাকাইল গ্রামের বাসিন্দারা উদগিরণ হওয়া এই গ্যাস যথাযথ প্রক্রিয়ায় সরবরাহের দাবি জানালেও নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস প্রবাহ না থাকায় বিজিএফসিএল এই গ্যাস সংরক্ষণ বা উত্তোলনে প্রয়োজনীয় কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না।
বিজিএফসিএল সূত্রে জানা গেছে, এই গ্যাস কূপের গভীরের লিকেজ হওয়া পকেট গ্যাস। এক সময় শেষ হয়ে যাবে। তবে বাণিজ্যিকভাবে এই গ্যাসের ব্যবহার বৈধ নয়। আর এই গ্যাস দিয়ে বাণিজ্যিক কোনো প্ল্যান্টও করা সম্ভব না। কারণ নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস প্রবাহ না থাকলে কোনো প্ল্যান্ট করা যাবে না। যেখানে নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস থাকবে সেখানেই প্ল্যান্ট হবে।
সূত্র আরও জানায়, বাকাইল গ্রামে নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাসের প্রবাহ নেই। উদগিরিত গ্যাস সাধারণত নলকূপ স্থাপনের জন্য যতটুকু গভীরতা প্রয়োজন সেটুকু গভীরের গ্যাস। আর বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে বিজিএফসিএল’র উৎপাদিত যে গ্যাস সরবরাহ করা হয় তা অনেক গভীর এবং প্রেসারের।
সরেজমিনে বাকাইল গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, তিতাস নদীর যেসব স্থানে গ্যাস উদগিরণ হয় সেখানে অপরিকল্পিতভাবে ড্রামে করে পানিসহ গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। এরপর একটি পাইপ দিয়ে পানি বের করে আরেকটি পাইপ দিয়ে উত্তোলিত গ্যাস বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে সরবরাহ করা হচ্ছে। গ্রামের কয়েকশ’ ঘর-বাড়িতে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয়েছে। কয়েকটি চুন ও চুড়ি কারখানাও চলে বিজিএফসিএল’র এই পকেট গ্যাস দিয়ে। তবে এই গ্যাসের প্রেসার উঠা-নামা করে।
যেখানেই পকেট গ্যাসের অস্তিত্ব রয়েছে সেখানেই নলকূপ বসিয়ে পানিসহ গ্যাস উত্তোলন করে ড্রামে সংরক্ষণ করছে একটি চক্র। এরপর ড্রাম থেকে প্লাস্টিকের পাইপের মাধ্যমে বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে বাণিজ্যিকভাবে সরবরাহ করছে তারা। উদগিরণ হওয়া এই গ্যাস দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে রমরমা বাণিজ্য করে আসছে ওই চক্রের সদস্যরা। একটি সিঙ্গেল চুলার জন্য ২৫০-৩০০ টাকা নিয়ে থাকে চক্রটি। তবে গ্রামের বাসিন্দারা অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দেওয়া চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে মুখ না খোলায় তাদেরকে শনাক্ত করতে পারছেনা প্রশাসন। ফলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া যাচ্ছে না।
তবে প্রায়ই ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে অবৈধভাবে দেওয়া গ্যাস সংযোগগুলো বিচ্ছিন্নসহ গাছের ওপর দিয়ে নেওয়া পাইপগুলো অপসারণ করে থাকে। কিন্তু অভিযানের পর রাতের আঁধারে আবারও গ্যাস সংযোগ দেয় চক্রটি। এভাবে গ্যাসের ব্যবহারে ঝুঁকি আছে জেনেও গ্যাস সংযোগ নিচ্ছে গ্রামের সাধারণ মানুষ। মূলত ওই এলাকায় সরকারিভাবে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় স্থানীয়রা ঝুঁকি নিয়েই উড়াল গ্যাস ব্যবহার করছে। তবে তারা এভাবে গ্যাস ব্যবহার না করে সরকারিভাবে বৈধ উপায়ে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
বাকাইল গ্রামের বাসিন্দা মোখলেছুর রহমান জানান, আমাদের গ্রামের চতুর্দিকে গ্যাস রয়েছে। গ্রামের অনেকেই এই গ্যাস ব্যবহার করছে। কিন্তু আসলেই এই গ্যাসের ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ।
‘‘যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু সরকারিভাবে গ্যাস না পেয়ে বাধ্য হয়ে আমাদের অবৈধভাবে এই গ্যাস ব্যবহার করতে হচ্ছে।’’ যোগ করেন মোখলেছুর রহমান।
গ্রামের গৃহবধূ তাহমিনা আক্তার বলেন, ‘‘গ্যাস ছাড়া তো আর চলা যায় না। রান্না করার সময় অনেক সতর্ক থাকি, এরপরও ভয়ে থাকি কখন আগুন লাগে। যে কোনো মুহূর্তে আগুন লেগে সবকিছু পুড়ে যেতে পারে। সরকারিভাবে গ্যাস দিলে তো আমাদের আর ঝুঁকি নিয়ে এই গ্যাস ব্যবহার করতে হতো না।’’
আলমগীর মিয়া নামে গ্রামের আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘‘আগে আমরা সবসময় এই গ্যাস ব্যবহার করতাম। প্রশাসনের লোকজন বিভিন্ন সময় এসে গ্যাসের সংযোগ কেটে দিয়ে যায়। তখন বাড়ির মহিলাদের রান্না করতে কষ্ট করতে হয়। আমরা চাই আমাদের এলাকায় যেন সরকারিভাবে গ্যাস দিয়ে আমাদের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করা হয়।’’
গ্যাসের ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহার বন্ধের ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পঙ্কজ বড়–য়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দিতে ওই গ্রামে একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। কিন্তু গ্রামের লোকজন সেই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে মুখ না খোলায় তাদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে না।
‘‘আমরা নিয়মিত সেখানে অভিযান চালিয়ে অবৈধভাবে নেয়া গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করছি। অচিরেই অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ দেওয়া সিন্ডিকেটের সদস্যদের চিহ্নিত করে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’’
বিষয়টি নিয়ে বিজিএফসিএল কর্তৃপক্ষ অফিসিয়াল কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি। তবে বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী শফিকুল হক বলেন, ‘‘বিজিএফসিএল’র একটা কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলন করতে গিয়ে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে। পরে তারা পরিত্যক্ত ঘোষণা করে চলে এসেছে। তবে উদগিরণ হওয়া এই গ্যাস কারো নিয়ন্ত্রণে নেই। কোথায় কোন দিক দিয়ে গ্যাস বেরুচ্ছে সেটাও নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তবে এটার প্রেসার ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।’’
(https://tbsnews.net/bangladesh/energy/strange-way-supplying-gas-earths-crust-44863)