বাংলাদেশে শিশু শ্রমের পর্যাপ্ত তথ্য নেই
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নির্মূলের লক্ষ্য থাকলেও বৈশ্বিক এ উন্নয়ন দলিল প্রণয়নের ছয় বছরের মাথায় এসে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে দেশে শিশুশ্রমের কোনো হালনাগাদ তথ্য নেই।
সংস্থার ২০১৩ সালে পরিচালিত সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশে ৩ কোটি ৯৬ লাখ শিশুর ৯ দশমিক ৭ শতাংশ অর্থাৎ, ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু কোনো না কোনো শ্রমে নিয়োজিত। এর মধ্যে, ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত আছে ।
এসডিজির লক্ষ্য অর্জনের বেজলাইন নিরূপণ ও শিশুশ্রমে করোনা মহামারির নেতিবাচক প্রভাব তুলে ধরতে প্রায় নয় বছরের ব্যবধানে শিশু শ্রম সংক্রান্ত সমীক্ষা পরিচালনা করছে বিবিএস।
গতকাল বুধবার রাজধানীর একটি সম্মেলন কেন্দ্রে আয়াজিত ইনসেপশান ওয়ার্কশপে এ সব তথ্য জানানো হয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অর্থায়নে পরিচালিত এই জরিপের ফলাফল আগামী বছরের জুনে প্রকাশ হবে বলে অনুষ্ঠানে জানানো হয়েছে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, "সকল শিশুর কল্যাণ নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। তবে সবাই যে সমান সুযোগ পাচ্ছে তা নয়। সরকারের দায়িত্ব সকলের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে এনে শিশুদের জন্য ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা।"
শিশুশ্রমকে জীবনের একটি বেদনাদায়ক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করে মন্ত্রী বলেন, "এ ধরনের কাজ খুবই ভযঙ্কর।" শিশুশ্রম নিরসনে সবাইকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান মন্ত্রী।
অনুষ্ঠানে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ইয়ামিন চৌধুরী বলেন, "২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশু শ্রম নির্মূলের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। অথচ বর্তমানে শিশু শ্রমের পরিস্থিতি কোথায় রয়েছে এ সংক্রান্ত কোন বেজলাইন ডেটা নেই।"
তিনি আরও বলেন, পরিবহন খাতে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম ভয়াবহ পর্যায়ে বেড়েছে। এমনকি নতুন যোগ হওয়া কিছু গনপরিবহনে শিশুরা চালক হিসেবেও নিয়োজিত আছে।
"করোনায় অর্থনীতির ক্ষতি পরিমাপ করতে একটি র্যাপিড সার্ভে পরিচালনা করছে বিবিএস। এতে মানুষের আয় ও কর্মসংস্থান সম্পর্কে কিছু ধারণা থাকবে," বলেন তিনি।
আইনে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ থাকায় মালিকপক্ষ গোপনে শ্রমিকদের নিয়োগ দেয় বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, "শিশু শ্রমের প্রকৃত তথ্য বের করা অনেক কঠিন কাজ।"
একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রনালয়ের সচিব এহসান-ই-এলাহী
তিনি বলেন, "অনেক কারখানায় শিশুদের দিয়ে রাতের বেলায় কাজ করানো হয়। লোকবলের অভাবে কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের পক্ষে সব তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না।"
তিনি আরও বলেন, "সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত কারখানা পরিদর্শনের নির্দেশনা রয়েছে। অথচ রূপগঞ্জ এলাকার কারখানাগুলো একবার করে পরিদর্শন করতে কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের ওই এলাকায় নিয়োজিত জনবলের পাঁচ বছর সময় লেগে যাবে।"
শিশুশ্রম নিরসনে নজরদারি বাড়াতে তিনি পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করেন।
অনুষ্ঠানে তিনি জানান, তৈরি পোশাকসহ ছয়টি শিল্প খাতে শিশুশ্রম একেবারেই নির্মূল হয়েছে। আরও বেশ কিছু খাতে তুলনামূলক ভালো অগ্রগতি হয়েছে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পোটিআইনেন বলেন, "টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে শিশুশ্রম নিরসনে আরো উদ্যোগী হতে হবে। চার বছরের মধ্যে শিশুশ্রম নিরসন কার্যক্রমে সফলতা পাওয়া চ্যালেঞ্জিং বলেও মন্তব্য করেন তিনি।"
বিবিএস মহাপরিচালক তাজুল ইসলাম বলেন, "২০০২ সালে শ্রমে জড়িত ছিল দেশের ৭৪ লাখ শিশু। এ সংখ্যা পরের এক দশকে ৫৮ শতাংশ কমেছে। তবে লম্বা সময় ধরে কোনো জরিপ না হওয়ায় এ সংক্রান্ত তথ্যে কোনো হালনাগাদ নেই।"
তিনি বলেন, "করোনা মহামারিতে স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। পরিবারের আয় কমে যাওয়ায় এ সময় অনেক শিশু কাজে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছে। এ অবস্থায় শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পরিকল্পনা প্রণয়নে শিশুশ্রম সংক্রান্ত জরিপ পরিচালনা জরুরি হয়ে পড়েছে।"
প্রকল্প পরিচালক এবং বিবিএস পরিচালক কবির উদ্দীন অনুষ্ঠানের মূল বিষয় উপস্থাপন করে। তিনি বলেন, "শিশুশ্রমের মাধ্যমে শোষণের শিকার শিশুরা কাজের কারণে তাদের শৈশব হারাচ্ছে ও স্কুলে যেতে পারছে না। ফলে, তারা শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।"
২০১৩ সালে পরিচালিত জরিপের উল্লেখ করে তিনি বলেন, ৮৯ দশমিক ৩ শতাংশ শিশুশ্রম অনানুষ্ঠানিক খাতে হয়ে থাকে এবং মেয়ে শিশুদের ক্ষেত্রে এই হার ৯৬ দশমিক ২ শতাংশ।