দেশে করোনার ভারতীয় ধরনের ‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশন’, আবার সংক্রমণ বৃদ্ধির শঙ্কা
দেশে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরনের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে। ভারতে যায়নি এমন সাতজনের শরীরে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন পেয়েছে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। ভারতীয় ধরনের কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের কারণে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ আরো বাড়তে পারে বলে শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। ভাইরাসের এ ধরনটির ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে লকডাউনসহ যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ তাদের।
আইইডিসিআর এর পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন বলেন, "দেশে আরও ১৩ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন শনাক্ত হয়েছে, তাদের মধ্যে সাতজন চাঁপাইনবাবগঞ্জের। ওই সাতজনের ভারতে যাওয়ার কোন ইতিহাস নেই। তাই এটি নিশ্চিত যে, কমিউনিটিতে ভারতীয় প্রকরণ ছড়াতে শুরু করেছে"।
তাহমিনা শিরিন বলেন, "করোনার ধরনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা। করোনার সংক্রমণ যত বাড়বে করোনাভাইরাস তার ধরন পরিবর্তন করে কমিউনিটিতে এর বিস্তার ঘটাতেই থাকবে। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে করোনার সংক্রমণ বন্ধ করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের"।
গত ৮ মে ভারত থেকে আসা দুই জনের শরীরে প্রথম করোনার ভারতীয় ধরন শনাক্ত হয়। এ নিয়ে দেশে ভারতীয় ধরনে আক্রান্ত মোট ২০ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং কোভিড-১৯ এর জনস্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ডা. আবু জামিল ফয়সাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কমিউনিটিতে ভারতীয় ধরন ছড়িয়ে পড়াটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। কারণ এই ভ্যারিয়েন্ট শিশুদেরও আক্রান্ত করে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে এখন সারাদেশে আমবাহী ট্রাক যাচ্ছে। ট্রাক ড্রাইভার ও হেলপারের মাধ্যমে ভারতীয় ধরন অন্য জেলাতেও ছড়ানোর ঝুঁকি রয়েছে। এখন কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে ও সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে কোভিড টেস্ট বাড়াতে হবে। পজেটিভ রোগী পাওয়া গেলেই তাকে কোয়ারেন্টাইন করতে হবে। সংক্রমণের এই শৃঙ্খল ভাঙ্গতে না পারলে সংক্রমণ দ্রুত বাড়বে"।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ পজেটিভ হয়েছে ১৫৬৭ জন। এর মধ্যে ৩২ জন মারা গেছেন। বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৪১৬ জন। করোনার সংক্রমণ মোকাবিলায় স্থানীয় প্রশাসন চাঁপাইনবাবগঞ্জে সোমবার পর্যন্ত লকডাউন ঘোষণা করেছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী বলেন, "সর্বশেষ ডাটা অনুসারে সংক্রমণ হার ৩৪%, আগে যা ৬২% ছিল। তবে সংক্রমণ হার কমায় এখনি স্বস্তির কোন কারণ নেই। ১৪ দিনের আগে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে কিছু বলা যাবে না"।
ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী বলেন, "জিনোম সিকুয়েন্সিংয়ের জন্য আমরা আইইডিসিআর এ ৪২টি স্যাম্পল পাঠিয়েছিলাম, আজ (শনিবার) সকালে আমরা জানতে পেরেছি তাদের মধ্যে সাতজনের শরীরে ভারতীয় ধরন পাওয়া গেছে। এখন আমরা ওই ৪২ জনের কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং করে তাদের আশেপাশের সবার কোভিড টেস্ট করবো। সংক্রমণ পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে লকডাউন তুলে নেয়া হবে কিনা। দেশব্যাপী সংক্রমণের হার এখন ৮%, সেখানে চাঁপাইনবাবগঞ্জে তা প্রায় চারগুণ বেশি"।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে সংক্রমণের হার কিছুটা কমলেও রাজশাহীতে সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে। সীমান্তবর্তী জেলা কুষ্টিয়ায়ও ঈদের পর থেকে করোনা রোগী বাড়ছে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে এখানে শনাক্তের সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি।
করোনার সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে তা কমাতে রাজশাহীতেও বিশেষ লকডাউন দেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজাদানী।
তিনি বলেন, "হাসপাতালে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ করোনা রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে এরপর আরও রোগী ভর্তি হলে তখন চিকিৎসা সেবা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এখন প্রতিটি রোগীর জন্য সেন্টাল অক্সিজেনসহ হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত প্রতিটি বেডে রোগীদের এসব ব্যবস্থা করা আছে। ফলে এখন পর্যন্ত হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বেশিরভাগ রোগী সুস্থ হয়ে গেছেন। এরপর রোগী ভর্তি হলে তখন একই বেডে ডাবল রোগী রাখা কিংবা ফ্লোরে রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে অক্সিজেনের সুবিধা দেওয়া সম্ভব হবে না।"
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাজশাহী ছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, জয়পুরহাট, পাবনা, কুষ্টিয়া জেলার রোগীরাও চিকিৎসা নিতে আসেন।
শামীম ইয়াজদানী বলেন, "যেভাবে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে তাতে রাজশাহীতেও করোনার ভারতীয় ধরনের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। তবে কোন এলাকায় বেশি হয়েছে কিংবা কারা বেশি শনাক্ত হচ্ছেন তা আরও বিস্তৃত গবেষণা করেই বলা সম্ভব হবে। জিনোম সিকোয়েন্স পরীক্ষার মাধ্যমেই তা জানা যাবে। তবে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সংক্রমণ কমাতে লকডাউনের বিকল্প নেই।"
রাজশাহীর করোনার সংক্রমণ প্রতিদিন বেড়েই চলছে। এদিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত ও করোনার উপসর্গ নিয়ে গত পাঁচ দিনে ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। শনিবারও হাসপাতালে মারা গেছেন ৭ জন। এছাড়া সারাদেশে ১৩ জনের করোনার ভারতীয় ধরন শনাক্ত হয়েছে, যার মধ্যে ৭ জনই চাঁপাইনবাবগঞ্জের।
এদিকে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩৮ জন মারা গেছেন। এ নিয়ে মোট প্রাণহানি হলো ১২,৫৪৯ জনের।
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যে ১.৫৭ শতাংশেই মৃত্যুহার অপরিবর্তিত রয়েছে।
একইসময় নতুন করে কোভিড-১৯ পজিটিভ শনাক্ত হয়েছে ১,০৪৩ জন। এ নিয়ে মোট শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭,৯৭,৩৮৬।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. শরফুদ্দিন আহমেদ বলেন, "ভারতীয় ধরন অনেক বেশি সংক্রামক। দেশে ভারতীয় ধরনের বিস্তার রোধে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে কঠোর লকডাউন দিতে হবে। যেহেতু সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে তাই চিকিৎসা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে"।