বাংলাদেশের কোভিড-১৯ থেকে শিক্ষা নিতে পারে বিজ্ঞান, কিন্তু সেই খেয়াল নেই কারও
কথায় আছে, সংখ্যা কখনো মিথ্যা বলে না।
বাংলাদেশে করোনার মৃত্যুহার নিয়ে যে রেকর্ড আছে, তা উন্নত বিশ্বের তুলনায় চমকে ওঠার মতো। ইউরোপ কিংবা আমেরিকার মতো উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো যেখানে পরিস্থিতি সামলাতে কাহিল, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থা যে কাউকে অবাক করবে।
রেকর্ড অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি লাখে পাঁচ জন করে মারা যাচ্ছে। অন্যদিকে, প্রতি লাখে মৃত্যুহার ইতালিতে ১৩০.৩, যুক্তরাজ্যে ১২০.২, যুক্তরাষ্ট্রে ১১৩.১, স্পেনে ১১০.৯ এবং জার্মানিতে ৪৯।
এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মৃত্যুহার অনেক কম। ভারত ও মালদ্বীপে প্রতি লাখে মৃতের সংখ্যা যথাক্রমে ১১ ও ৯ জন।
কিন্তু এই মৃত্যুহার হিমশৈলের দৃশ্যমান চূড়া মাত্র। এর পেছনে মূল কারণ এখনো আমাদের অজানা।
বিগত কয়েক মাস ধরে বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের মৃত্যুহার কম হওয়ার কারণ হিসেবে বেশ কিছু তত্ত্ব দিয়ে আসছেন। বাংলাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি হওয়া কিংবা অন্যান্য ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থাকায় এ দেশের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি ও মৃত্যহার কম বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু কোনো তত্ত্বেরই বৈজ্ঞানিক সমর্থন নেই।
কারণ অনুসন্ধানে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশি কিংবা আন্তর্জাতিক গবেষকদের কোনো কাজও নেই।
বিজ্ঞান অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন নিয়ে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশে করোনার এই ব্যতিক্রমী পরিস্থিতির কারণ বিজ্ঞানীদের কাছে এখনো অজানা।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একমাত্র বিশেষায়িত বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমেই রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব।
এ ধরনের গবেষণার ফলাফল ভবিষ্যতে ভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতকে প্রস্তুত হতে সাহায্য করবে। বিশেষজ্ঞরা তাই বহুদিন ধরেই কর্তৃপক্ষকে স্বল্প মৃত্যহারের কারণ উদ্ঘাটনে গবেষণায় নামার তাগিদ দিচ্ছেন।
বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে উন্নতমানের গবেষণা হলে অন্যরাও তা থেকে অনেক কিছু জানতে পারবে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনার জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির (এনটিএসি) সদস্য এবং ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, 'আমরা যা বলছি তা শুধুই অনুমান। প্রকৃত চিত্র খুঁজে পেতে এখন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের প্রয়োজন।'
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের(আইইডিসিআর) পরিচালক ড. তাহমিনা শিরিন বলেন, 'আমাদের প্রতিষ্ঠান পরীক্ষার জন্য সংগৃহীত নমুনাগুলো সংরক্ষিত রাখছে। পরবর্তীকালে নমুনাগুলো গবেষণায় ব্যবহৃত হবে।'
যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বহু দেশ সম্প্রতি পুনরায় লকডাউন জারি করেছে।
ইউরোপে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির মাত্রা লক্ষণীয়। জার্মানি ও বেলজিয়ামে মৃতের সংখ্যা নতুন মাইলফলক ছুঁয়েছে।
রোববার বেলজিয়ামে মৃতের সংখ্যা সর্বোচ্চ ২০ হাজারে পৌঁছেছে। অন্যদিকে জার্মানিতে মৃতের সংখ্যা এখন ৪০ হাজার। ভ্যাকসিন বন্টন সম্পন্ন হওয়ার আগে অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন দেশটির চ্যান্সেলর আঞ্জেলা মার্কেল।
এদিকে উন্নত বিশ্ব যখন করোনায় নাজেহাল, তখন বাংলাদেশকে দেখে বেশ প্রফুল্ল বলেই মনে হবে।
মার্চ থেকে মে পর্যন্ত কঠোর লকডাউনের পর জুন থেকে নতুন উদ্যমে দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালু হয়। বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাংলাদেশের সকল খাতেই স্বাভাবিক কার্যক্রম বিদ্যমান। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতিও বেশ আশাব্যঞ্জক।
বাংলাদেশে ভ্যাকসিন আসতে এখনো মাসখানেক লাগতে পারে। কিন্তু রাস্তাঘাটে নামলে দেখা যাবে মাস্ক পরিধান এবং সামাজিক দূরত্ব রক্ষার বিষয়ে অধিকাংশ মানুষ সম্পূর্ণ উদাসীন।
গত বছর সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে দক্ষিণ এশিয়া সংক্রমণের হটস্পট হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন অনেক আন্তর্জাতিক গবেষক।
কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
সবকিছু মিলেই বাংলাদেশ এখন এক কৌতুহল উদ্রেককারী বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা গবেষণার বিষয়ে যা বলছেন
ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসের ভিন্ন প্রকরণে মানুষের আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি গবেষণার মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে। এর ফলে মানবদেহ যে অ্যান্টিবডি তৈরি করে রেখেছে, তার কারণেই আমাদের ভোগান্তি কম বলে জানান আইইডিসিআর পরিচালক তাহমিনা শিরিন।
'বর্তমানে আক্রান্ত ও মৃত্যুহার লক্ষণীয়ভাবে কমে গেছে। গবেষণা পরিচালনার অনুমতি পেতে যে দাপ্তরিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, তা সময়সাপেক্ষ। কিন্তু ভবিষ্যতে গবেষণা করার জন্য আমরা নমুনা সংগ্রহ করে রেখেছি,' বলেন তিনি।
ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল বলেন, 'আমার হাইপোথিসিস অনুসারে, শীতকালে বাংলাদেশে অন্য চারটি ভাইরাসের আধিপত্যের কারণেই করোনাভাইরাস আমাদের তেমন ক্ষতি করতে পারছে না।'
কিন্তু তারপরও প্রমাণের জন্য আমাদের প্রয়োজন গবেষনার। 'আমরা যদি ভাইরাসের ব্যাপারে ঠিকমতো জানতে না পারি, তাহলে এক সময় সংক্রমণ আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।'
অন্যদিকে, কারণগুলো খুঁজে বের করা গেলে দেশের মানুষের জন্য নতুন করে সংক্রমণ প্রতিরোধ করাও সহজ হবে বলে জানান ড. নজরুল ইসলাম।
'আমি চাই আইইডিসিআর এবং আইসিডিডিআর, বি যৌথভাবে গবেষণা করুক। অনুমোদন প্রক্রিয়ায় যাতে দেরি না হয়, সেজন্য আমি প্রতিষ্ঠান দুটির সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে গবেষণা প্রটোকল জমা দিব,' বলেন তিনি।