বাংলাদেশে মিথেন গ্যাসের রহস্যজনক উপস্থিতি ধরা পড়ল স্যাটেলাইটে
বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটে যেসব দেশ সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে তন্মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘন মিথেন গ্যাসের রহস্যজনক ধূম্রের উপস্থিতি মিলেছে।
মিথেনের গ্রীনহাউজ এফেক্ট বা বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করার ক্ষমতা কার্বন ডাই অক্সাইডের চেয়েও বহুগুণ বেশি।
ফলে বাংলাদেশের বাতাসে মিথেন গ্যাসের এই উপস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিজ্ঞানীরা। দেশটি বায়ুমণ্ডলে মিথেনের নিঃসরণে বড় ভূমিকা রাখছে বলে মনে করা হচ্ছে।
কেইরোস এসএএস নামক একটি প্যারিসভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এ বছর বাংলাদেশে মিথেন গ্যাস নিঃসরণের ১২টি উচ্চমাত্রার উৎস নির্ধারণ করেছে।
জিএইচজিস্যাট ইনকরপোরেশনের প্রেসিডেন্ট স্টেফানি জার্মেইন বলেছেন, "এখানে আমরা সবচেয়ে শক্তিশালী এবং টেকসই মিথেন নিঃসরণের প্রমাণ পেয়েছি তবে এর উৎস আমরা স্পষ্টভাবে শনাক্ত করতে পারছি না"।
এদিকে ব্লুফিল্ড টেকনোলজিস ইনকরপোরেশন নামক একটি প্রতিষ্ঠান গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার ওপরে বিপুল পরিমাণ মিথেনের আস্তরন জমে থাকতে দেখে। এ প্রতিষ্ঠানটি ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির ডাটা পর্যালোচনা করে থাকে। তারাই আবার বাংলাদেশের ওপরেও মিথেনের ঘন আবরণের হদিস পেয়েছে।
ব্লুফিল্ড টেকনোলজিসের প্রতিষ্ঠাতা ইয়োতাম এরিয়েল বলেন, "স্যাটেলাইটের মাধ্যমে শনাক্তকৃত বিশ্বে সবচাইতে বেশি মিথেন নিঃসরণকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম"।
বিজ্ঞানীরা এখন জোরেশোরে মিথেন গ্যাসের উৎস চিহ্নিত করতে নেমে পড়েছেন।
তবে মেঘের আচ্ছাদন, বৃষ্টি বা তুষারপাত এবং আলোক তীব্রতার ভিন্নতার ফলে প্রায়শই নিঃসরিত গ্যাস শনাক্ত করা স্যাটেলাইটের জন্য কঠিন হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশ থেকে যে মাত্রায় মিথেন গ্যাস নিঃসরিত হচ্ছে, তা আন্তর্জাতিকভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কম উচ্চতা এবং অধিক জনসংখ্যার কারণে এই দেশের প্রতিকূল অবস্থান একে জলবায়ুগত বিপর্যয়ের তীব্র ঝুঁকির মুখে রেখেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকির মুখে থাকা দেশগুলোর জোট ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) চেয়ার বর্তমানে বাংলাদেশ। বিশ্বের ৪৮টি দেশ সিভিএফের সদস্য যার ১২০ কোটি মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
স্যাটেলাইট চিত্র ধারণের মাধ্যমে ঢাকার আশেপাশের স্থানে শক্তিশালী মিথেনের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে।
এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন বলেছেন, "এ সমস্যা সম্পর্কে আমরা অবগত"। তার মতে, মিথেনের সবচেয়ে বড় অংশ নিঃসরিত হয় ধানক্ষেত থেকে। কৃষকরা যখন তাদের জমিতে সেচ দেন, তখন ভেজা মাটিতে জমে থাকা ব্যাকটেরিয়া প্রচুর পরিমাণে গ্যাস নিঃসরণ করে।
তিনি আরও বলেন, "মিথেনের আরেকটি উৎস হলো ল্যান্ডফিল গ্যাস (মাটিতে কঠিন বর্জ্য পদার্থ জমতে জমতে এক সময় এ গ্যাস উন্মুক্ত হয়ে পড়ে)"। এ বিষয় সমাধানে প্রশাসন কাজ করছে বলে মন্ত্রী উল্লেখ করেন।
গ্লোবাল মিথেন ইনিশিয়েটিভের মতে, গৃহপালিত পশু, তেল ও গ্যাসক্ষেত্রের লিকেজ, জমিতে আবদ্ধ গ্যাস এবং কয়লা খনি হলো মনুষ্যসৃষ্ট কিছু কারণ যা থেকে মিথেন গ্যাস নিঃসরিত হয়।
এনভায়রনমেন্টাল ডিফেন্স ফান্ড মনে করে, বর্তমানে বৈশ্বিক উষ্ণতার কমপক্ষে এক-চতুর্থাংশের জন্য এই মনুষ্য সৃষ্ট মিথেন নিঃসরণ দায়ী।
কেইরোস এসএএস বলছে, ধানক্ষেত, ল্যান্ডফিল গ্যাস, প্রাকৃতিক গ্যাসলাইনের লিকেজ থেকে বের হয়ে আসা গ্যাস এবং কয়লাখনি থেকে বাংলাদেশের মিথেন নিঃসরণ হয় বেশি।
স্যাটেলাইটে প্রাপ্ত তথ্য ব্যবহার করে এসব জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি এন্ড ক্লিন এয়ারের প্রধান বিশ্লেষক লরি মাইলিভির্তা বলেছেন, "সঠিক পর্যবেক্ষণ এবং তথ্য বিশ্লেষণের ফলে গ্রিনহাউস গ্যাস ও অন্যান্য বিভিন্ন বায়ু দূষণকারী উপাদানের উৎস চিহ্নিত করে সেসব প্রতিরোধের সুযোগ বের করবার এটি একটি দুর্দান্ত উদাহরণ"।
যারা জলবায়ু পরিবর্তনের গতি ধীর করতে কাজ করছেন তাদের জন্য মিথেনের উর্ধ্বমুখী নিঃসরণ বিশেষ উদ্বেগের। এটি একটি গন্ধহীন, বর্ণহীন গ্যাস এবং একে সহজে শনাক্ত করা যায় না।
ইডিএফের প্রধান বিজ্ঞানী স্টিভেন হামবার্গ বলেন, "আমরা বাংলাদেশ জুড়ে মিথেনের যে ঘনত্ব দেখতে পাই, তা আমাদের একটি সতর্কসংকেত দিচ্ছে এবং এটি আরও গবেষণার দাবি রাখে"।
হামবার্গ বলেন, "মিথেন নির্গমনের উৎস এবং নির্ভরযোগ্য পরিমাণগত অনুমানের জন্য আরও অনেক কাজ করা প্রয়োজন।"
- ব্লুমবার্গ অবলম্বনে