তালিকাতেই সীমাবদ্ধ আম্পানে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া
ঘূর্ণিঝড় আম্পানে বিধ্বস্ত সাতক্ষীরায় ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারি সহায়তা বা পুনর্বাসনের পরিকল্পনা থমকে রয়েছে। শুধু তালিকাতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সহায়তার ধাপ।
মৎস্য, কৃষি ও প্রাণিসম্পদ কার্যালয় ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ করে তালিকা প্রস্তুত করলেও কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পুনর্বাসন বা সহায়তা করা হবে তার কোনো নির্দেশনা এখনও এসব দপ্তরগুলোতে আসেনি। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষরা শুধু তালিকাতেই সীমাবদ্ধ রয়েছেন।
অন্যদিকে, উপকূলীয় এলাকায় বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজে জোর দিয়েছে সরকার। প্রথমদিকে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে গ্রামবাসীরা বাঁধ সংস্কার করলেও পরবর্তীতে জোয়ারের পানিতে সেগুলো ভেসে যায়। বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বাঁধ সংস্কার কাজ চলমান রয়েছে। তবে বাঁধ সংস্কার শেষ হতে দুই মাসেরও অধিক সময় লাগবে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর শ্যামনগর, কালিগঞ্জ ও দেবহাটা উপজেলার আওতায় ৭০টি পয়েন্টে ৩৪ কিলোমটার বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৩টি পয়েন্টে সম্পূর্ণরুপে ধ্বসে গেছে এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। এ ছাড়া সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর সাতক্ষীরা সদর, আশাশুনি ও শ্যামনগরের কিছু অংশে ১০৫টি পয়েন্টে ৬৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের জানান, উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার উপকূলীয় বাঁধ মেরামতের জন্য কাজ শুরু করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ঠিকাদার নিয়োগ করে আমরা কাজ শুরু করেছি। এখনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, উপকূলীয় দাতিনাখালি, দূর্গাবাটি, গাবুরা, জাপালি, পাশের্^মারি এলাকায় তিন কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজ চলমান রয়েছে। প্রথমে মাটির কাজ করা হচ্ছে। এরপর জিও ব্যাগ ও জিও টেক্সটাইল দিয়ে সিল করে দেওয়া হবে। এতে বাঁধ টেকসই হবে। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে লেবুগুনিয়া ও ঘোলা এলাকায় দুইটি পয়েন্টে বেড়িবাঁধের কাজ শুরু হয়েছে।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান খান জানান, সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলা হাজরাখালি, হিজলা, কোলা, কামালকাটি, চাকলা, কুড়িকাউনিয়া, দয়ারখাট এলাকায় বাঁধ সংস্কারের কাজ চলামান। এর মধ্যে হাজরাখালি, কোলা, চাকলা, কুড়িকাউনিয়া এলাকায় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধায়নে কাজ চলছে। সেনাবাহিনীকে অগ্রিম দুই কোটি টাকার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কাজের উপর ভিত্তি করে বরাদ্দ দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, উপকূলে ৩১ কিলোমিটার বাঁধ সম্পূর্ণ ও ৩৫ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত। বাঁধ সংস্কার করতে দুই মাসেরও বেশি সময় লেগে যাবে। এখনো চাকলা, কুড়িকাউনিয়া, হাজরাখালি ভাঙ্গন দিয়ে এলাকায় পানি প্রবেশ করছে। বাঁধ সংস্কার কাজও চলমান।
উপকূলীয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এস এম আতাউল হক দোলন জানান, এখন পর্যন্ত ৩০০ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে ৩০০ বান সরকারি টিন দেওয়া হয়েছে। নগদ সাত লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ৫০০ টন জিআর এর চাল বিতরণ করা হয়েছে।
কৃষি, মৎস্যখাতে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা সংশ্লিষ্ট দপ্তর করে পাঠিয়েছে এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি। এছাড়া উপজেলা থেকে ৪৫০০ বিধ্বস্ত ঘরবাড়ির তালিকা পাঠানো হয়েছে। এখনো বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। বর্তমানে উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ সংস্কারের দিকে জোর দিয়েছে সরকার। বলেন আতাউল হক।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ির উপ পরিচালক নুরুল ইসলাম বলেন, জেলায় কৃষিখাতে ক্ষতি হয়েছে ১৩৮ কোটি টাকা। জনপ্রশাসন সচিবের পরামর্শে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করে রাখা হয়েছে। পূনর্বাসন কর্মসূচির পরিকল্পনা নিয়ে প্রস্তুতি রাখা হয়েছে তবে সহযোগিতার বিষয়ে এখনো সরকারি কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত তালিকাতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদেও পূনর্বাসন কার্যক্রম।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. শহিদুল ইসলাম জানান, জেলায় ৮৬টি মুরগির খামার ও ৯১টি গবাদি পশুর খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টাকার হিসেবে ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৭৭ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত খামারীদের তালিকা প্রস্তুত করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে সেখান থেকে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, জেলায় ১৩ হাজার ৪৭৭ হেক্টর জমির চিংড়ি, সাদা মাছ, চিংড়ির রেনু ভেসে গেছে। সব মিলিয়ে ক্ষতি হয়েছে ১৭৬ কোটি ছয় লাখ টাকার। এসব ক্ষতিগ্রস্ত ঘের ব্যবসায়ীদের তালিকা প্রস্তুত করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে।
তিনি বলেন, মৎস্য খাতে সরকার পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রনোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। যা সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট অ লের চিংড়ি চাষীরা পাবেন। শতকারা চার শতাংশ সুদে ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্য ব্যবসায়ীদের এ প্রণোদনা নিতে পারবেন।
''তবে সমস্যা হচ্ছে, ব্যাংক থেকে টাকা নিতে গেলে জমির কাগজপত্র দিতে হচ্ছে। কিন্তু চাষীরা সেই কাগজ দিতে পারছেন না। কারণ হচ্ছে, অধিকাংশ ব্যবসায়ীরা শত শত জমির মালিকদের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে মাছের ঘের করেন। সকলের কাগজ একত্রিত করাও তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। যার কারণে তারা এই প্রণোদনাও নিতে পারছেন না। এটি আরেকটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।''
জেলা প্রশাসন কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, জেলায় ২২ হাজার ৫১৫টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও ৬০ হাজার ৯১৬টি ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল বলেন, আম্পানে উপকূলীয় মানুষদের পূনর্বাসনের জন্য সরকার এখন পর্যন্ত ৫০০ বান্ডেল ঢেউটিন দিয়েছে। এ ছাড়া আরও এক হাজার বান্ডেল দ্রুত পাওয়া যাবে। তাছাড়া বাঁধ সংস্কারের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের কিভাবে পূনর্বাসন করা যায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মাধ্যমে সেটি নিয়ে কাজ করছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।