পূর্বাচল প্রকল্প: ২৫ বছর পরে এসে এখনো অন্ধকারে
১৯৯৫ সালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও গাজীপুরের কালীগঞ্জের অংশবিশেষ নিয়ে 'পূর্বাচল নতুন শহর' নামে যে প্রকল্প রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেছিল, ২৫ বছর পর এসে সেই শহরের ভূমি উন্নয়নের কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ৬৭ ভাগ।
পাঁচবার নকশা পরিবর্তন ও ছয়বার মেয়াদ বাড়িয়ে রাজউক প্রকল্পটি আগামী বছরের জুন মাসে শেষ করবে বলে সর্বশেষ অঙ্গীকার করেছে। অথচ প্রকল্পের মোট ২৬ হাজার প্লটের মধ্যে ১১ হাজার প্লট এখনো তৈরিই হয়নি।
যে ১৫ হাজার প্লট রাজউক এখন পর্যন্ত ক্রেতাদের কাছে হস্তান্তর করেছে, সেগুলোও পূর্ণাঙ্গ নয়। রাস্তাঘাট হয়নি। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির সংযোগ কবে পাওয়া যাবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। হস্তান্তর করা অনেক প্লটই এখনো খানা-খন্দকে ভরা।
পূর্বাচলের একটি সেক্টরকে বাণিজ্যিক শহর বানাতে ৪৬৫ মিটার উচ্চতার ৯৬ তলা আইকনিক, ৭১ তলার স্বাধীনতা ও ৫২ তলার ভাষা টাওয়ারসহ অনেকগুলো সুউচ্চ ভবন নির্মাণের কথা থাকলেও এখনো কোনো কাজই শুরু হয়নি।
পূর্বাচলের একটি অংশ আবার পড়েছে ভাওয়াল বনাঞ্চলে। এই অংশকে প্রকল্পের আওতাভুক্ত করা নিয়ে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা আছে। এখানকার অধিবাসীরাও জমির দখল ছাড়ছেন না। প্রকল্পের বিভিন্ন প্লট নিয়ে অনিয়মের কারণে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় উচ্চ আদালতে মামলা আছে অর্ধ শতাধিক।
এরকম হযবরল অবস্থায়ও রাজউক আগামী সাত মাসের মধ্যেই প্রকল্পের সব কাজ শেষ করার অঙ্গীকার করে যাচ্ছে।
রাজউকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও পূর্বাচল প্রকল্পের পরিচালক উজ্জ্বল মল্লিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'প্রকল্প শেষ করতে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত সময় আছে আমাদের হাতে। যেসব প্লট হস্তান্তর করা হয়নি, সেগুলো প্রস্তুত করার কাজ চলছে। আশা করি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আমরা কাজ শেষ করতে পারব।'
আগামী সাত মাসের মধ্য প্রকল্প বাস্তবায়নের অঙ্গীকারকে হাস্যকর ও কৌতুক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন নগর বিশেষজ্ঞরা।
নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, 'সাত মাস! এই প্রকল্প তো ২০৩০ সালের মধ্যেও শেষ করা সম্ভব হবে না। প্লটগুলোই তো এখনো তৈরি হয়নি। এরপর আছে রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ, বিদ্যুৎ, গ্যাস, সুয়্যারেজ লাইন স্থাপনের কাজ।'
নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, সরকার দলীয় লোকজনকে সুবিধা দিতে প্রকল্পের মেয়াদ বারবার বাড়ানো হচ্ছে। প্রকল্পের মূল নকশা পাল্টিয়ে তৈরি করা হয়েছে নতুন নতুন প্লট। এগুলো নীতিবিরোধী কাজ।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, 'এটি হচ্ছে লুটপাটের একটি প্রকল্প। রাজনৈতিক সরকারের প্রভাবশালীরা ইচ্ছামতো এখানে প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন। দুর্নীতি ও অনিয়মের যত অপকর্ম আছে, এই প্রকল্পে তার সবকিছু লক্ষ্য করা গেছে।'
২৫ বছরের অগ্রগতি
পূর্বাচল নতুন শহরের জন্য মোট ৬১৫০ একর সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে রাজউক। এই জমির ৪৫০০ একর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানায়, ১৫০০ একর গাজীপুরের কালীগঞ্জ থানায় এবং বাকি ১৫০ একর খিলক্ষেত থানায়।
৩৩টি সেক্টরে ভাগ করে প্রকল্পটি সাজানো হয়েছে। এতে ২৬ হাজার প্লট নির্মাণ করার কথা। ১৫ বছর মেয়াদী প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শেষ হওয়ার কথা ২০১০ সালে। ৬ বার মেয়াদ বাড়িয়ে সর্বশেষ ২০২১ সালের জুন মাসে প্রকল্পের কাজ শেষ করার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত প্রকল্পের এক তৃতীয়াংশের ভূমি উন্নয়নের কাজও হয়নি।
পূর্ত সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, রাজউক বা গণপূর্ত বিভাগের একক সিদ্ধান্তে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়নি। আন্তঃমন্ত্রণালয় ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় যৌক্তিক কারণে মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, প্রকল্পের ছয়টি সেক্টরে বিদ্যুতের পোল স্থাপন করা হলেও মাত্র তিনটিতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। মাত্র আটটি সেক্টরে পানি নিঃসরণের ড্রেন করা হয়েছে। কিন্তু কোনো সেক্টরেই সুয়্যারেজ লাইন বসানো হয়নি। গ্যাস সংযোগের কোনো উদ্যোগও এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।
রাজউকের চেয়ারম্যান সাঈদ নূর আলম টিবিএসের কাছে দাবি করেছেন, প্রকল্পের অধিকাংশ সেতু, কালভার্ট নির্মাণ শেষ হয়েছে। রাস্তার কাজও অর্ধেকের বেশি সম্পন্ন হয়েছে। বাকিগুলোর কাজ চলমান।
তিনি বলেন, 'এখন বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সুয়্যারেজ লাইনের কাজ ধরা হবে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। আগামী সাত মাসের মধ্যে সব কাজ শেষ করতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।'
ওয়াসার ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (অ্যাডমিন) মোঃ মাহমুদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, পূর্বাচলে পানি সরবারহ ও নিষ্কাশনের প্রকল্প আছে। কিন্তু উপযুক্ততা না থাকায় এখনো কাজ শুরু করা যায়নি।
বিদ্যুৎ বিভাগ ও তিতাসের দায়িত্বশীলরাও প্রায় একই কথা জানিয়েছেন।
বাণিজ্যিক শহর নির্মাণের কাজই শুরু হয়নি
২০১৭ সালে মূল নকশা সংশোধন করে ১৯ নম্বর সেক্টরে ১১৪ একর জমির ওপর বাণিজ্যিক শহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা হাতে নেয় রাজউক। এই শহরে হওয়ার কথা ৪৬৫ মিটার উচ্চতার ৯৬ তলা আইকনিক লিগ্যাসি টাওয়ার, ৭১ তলার স্বাধীনতা টাওয়ার ও ৫২ তলার ভাষা টাওয়ারসহ ৪১টি গগণচুম্বী ভবন।
গণপূর্ত সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার টিবিএস বলেন, বাণিজ্যিক শহর নির্মাণের জন্য গত বছরের জুলাই মাসে সিঙ্গাপুরের একটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হলেও তারা কোনো কাজ করেনি। এজন্য তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, আরব আমিরাতসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, সিঙ্গাপুরের কোম্পানিটি ভবন নির্মানের জন্য পূর্বাচলের ভূমি পরীক্ষা করে দেখেছে সেখানে ৫০ তলার চেয়ে উঁচু ভবন নির্মাণ করা সম্ভব নয়।
প্রকল্পভুক্ত বনাঞ্চল নষ্ট না করতে হাইকোর্টের নির্দেশনা
কালিগঞ্জের পারাবর্ত ও বড়কাউ মৌজার বনাঞ্চল ঠিক রেখে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ২০১৭ সালে রাজউককে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। পরিবেশবাদীদের এক রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের ওই আদেশে বলা হয়, প্রকৃতি ঠিক রাখার শর্তে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র মিললে এই দুই এলাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাবে।
পরিবেশ অধিদপ্তর এখনো রাজউককে কোনো ছাড়পত্র দেয়নি। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. একেএম রফিক আহাম্মদ টিবিএসকে বলেন, 'হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা সব কিছু পর্যবেক্ষণ করছি। রাজউক আদালতের নির্দেশনা অনুসরন করলে আমরা ছাড়পত্র দেব। তবে ছাড়পত্র দেওয়ার মতো অবস্থা এখনো দৃশ্যমান নয়।'
পারাবর্ত মৌজার বাসিন্দা জাফর উদ্দিন বলেন, 'পারাবর্ত ও বড়কাউ মৌজার অধিগ্রহণ করা দেড় হাজার একর জমির মধ্যে ৬০ ভাগের বেশি এখনো আমরা ছাড়িনি।'
তিনি বলেন, কালিগঞ্জের পারাবর্ত ও বড়কাউ এই দুই এলাকার জমিগুলোর বেশিরভাগ ব্যক্তিগত বনাঞ্চল, যা ভাওয়াল বনাঞ্চলের মধ্যে পড়েছে। এসব বনাঞ্চল উজাড় করে বিভিন্ন সময় রাজউক প্লট বানানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু এলাকাবাসি সোচ্চার হওয়ায় সেখানে অধিগ্রহণ করা জমির ৪০ ভাগের বেশি ভূমি দখলে নিতে পারেনি।
এই দুই মৌজার বনাঞ্চল সুরক্ষা কমিটির অন্যতম সদস্য জাহাঙ্গীর আলম জানান, রাজউক এই এলাকার প্রায় ১৫ হাজার গাছ কেটেছে। বনাঞ্চল রক্ষার জন্য স্থানীয় অধিবাসীরা এখন আন্দোলন শুরু করেছে।
প্রকৃতি, কৃষি জমি, জলাশয় ও নদী দখল করে রাজউক পূর্বাচল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে- এই অভিযোগে প্রকল্পের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে হাইকোর্টে হাইকোর্টে রিট করেছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতিসহ (বেলা) সাতটি পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠন।
বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান টিবিএসকে বলেন, প্রকল্পটির অবস্থান বালু ও শীতলক্ষা নদীর মাঝামাঝি এলাকায়। এর একটা অংশ পড়েছে ভাওয়াল বনাঞ্চল এলাকায়। একটা অংশ রাজধানীর ফ্লাড-ফ্লো জোন হিসেবে চিহ্নিত। এখানে বেশ কয়েকটা খাল ও জলাশয়ও আছে। এগুলো ধ্বংস করে প্রকল্প বাস্তবায়ন আইনবহির্ভূত।
আরও অর্ধশতাধিক রিট
রাজউক ও সুপ্রিম কোর্ট সুত্রে জানা যায়, আইন লংঘন করে পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এমএ হাসেমের পরিবারের সাত সদস্যের নামে ১০ কাঠা করে প্লট বরাদ্দের বিরুদ্ধে একজন অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ন সচিব হাইকোর্টে রিট করেছিলেন। আগে দেওয়া ৫০০ প্লটের বরাদ্দ নতুন দুইজনকে দেওয়ার বিরুদ্ধে আদালতে রিট করেছেন প্রথম বরাদ্দ পাওয়া ৪৪ জন।
পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দে অনিয়ম নিয়ে রিট করেছেন আরও ৮ জন। কোনো রিটেরই এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
রিটকারীদের একটি পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার শাহরিয়ার কবির বলেন, রিটগুলোর নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত প্রকল্পের যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কারণ বেশ কয়েকটি রিটে হাইকোর্ট কয়েকটি সেক্টরের প্লট বরাদ্দের কার্যক্রম স্থগিত রেখেছেন।