প্রতিদিন ৫০ কোটি লিটার পানি শোধিত হয়ে ঢাকা উত্তরের প্রয়োজন মেটাবে গন্ধর্বপুর প্রকল্প
ঢাকা ওয়াসা কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন 'ঢাকা এনভায়রনমেন্টালী সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই (ডিইএসডব্লিউএস)' এর গন্ধর্বপুর প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৫০ কোটি লিটার পানি পরিশোধিত হয়ে ঢাকা উত্তরের বেশ কয়েকটি এলাকায় সরবরাহ করা হবে বলে জানিয়েছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রায় ২৪ কিলোমিটার পানির লাইন নির্মাণের চুক্তি অনুষ্ঠানে একথা জানানো হয়।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও এ অনুষ্ঠিত এক সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ঢাকা ওয়াসা ও চায়না জিও- ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশনের মধ্যে প্রকল্পটির প্যাকেজ-৩.১ এর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ প্যাকেজের ব্যয় ধরা হয়েছে ৫১৮ কোটি টাকা।
চুক্তিপত্রে ঢাকা ওয়াসার পক্ষে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান এবং চায়না জিও- ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশনের পক্ষে কোম্পানিটির সিইও কিন ইয়ং স্বাক্ষর করেন।
এ প্যাকেজের আওতায় রাজধানীর বারিধারা ক্রসিং হতে রামপুরা ও বারিধারা হতে এয়ারপোর্ট রোড, উত্তরা, গুলশান, বনানী, কচুক্ষেত ইত্যাদি এলাকায় প্রায় ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ৮০০-১৬০০ মিলিমিটার ব্যাসের ডিস্ট্রিবিউশন রিইনফোর্সমেন্ট (প্রাইমারী) পানির লাইন নির্মাণ কাজ করা হবে।
চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বলেন, "ঢাকা ওয়াসা বিশ্বের মধ্যে বৃহৎ পানি সরবরাহকারী সংস্থা। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ঢাকা ওয়াসা একটি রোল মডেল। এটা আমরা বলছি না, বলছে বিশ্ব ব্যাংক, এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংক। ঢাকা ওয়াসা দুই কোটি মানুষকে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করছে। আমাদের ভালো ইঞ্জিনিয়ার, প্রশাসনিক লোকবল রয়েছে বলেই এটা সম্ভব হয়েছে"।
তিনি আরও বলেন, "সারা বিশ্বে ৭ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে ২ বিলিয়ন মানুষ নিরাপদ পানি পাচ্ছে না। এ সংখ্যা অনেক বড় একটা সংখ্যা তবে বাংলাদেশে এ সংখ্যাটা খুব বেশি না। গন্ধর্বপুর প্রকল্পটির কাজ সম্পন্ন হলে ঢাকার উত্তর-পশ্চিমাংশের মানুষ সবাই নিরাপদ পানি পাবে"।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, "আমরা ভূগর্ভস্থ পানি কাজে লাগাতে পারছি না। কারণ সেখানে অসংখ্য বর্জ্য রয়েছে, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং ব্যবহার উপযুক্ত নয়। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকা সিটিতে অসংখ্য প্রকল্প চলমান রয়েছে এবং সামনে আরও প্রকল্প আসছে। আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলে পানির স্বল্পতা রয়েছে। কারণ সেখানে লবণাক্ত পানিসহ অসংখ্য সমস্যা রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে সেখানে পানির স্বল্পতা দেখা যায়। সেজন্য নিরাপদ পানি সরবরাহের জন্য সারাদেশে 'ন্যাশনাল ওয়াটার গ্রিড লাইন' তৈরির জন্য চেষ্টা করছি, এটি নিয়ে আমরা কাজ করছি"।
তিনি আরও বলেন, "বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ এবং হিমালয়ের ডাউনস্ট্রিমে থাকায় পানির খুব একটা সমস্যা নেই। তবে আমরা এখনো পরিপূর্ণভাবে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে পারছি না। গ্রাম থেকে শহরে আমাদের অবশ্যই বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা দরকার। পাবলিক হেলথ ডিপার্টমেন্টের নেতৃত্বে ৯৮ শতাংশ মানুষ পানির আওতায় এসেছে"।
স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের 'ঢাকা এনভায়রনমেন্টালী সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই (ডিইএসডব্লিউএস)' প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ঢাকা ওয়াসা যেখানে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি), ফ্রান্স ডেভেলপমেন্ট এজেপি (এএফডি) এবং ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (ইআইবি) এ তিনটি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা প্রকল্পে অর্থায়ন করছে।
মেঘনা নদীর পানি শোধনের জন্য নেওয়া প্রকল্পটির নাম 'ঢাকা এনভায়রনমেন্টালি সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই' হলেও এ প্রকল্পটি 'গন্ধর্বপুর পানি শোধনাগার প্রকল্প' নামেই পরিচিত।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের বিষনন্দী পয়েন্টের মেঘনা নদী থেকে পানি আনা হবে সিদ্ধিরগঞ্জের গন্ধর্বপুর এলাকায় নির্মাণাধীন শোধনাগারে। সেখানে শোধন করে পাইপলাইনের মাধ্যমে তা রাজধানীর উত্তরের উল্লেখিত এলাকার বাসায় বাসায় সরবরাহ করা হবে।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে একনেকে পাশ হওয়া প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫২৪৮ কোটি টাকা। সংশোধিত ব্যয় বাড়িয়ে ৮১৫১ কোটি টাকায় করা হয়েছে। এ প্রকল্পটির মেয়াদকাল ২০২২ এর জুন মাস পর্যন্ত করা হয়েছে। তবে প্রকল্পটির কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ৪০ শতাংশ।
প্রকল্পটির প্রথম প্যাকেজে ডিজাইন বিল্ড অপারেট (ডিবিও) প্যাকেজের আওতায় নারায়ণগঞ্জ জেলার আড়াইহাজার উপজেলার বিশনন্দী এলাকায় মেঘনা নদীর তীরে প্রথম পর্যায়ে দৈনিক ১০৫ কোটি লিটার (১০৫০ এমএলডি) অপরিশোধিত পানি উত্তোলনের জন্য ইনটেক/পাম্পিং স্টেশন স্থাপন, বিশনন্দী ইনটেক থেকে রূপগঞ্জের গন্ধর্বপুর পর্যন্ত টুইন র' ওয়াটার ট্রান্সমিশন লাইন নির্মাণ এবং রূপগঞ্জের গন্ধর্বপুরে ওয়াসা'র নিজস্ব জায়গায় দৈনিক ৫০ কোটি লিটার ক্ষমতা সম্পন্ন পানি শোধনাগার (ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে।
২য় প্যাকেজে গন্ধর্বপুরে পানি শোধনাগারের ভেলিভারী লাইন হতে ঢাকার বারিধারা ভাটারা পয়েন্ট পর্যন্ত প্রায় ১৪ কি: মি: দীর্ঘ ১৬০০ মি:মি: ব্যাসের টুইন পরিশোধিত পানির ট্রান্সমিশন লাইন নির্মাণ কাজের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং এ বছরের নভেম্বরে কাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া ৩য় প্যাকেজের অন্য একটি অংশে উত্তরা, গুলশান, বনানী, বাড্ডা, উত্তরখান, দক্ষিণখান ইত্যাদি এলাকায় স্থাপিত ডিএমএগুলোতে পানি সরবরাহের জন্য ৪৫ কি: মি: (৪০০-৭০০ মিঃমিঃ ব্যাস) ফিডার লাইন (সেকেন্ডারি ডিস্ট্রিবিউশন) স্থাপন কাজ করার কাজও এগিয়ে চলছে।
প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মাহমুদুল ইসলাম খান প্রকল্পটি সম্পর্কে বলেন, "আমাদের গন্ধর্বপুর প্রকল্পের কাজ শেষ হলে টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পানি সরবরাহ লাইন নিশ্চিত করতে পারব। তখন ভূ-উপরিস্থ পানির উৎস থাকবে ৭০ শতাংশ আর ভূ-গর্ভস্থ পানির উৎস থাকবে মাত্র ৩০ শতাংশ। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে পরিশোধিত পানি ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন লাইনের মাধ্যমে ঢাকা মহানগর উত্তর-পশ্চিমাংশে প্রেসারাইজড সিস্টেমে পানি সরবরাহ করা"।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর গন্ধর্বপুর পানি শোধনাগার প্রকল্পের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।