তিন দশকে ঢাকায় রিকশার সংখ্যাবৃদ্ধি প্রায় ১২ গুণ
- ১৯৮৬ সালেই নতুন রিকশার লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করে দেয় ঢাকা সিটি কর্পোরেশন
- জাল লাইসেন্স দিয়ে ২৫টি অননুমোদিত সংগঠন আয় করেছে ৮০০ কোটি টাকা
- নগরীর বুকে চলাচল করছে ১ লাখ ৫০ হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশা
আজ থেকে তিন দশক আগে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন যখন নতুন রিকশার লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করে দেয়, তখন ৮০ হাজার রিকশা চলাচল করত এই শহরে।
ধীরগতির এ যান রাস্তায় অন্যান্য যানবাহনের গতি কমিয়ে দেয়, সৃষ্টি হয় ট্র্যাফিক জ্যাম, এ নিয়ে নগর-পরিকল্পকদের উদ্বেগ ছিল। তাই, নতুন কোনো রিকশা নগরীর রাজপথে নামতে না দেওয়াই সহজ সমাধান বলে মনে করলেন তারা।
তবে বিষয়টা এত সহজ ছিল না। তাই গত ত্রিশ বছরে ঢাকায় রিকশার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৮ থেকে ৯ লাখের মতো। আর সেই থেকে এই নগরী আবদ্ধ হয়ে রয়েছে ট্র্যাফিক জ্যামের ফাঁদে।
গত তিন দশকে পরিবর্তন যেটি হয়েছে তা হল, রিকশার ব্যবসায়ে এসেছে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। এ সময়ে ক্ষমতাসীন দলগুলোর প্রশ্রয়ে গজিয়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি সংগঠন। যারা জাল লাইসেন্স দিয়ে একের পর এক রিকশা নামিয়ে দিয়েছে রাস্তায়।
২০০১ সালে রিকশামালিকদের সঙ্গে এক মিটিংয়ে তৎকালীন ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম নুরুল হুদা বিদ্যমান অবৈধ রিকশাগুলোকে বৈধ করার ঘোষণা দিলেন। সেখানে আরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, নতুন কোনো রিকশাকে রুট পারমিট বা রিকশা চালানোর অনুমতি দেওয়া হবে না। তাছাড়া রিকশা নির্মাণ কারখানাগুলো সব ভেঙে দেওয়া হবে বলেও জানানো হল। তাছাড়া রিকশাচালকদের লাইসেন্স দেবার বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয়।
কিন্তু ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মোট ১৮ হাজার রিকশাচালককে লাইসেন্স দেওয়া হয়। এরপর, আগে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর কোনোটাই বাস্তবায়িত হয়নি।
নগর কর্তৃপক্ষের বেখেয়ালি হওয়ার সুযোগে শহরজুড়ে গড়ে ওঠে বেশ কিছু দল। যারা রুট পারমিট দেওযার বিকল্প কর্তৃপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়। আর এভাবেই অবৈধ পারমিট ইস্যুর নামে শুরু হয় বিশাল অর্থনৈতিক লেনদেন।
রিকশা বাড়ে যেভাবে
১৯৮৬ সালে সিটি কর্পোরেশন যখন নতুন রিকশার লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করে দিল, তখন রিকশাগুলো চলত ট্র্যাফিক পুলিশদের ঘুষ দিয়ে। ২০০১ সালের পর সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এক হয়ে জাল লাইসেন্স দেওয়া শুরু করেন। ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকার বিনিময়ে একেকটি লাইসেন্স দেওয়া হত তখন। নাম প্রকাশ করা যাবে না এ শর্তে ঢাকার মধুবাগের এক রিকশামালিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, ১৯৯২ সালে মোট ৩০টি রিকশা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। ১৯৯২ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত তার রিকশা ব্যবসা চলত পুলিশকে ঘুষ দিয়ে। প্রতিটি রিকশার জন্য দৈনিক ২০ থেকে ৩০ টাকা হারে ট্রাফিক পুলিশকে ঘুষ দিতে হত তাকে।
২০০২-২০০৩ সালে জাল লাইসেন্স দেওয়া যখন শুরু হল, লাইসেন্সপিছু পাঁচ থেকে ছ’হাজার টাকা খরচ করেছেন তিনি। জাল লাইসেন্সের দাম দিনে দিনে বেড়েছে। এখন একটা জাল লাইসেন্স বানাতে খরচ পড়ে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। সিটি করপোরেশনের ইস্যুকৃত একেকটা লাইসেন্সের বিপরীতে এখন ১০ থেকে ১৫টি জাল লাইসেন্স পাওয়া যায়। এ কথা জানালেন বাংলাদেশ রিকশা-ভ্যান শ্রমিক লীগের মহাসচিব ইনসার আলী।
সিটি কর্পোরেশনের কোনো রকমের উদ্যোগ না থাকায় ২০০২ সাল থেকে বাংলাদেশ রিকশা-ভ্যান শ্রমিক লীগই প্রথম রিকশাগুলোকে নম্বর প্লেট দিতে শুরু করে । ২০১৮ সাল পর্যন্ত সংগঠনটি ৪৩ হাজারেরও বেশি নম্বর প্লেট ইস্যু করেছে।
ইনসার আলী বললেন, “সিটি করপোরেশন লাইসেন্স ইস্যু করতে শুরু করলে এবং নগরীতে সচল রিকশাগুলোর বৈধতা দিলে আমরা আর নম্বর প্লেট ইস্যু করব না।”
একই সময়ে নানা রকম গোষ্ঠীর স্বার্থভিত্তিক ২৫টি সংগঠনের একটি সিন্ডিকেটও গড়ে উঠেছে। ওরা রুট পারমিট হিসেবে নম্বর প্লেট দিচ্ছে।
অনিবন্ধিত এই গোষ্ঠীস্বার্থভিত্তিক সংগঠনগুলোর কয়েকটি হল: বাংলাদেশ রিকশা ও ভ্যান মালিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ রিকশা-ভ্যান শ্রমিক লীগ, বাংলাদেশ রিকশা মালিক শ্রমিক লীগ, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদ, ঢাকা নগর মুক্তিযোদ্ধা রিকশা ভ্যান মালিক কল্যাণ সমিতি, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা রিকশা উন্নয়ন সমিতি, বাংলাদেশ রিকশা ভ্যান মালিক শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদ— এরকম নানা নাম। গড়ে প্রত্যেক সংগঠন ৩০ হাজারটি করে লাইসেন্সের অনুমোদন দিয়েছে।
অবৈধ রিকশার পাশাপাশি নগরীতে চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশের প্রশ্রয়ে এগুলো নগরীর বুকে চলাচল করছে।
অবৈধ রিকশা: হাজার কোটি টাকার ব্যবসা
সিটি কর্পোরেশনের অনুমোদন পাওয়া সেই ৮০ হাজার রিকশার বাইরে বাকিসব রিকশা নিয়ন্ত্রণ করছে ২৫টি সংগঠনের ওই সিন্ডিকেট। ২০০২-২০০৮ সাল অব্দি ওরা প্রতিটি জাল লাইসেন্সের জন্য ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা করে নিয়েছে। পরে সেটাই বেড়ে ১২-১৫ হাজার টাকা হয়েছে। তবে সিটি করপোরেশনের তৎপরতার ওপর এই দামের হেরফের হয়। করপোরেশন অবৈধ রিকশা আটক শুরু করলে লাইসেন্সের জন্য দাম ১৫ হাজার টাকা হয়ে যায়। এভাবেই এই সিন্ডিকেট এত বছরে ৮০০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে।
এছাড়া নম্বর প্লেট নবায়ন করতে প্রতি বছর ৫০০ টাকা করে জমা দিতে হয় রিকশামালিকদের। সে হিসেবে বছরে ৪০ থেকে ৪৫ কোটি টাকা আয় হয় সিন্ডিকেটের।
ওদিকে দেড় লাখ মোটরচালিত রিকশার প্রতিটির জন্য মালিককে মাসে এক হাজার টাকা করে দিতে হয় পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের। এভাবে বছরে প্রায় ১৮০ কোটি টাকা আয় হয় সিন্ডিকেটের। তার ওপর, বাংলাদেশ রিকশা ও ভ্যান মালিক ফেডারেশনকে বছরে রিকশাপ্রতি সিকিউরিটি ফি হিসেবে ২০ টাকা করে দিতে হয় মালিকদের। অর্থাৎ ৯ লাখ রিকশা থেকে বছরে প্রায় ২ কোটি টাকা জমা পড়ে সিন্ডিকেটের তহবিলে।
আজ থেকে সাত বছর আগে ৩০টি রিকশা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন ফিরোজ ইকবাল। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, রিকশাপিছু ১২ হাজার টাকার বিনিময়ে তাকে নম্বর প্লেট দেয় জাতীয় রিকশা ভ্যান শ্রমিক লীগ। বাংলাদেশ রিকশা ও ভ্যান মালিক ফেডারেশনকেও প্রতি বছর রিকশাপিছু ২০ টাকা করে দেন তিনি, যাতে তার রিকশাগুলো চুরি হয়ে না যায়।
নির্বিকার সিটি কর্পোরেশন হারাচ্ছে রাজস্ব
১৯৮৬ সালে লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ করার পর ২০০১ সালে আবার লাইসেন্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু দীর্ঘদিন কোনো লাইসেন্সের অনুমোদন দেয়নি তারা। কেবল দু’বছর পর একবার রিকশাপিছু ৬৫০ টাকা করে নিয়ে ৮০ হাজার রিকশার লাইসেন্স নবায়ন করে। কিন্তু বাকি ৮ লাখ রিকশা থেকে যে পরিমাণ রাজস্ব আসতে পারত, তার পুরোটাই চলে যাচ্ছে সিন্ডিকেটের পকেটে।
বাংলাদেশ রিকশা ভ্যান মালিক শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি আবুল হোসেন বললেন, “২০১৬ সালে আমাদের ৪৩ হাজার রিকশা ও ভ্যানের জন্য সিটি কর্পোরেশনকে লাইসেন্স ফি বাবদ ১৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা দিতে চেয়েছিলাম আমরা। কিন্তু এই রিকশা-ভ্যানগুলোকে তারা বৈধতা দেবেন কি না, সে ব্যাপারে এখনও তাদের সিদ্ধান্ত জানাননি।”