দখলদারদের কবলে পড়ে করতোয়া ‘শত নদী’
আবহমানকাল ধরে বগুড়া শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে করতোয়া। দুই পাশেই নাগরিক সভ্যতা। মানুষের প্রাণের স্পন্দন। দৈনন্দিন জীবন-যাপনের পরম বন্ধু। কিন্তু সেই বন্ধুকেই বিপন্ন করে তুলেছে দখলদাররা। তাদের লোভে আজ অকেজো হয়ে পড়ছে ‘বগুড়ার ফুসফুস’। নদীর গর্ভস্থলে কৃত্রিম আইল্যান্ড তৈরি করে করতোয়াকে শত শত খণ্ডে বিভক্ত করেছে তারা। নদীর দু’পাশের প্রবাহকে স্তিমিত ও গতিপথ পরিবর্তন করে সর্বনাশ করেছে নদীর।
এরই মধ্যে করতোয়া নদীর দখল করা অংশে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করায় বগুড়ার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ঠেঙ্গামারা মহিলা সুবজ সংঘ (টিএমএসএস) এবং অন্যান্য দখলদারদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার সুপারিশ করেছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। একই সঙ্গে করতোয়া নদী দখল-দূষণ থেকে বিরত না হলে টিএমএসএস’র নিবন্ধন বাতিলের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে সুপারিশও করতে বলা হয়েছে।
এদিকে, সারাদেশে নদ-নদীর দখল ও দূষনকারীদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযানের অংশ হিসেবে বগুড়া শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত করতোয়া নদীর দখলদারদেরও উচ্ছেদ শুরু হয়েছে। সোমবার সকালে বগুড়া শহরের রেলওয়ে ব্রিজের পশ্চিমাংশে উচ্ছেদের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক। উচ্ছেদের প্রথমদিন সকালে বেশ কয়েকটি অস্থায়ী দোকানঘর এবং বহুতল তিনটি ভবন ভাঙ্গার কাজ শুরু হয়।
গত ১৯ নভেম্বর জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন থেকে বগুড়ার জেলা প্রশাসক ও জেলা নদী রক্ষা কমিটির আহ্বায়কের কাছে চিঠি পাঠিয়ে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে অগ্রগতির প্রতিবেদন কমিশনকে জানাতে বলা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জেলা নদী রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহম্মেদ বলেন, কমিশনের চিঠি পাওয়ার পরপরই আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দেশের প্রচলিত আইনে দখল ও দূষনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বেসরকারি এ উন্নয়ন সংস্থার বিরুদ্ধে অবৈধ স্থাপনা তৈরির পাশাপাশি নদীর গতিপথ পাল্টে দেওয়া, বর্জ্য ফেলে ভরাট ও কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে নদীদূষণ, নদীতে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত ড্রেজার বসিয়ে অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের তথ্যও উঠে এসেছে জেলা প্রশাসনের এক প্রতিবেদনে।
গত বছর নদী কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার করতোয়া নদীর দখল-দূষনের অবস্থা দেখে দখলকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বগুড়া জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন। কমিশন সারা দেশে নদী অবৈধ দখলকারীদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দিলে বগুড়ার রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) মৌলি মণ্ডল অবৈধ দখলকারি হিসাবে ৪০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করে গত ২২ জুলাই কমিশনে পাঠান।
ওই তালিকায় করতোয়া দখলকারী হিসেবে টিএমএসএস ও বগুড়া ডায়াবেটিক সমিতির নামও রয়েছে। পরে কমিশন চেয়ারম্যান গত বছরের ৫ থেকে ৭ জুলাই বগুড়ায় করতোয়া, যমুনা ও বাঙ্গালী নদী পরিদর্শন করে যে প্রতিবেদন তৈরি করেন তাতে বগুড়া সদরের বারবাকপুর মৌজায় টিএমএসএস স্থাপনা তৈরি করেছে বলে উল্লেখ করা হয়।
এখনও টিএমএসএস করতোয়া দখল ও দূষণ করছে। অথচ প্রায় ৫ বছর আগে হাইকোর্ট করতোয়া নদীর দখল ও দূষণ রোধের পাশাপাশি পানির প্রবাহ স্বাভাবিক করতে নির্দেশ দিলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি গাইবান্ধা ও বগুড়ার জেলা প্রশাসন। এ অবস্থায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন অবৈধ দখল থেকে নদীকে রক্ষা করতে সিআরপিসির ১৩৩ ধারা প্রয়োগ করে রাষ্ট্রের জমি অবৈধভাবে দখলের দায়ে টিএমএসএসসহ অন্যসব অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ধারায় ফৌজদারি মামলা করতে পরামর্শ দেয়।
অভিযোগ উঠেছে, বগুড়া সদরের নওদাপাড়া মৌজায় মম ইন (ইকো পার্ক) পার্কের আবর্জনা করতোয়া নদীতে ড্যাম্পিং করা হচ্ছে। আর অবৈধভাবে নদী থেকে বালি তোলার কারণে নদীর ভূগর্ভ ভেঙে তীর বসে যাচ্ছে। কমিশন নদী রক্ষায় অবিলম্বে নদীতে ময়লা-আবর্জনা ড্যাম্পিং বন্ধ ও বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ, নদী, পানি ও পরিবেশ দূষণের দায়ে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পরামশ দেয়।
কমিশনের চিঠির একটি অংশে আরও উল্লেখ রয়েছে, মম-ইন এক্সটেনশন বিনোদন পার্ক, শেখেরকোলা তহশিলের আওতায় করতোয়া নদীতে বাঁধ দিয়ে কৃত্রিম আইল্যান্ড তৈরি করেছে টিএমএসএস। নদীর গর্ভস্থলে এ ধরনের কৃত্রিম আইল্যান্ড তৈরি করে নদীর সর্বনাশ করছে। এটি সম্পূর্ণ বেআইনি ও জরুরি ভিত্তিতে এসব উচ্ছেদ করতেও পরামর্শ দেয় কমিশন। টিএমএসএস মোট কত জমির মালিক তাও নদী কমিশনকে জানাতে বলা হয়েছে। টিএমএসএস রাষ্ট্রের বা নদীর জায়গা অবৈধ দখলে রেখে জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থি কাজ করেছে বলেও কমিশন চিঠিতে উল্লেখ করেছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে টিএমএসএস’র নির্বাহী পরিচালক হোসনে আরা বেগম বলেন, করতোয়া নদীয় দুই তীরের ৫ কিলোমিটার এলাকায় তাদের প্রতিষ্ঠানের ১০২ একর জমি রয়েছে। নদী ভাঙনে তাদের ৪০ একর জমি বিলীন হয়েছে। একই সঙ্গে তার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আনা বালি তোলার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, নিজের জমি থেকে বালি তোলা এবং মাটিকাটা আইনে বৈধ।
তিনি দাবি করেন, সরকারকে সহযোগিতা করতে তিনি নিজেই অবৈধভোবে বালি উত্তোলনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
জেলা প্রশাসন জানায়, গত ২৮ মার্চ বগুড়ার করতোয়া নদীর অবৈধ ৩০ দখলদারের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা হলেও আইনি জটিলতার কারণে টিএমএসএসসহ দুই ‘দখলদারকে’ বাদ দেয়া হয়েছে।
নথি খুঁজে পাওয়া গেছে, বগুড়ায় করতোয়া নদী দখল ও দূষণের সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ছিল বেসরকারি সংস্থা ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘের (টিএমএসএস) বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বগুড়া জেলার সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান বলেন, করতোয়া নদী দখল ও দূষণে অন্তত ৫০০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।