চট্টগ্রামের বন গবেষণা ইনিস্টিটিউটের দৃষ্টিনন্দন এক বাঁশ-উদ্যান
জীবনধারণের নানা কাজে প্রয়োজনীয় উদ্ভিদ বাঁশের প্রজাতি-বৈচিত্রের দিক থেকে বাংলাদেশ পৃথিবীতে অষ্টম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ‘গ্লোবাল ব্যাম্বু রিসোর্সেস’ শিরোনামে এক গবেষণায় জানিয়েছে এ তথ্য।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৫০০ প্রজাতির বাঁশ নিয়ে পৃথিবীতে প্রথম স্থানে অবস্থান চীনের। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ব্রাজিলের রয়েছে ২৩২ প্রজাতি। তালিকায় ১৩৯ প্রজাতি নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে জাপান। বাংলাদেশে আছে ৩৩ প্রজাতির বাঁশ।
বাঁশের নতুন নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করে বাংলাদেশকে এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে, চট্টগ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)।
প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক ভবনের উত্তর পশ্চিম পাশে রয়েছে ‘বাঁশের সংগ্রহশালা’। ৫ একরের এ সংগ্রহশালায় দিকে তাকালে দেখা যায় আকাশছোঁয়া একটি বাঁশ। নাম ‘ভুদুম বাঁশ’। বাগানের সবচেয়ে বড় ও সুউচ্চ এ বাঁশটির উচ্চতা ১৩০ ফুটের মতো। বাঁশটির ব্যাসও প্রায় দুই ফুট। আবার রয়েছে জোড়া লাগানোর কলসির মতো ঘটি বাঁশও।
৩৩ প্রজাতির বাঁশ নিয়ে গঠে ওঠা এই বিশাল সংগ্রহশালায় জলবায়ুসহিষ্ণু আরও ৬টি নতুন প্রজাতির বাঁশের জাত উদ্ভাবনে কাজ করছে বিএফআরআই।
গবেষণায় মিলেছে সফলতাও। আগামী ছয় মাসের মধ্যে দেশে যুক্ত হবে এ নতুন ছয় প্রজাতির বাঁশ। তবে কী নাম দেওয়া হবে এসবের তা এখনও নির্ধারণ করা হয়নি।
বাঁশের এই সংগ্রহশালায় গ্রামীণ ও পাহাড়ি বাঁশ মিলিয়ে মোট ৩৩ প্রজাতির বাঁশ রয়েছে। এর মধ্যে ২৬টি প্রজাতি গ্রামীণ এবং ৭টি পাহাড়ি বাঁশ।
এই ৩৩ প্রজাতি হল, বরাক, কাঁটা, বিষকাঁটা, মিরতিঙ্গা, বেথুয়া, কনক কাইচ, তেঁতুয়া, চৈই, মাকলা বা মিতিঙ্গা, ফারুয়া, করজবা, মিরতিঙ্গা, বাইজ্জ্যা, স্বর্ণ, ঘটি, হেজ, ব্রান্ডিসি, ভুদুম, পেঁচা, ওরা, মেমব্রা, লাঠি, কালি, টেন্ডু, কালা, লতা, মূলী, ডলু, থাই, রেঙ্গুন, তল্লা প্রজাতি, ওয়াপ্পি এবং চায়না প্রজাতি।
বাঁশের যত ব্যবহার
ঝোপঝাড়ে থাকলেও বাঁশের রয়েছে অনেক গুণ। নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় উদ্ভিদটি। এর ফলনও করা যায় যত্রতত্র।
গবেষকরা বলছেন, দেশের দ্রুত বর্ধনশীল উদ্ভিদের অন্যতম হচ্ছে বাঁশ। আবার দেশের কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ এবং মাটির ক্ষয়রোধ এবং নদীর ভাঙন থেকে রক্ষার জন্য বিশেষভাবে ব্যবহার হতে পারে বাঁশবাগান। জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ মোকাবেলা ও ভূমিক্ষয় রোধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বাঁশঝাড়। প্রতি ২৪ ঘন্টায় এক থেকে দেড় ফুট বাড়ে বাঁশ। তিন মাসে বাড়ে প্রায় ১০০ ফুট পর্যন্ত। অন্যান্য উদ্ভিদের যেখানে পরিপক্ক হতে আট থেকে ১০ বছর সময় লাগে সেখানে বাঁশের লাগে চার থেকে পাঁচ বছর।
উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সাত ধরনের বাঁশ বেশি দেখা যায়। এর মধ্যে বরাক, করজবা, বাইজ্জা, তল্লা, মাকলা, ভুদুম অন্যতম। এসব প্রজাতির বাঁশের কান্ড পুরু ও কাষ্ঠল বলে ঘরের বেড়া ও খুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া পাকা বাড়ি তৈরির সময় ছাদ ঢালাই দিতেও এসব বাঁশের প্রয়োজন হয়। তাছাড়া প্রতি বছর বিভিন্ন কাজে ১০ লাখ টন কাঁচা বাশের ব্যবহার হয়ে থাকে। বাঁশের তৈরি ফার্নিচারও এসেছে বাজারে। কাঠের মতো টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে এ বাঁশের ফার্ণিচার।
বিএফআরআইয়ের এ বাঁশের সংগ্রহশালার প্রবেশপথেই চোখে পড়ে ৩৩ প্রজাতির বাঁশের নাম ও বৈজ্ঞানিক নাম এবং কোথায় পাওয়া যায় এসব বাঁশ তার একটি বড় সাইনবোর্ড। বাঁশ সংগ্রহশালার খাড়া পথ বেয়ে উপরে উঠার সময় হাতের বাঁ-পাশে লাগানো হয়েছে শোভাবর্ধনকারী হেজ বা বেড়া বাঁশ। আরেকটু সামনে গেলে দেখা যাবে ১০ থেকে ১২ ফুটের ঘটি বাঁশ। তার পাশেই দেখা যাবে ছোট আকৃতির চায়না বাঁশ।
প্রতিটি বাঁশেঝাড়ের সামনে রাখা হয়েছে নামফলক। সংগ্রহশালার ভেতরে গেলেই দেখা যায় কাটা বাঁশ, ওরা বাঁশ, ছোট ছোট আকৃতির মিতিঙ্গা বাঁশ ও মিথিয়া বাঁশ। পাঁচ একরের এ বাগানের কোনো কোনো বাঁশ মোটা, আবার কোনোটা গিরাযুক্ত। কিছু বাঁশ লতানো, কোনোটির রং সোনালি। আবার কতগুলো ছাতার মতো ঘন আচ্ছাদন তৈরি করেছে মাথার ওপর। ছায়াসুনিবিড়।
বাঁশের বনে শোনা যায় পাতার শন শন শব্দ। সঙ্গে আছে বিভিন্ন পাখির কিচির-মিচির। বাইজ্যা বাঁশ এবং ভুদুম বাঁশের বিশাল আকার চোখ জুড়াবে যে কারও।
কোন বাঁশ কোথায় পাওয়া যায়
সিলেট অঞ্চলে বেশি দেখা যায় তল্লা, মাকলা ও করজবা বাঁশ। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাইজ্জা, যশোর ও খুলনা অঞ্চলে বরাক এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলে পাওয়া যায় ভুদুম বাঁশ। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ প্রায় সারা দেশেই মুলি বাঁশের দেখা মেলে। এই বাঁশ রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনায় অবস্থিত কর্ণফুলী কাগজের কলের প্রধান কাঁচামাল হিসেবেও ব্যবহার হয়। ২০১০ সালে চীনের বাঁশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান এই সংগ্রহশালা থেকে দেশি মুলি বাঁশের বীজ সংগ্রহ করে। বিনিময়ে তারা চায়না বাঁশের প্রজাতি দেয়।
বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. খুরশীদ আকতার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, “১৯৭৩ সালে পাঁচ একর জায়গার ওপর গড়ে তোলা হয় বাঁশ উদ্যান। বাঁশ উদ্যান বাঁশের প্রজাতি সংরক্ষণের পাশাপাশি বাঁশঝাড় ব্যবস্থাপনা, চারা উৎপাদন, বীজ সংরক্ষণ এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করছে। তাছাড়া আমরা গাছের উপর চাপ কমানোর জন্য বাঁশের তৈরি ফার্নিচার প্রক্রিয়াজাত করছি। দীর্ঘস্থায়ী ও দৃষ্টিনন্দন এসব ফার্নিচার বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।”