জেলাভিত্তিক লকডাউনে সংক্রমণ কমানো সম্ভব, বিশেষজ্ঞদের মত
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গত বছরের ১৯ মার্চ মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলায় প্রথম লকডাউন করা হয়। এরপর ২৩শে মার্চ রাজধানীর মিরপুরের টোলারবাগে লকডাউন দেয়া হয়। লকডাউনের কারণে শিবচর ও টোলারবাগ দুই এলাকাতেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এসেছিল।
ওই দুই এলাকা স্থানীয় সংসদ সদস্য, সিটি কর্পোরেশন, পুলিশ এবং রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সঙ্গে পরামর্শ করে একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার আওতায় লকডাউন পরিচালনা করেছিল। ওই দুই এলাকায় বেশি বেশি টেস্ট ও আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসাদের 'কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং' (করোনা আক্রান্ত মানুষের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তি চিহ্নিত ও নজরদারি) করে কোয়ারেন্টিন- আইসোলেশন করা হয়েছিল।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. এম মুশতাক হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'মহামারি নিয়ন্ত্রণের জন্য আইইডিসিআর একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান যেটি অনেক বছর ধরে কাজ করে আসছে। তারা লকডাউন এলাকার রোগীদের কোয়ারেন্টাইন-আইসোলেশন করে প্রত্যেকটা রোগীর সংস্পর্শে যারা এসেছিল, তাদের কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করে টেস্ট করেছিল। তাই ভালো ফল পেয়েছিল'।
ডা. এম মুশতাক হোসেন বলেন, 'সেসময় বৈজ্ঞানিকভাবে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করে শুধু টোলারবাগ ও শিবচর নয় প্রথম ২০০টা কেস পর্যন্ত সবাইকে ফলোআপ করেছে আইইডিসিআর এর মাঠ পর্যায়ে কাজ করা এপিডেমিওলজিস্টরা'।
পরবর্তীতে পূর্ব রাজারবাগ ও ওয়ারী লকডাউন করেও সংক্রমণ মোকাবেলায় ভালো ফল পাওয়া গিয়েছিল। বর্তমানে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ১৬ এপ্রিল থেকে দেশব্যাপী লকডাউন চলছে। আজ এ লকডাউনের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। লকডাউন আরো বাড়ানো হবে কিনা সে বিষয়ে এখনো জানা যায়নি। তবে সংক্রমণ সেভাবে কমেনি বরং প্রতিদিনেই বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সংক্রমণ হার ১৪.২৭% দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন দেশব্যাপী লকডাউন না দিয়ে অধিক সংক্রমিত জেলাগুলো ও তার আশেপাশের জেলাগুলোতে লকডাউন দিয়ে টেস্ট ও কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করে কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশনের মাধ্যমে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা না হলে সংক্রমণ ধীরে ধীরে সারাদেশে ছড়িয়ে আবার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
প্রথিতযশা ভাইরোলজিস্ট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, 'লকডাউনে বেশি বেশি টেস্ট করে রোগীদের চিহ্নিত করে যথাসম্ভব আইসোলেট করতে হবে। রোগীর পরিবারের সদস্যদের কোয়ারেন্টাইন করতে হবে। হাসপাতালে রোগীদের যথাযথ চিকিৎসা দিয়ে সব পজিটিভ রোগীদের কোভিড-১৯ নেগেটিভ করার পর লকডাউন তুলে দিতে হবে। তা না হলে শুধু শুধু দিনের পর দিন লকডাউন দিলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না'।
ডা. এম মুশতাক হোসেন বলেন, 'এখন প্রয়োজন যেখানে সংক্রমণ বেশি শুধু সেখানে নয়, তার পাশের জেলাতেও যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করা। তাহলে সংক্রমণ এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ছড়াবে না'।
তিনি বলেন, '৯৫% রোগী বাড়িতে সেবা নিচ্ছে, তারা যেন বাসায় থেকে চিকিৎসা পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। অনলাইনে তাদের মেডিকেল পরামর্শ দিতে হবে, তা না হলে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ খেয়ে ব্ল্যাক ফাংগাসের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। সবার জন্য স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা নিশ্চিত করতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে সংশ্লিষ্ট করা ও টিকার ব্যবস্থা করতে হবে'।
প্রফেসর ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, 'বর্তমানে লকডাউন কাজে দিচ্ছে না। টেস্ট কম করা হচ্ছে, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করা হচ্ছে না। রোগীদের ঠিকমত চিকিৎসাও হচ্ছেনা, বিভিন্ন জেলা হাসপাতালে আইসিইউ, কেন্দ্রীয় অক্সিজেন লাইন নেই'।
সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ২৫ মে থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় লকডাউন জারি করা হয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী জানান, 'লকডাউনের কারণে সংক্রমণ কমছে কিনা তার সুফল পেতে আরো সময় লাগবে। গত ৫ দিনের তথ্য বলছে সংক্রমণ হার ৩৯% থেকে ১৬% এ নেমেছিল, কিন্তু আবার বেড়ে ২২% দাঁড়িয়েছে। মানুষ স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সংক্রমণ হার আবার ৬০% বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে'।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর হাসপাতালে অক্সিজেন লাইনসহ বেড ৩২টি থেকে বাড়িয়ে ৭২টি করা হয়েছে। সেখানে মঙ্গলবার ভর্তি ছিল ৭১ জন।
ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী বলেন, 'আমরা টেস্ট বাড়িয়েছি, ফোনে রোগীদের নজরদারি করছি, আক্রান্তদের কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করছি। যদিও কোনকিছুই ১০০% সম্ভব হচ্ছে না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সহায়তা নিয়েও আক্রান্তদের পরিবারের সদস্যদের ঘরে রাখা যাচ্ছে না। স্থানীয় মানুষের সহযোগিতা ছাড়া পরিস্থিতি মোকাবেলা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে'।