বিএসটিআই’র ব্যর্থতায় মান পরীক্ষা ছাড়াই বাজারজাত হচ্ছে আমদানিকৃত টাইলস
ঢাকার আমদানিকারক নিউ মদিনা ট্রেড সেন্টার ভারত থেকে ১,৮০০ স্কয়ার মিটার টাইলস আমদানি করে। ২০১৯ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউট (বিএসটিআই) এর সাময়িক ছাড়পত্রের ভিত্তিতে পণ্য চালানটি চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস শেষে বাজারজাত করা হয়। সাময়িক সনদ প্রদানের ৯ মাস ২৫ দিন পর ২০২০ সালের ২৯ জুলাই বিএসটিআইয়ের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে জানা গেলো আমদানি হওয়া টাইলস এর চালান মানসম্মত নয়। সেজন্য বিএসটিআই আমদানিকারকের অনুকুলে ইস্যু করা সাময়িক ছাড়পত্র প্রত্যাখ্যান করে। তবে এরই মধ্যে আমদানি হওয়া টাইলস বাজারজাত হয়ে গ্রাহক পর্যায়ে পৌছে গেছে।
শুধু নিউ মদিনা ট্রেড সেন্টারই নয়, ২০১৯ সালের ১০ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে এরকম বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ১ হাজারের বেশি টাইলসের চালান বিএসটিআইয়ের পরীক্ষা ছাড়াই বাজারজাত হয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া অনেক প্রতিবেদনও দেওয়া হয়েছে নির্ধারিত সময়ের পরে। টাইলস এর মান পরীক্ষা করে ৬০ দিনের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও এক বছরেও তা দিতে পারছেনা প্রতিষ্ঠানটি।
মানহীন টাইলস ক্রয় করে রীতিমতো প্রতারিত হচ্ছেন গ্রাহকরা। অবকাঠামো নির্মাণে ব্যবহৃত এসব টাইলস অল্প দিনে নষ্ট হয়ে গ্রাহকরা আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন গ্রাহকরা। ঘটনায় বিএসটিআই কর্তৃপক্ষের অদক্ষতাকে দায়ী করছে সংশ্লিষ্টরা।
কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, বিএসটিআই'র মান পরীক্ষা ছাড়া টাইলস বাজারজাত হওয়ার ঘটনা উদ্বেগজনক। মানহীন টাইলস ব্যবহারের কারনে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হুমকির মধ্যে পড়ছে। এই ঘটনায় অবশ্যই আমদানিকারক এবং বিএসটিআই কর্তৃপক্ষের যোগসাজশ রয়েছে।
বাংলাদেশ টাইলস ডিলার্স এন্ড ইমপোর্টার্স এসোসিয়েশন এর দায়েরকৃত রিট পিটিশান নং ৩৫৪৭/২০১০ এর আদেশে বলা হয়, বিএসটিআই সাময়িক ছাড়পত্র প্রদানের পর ৬০ দিনের মধ্যে চূড়ান্ত ছাড়পত্র প্রদানে ব্যর্থ হলে পণ্যসমুহ পরীক্ষণে কৃতকার্য হবে।
অন্যদিকে, কাস্টম আইন অনুযায়ী সাময়িক শুল্কায়নের ১২০ কর্মদিবসের মধ্যে চূড়ান্ত শুল্কায়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ১,৪৩৭ টি টাইলস এর চালান আমদানি হয়েছে। ১,১০,২৮৭ মেট্রিক টন ওজনের এসব টাইলস এর শুল্কায়নযোগ্য মুল্য ৩৪৪ কোটি ৪৪ লাখ ৬৩ হাজার ৮২২ টাকা। সবচেয়ে বেশি টাইলস আমদানি হয় চীন থেকে। এছাড়া কলম্বিয়া, স্পেন, হংকং, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, থাইল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আমেরিকা, তুর্কি থেকেও আমদানি হয় টাইলস।
বিএসটিআই চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের তথ্য মতে, ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ১,৫৭১ টি টাইলস নমুনার অনুকুলে সাময়িক ছাড়পত্র প্রদান করে। এই সময়ের মধ্যে চূড়ান্ত ছাড়পত্র দিতে পেরেছে ৫১৬ টি নমুনার।
কাস্টমস সূত্র জানায়, বিএসটিআই এর সাময়িক ছাড়পত্র নেওয়ার পর বন্দর থেকে পণ্য ছাড় করতে কাস্টম হাউসে অঙ্গীকারনামা প্রদান করে আমদানিকারক। এতে আমদানিকারক উল্লেখ করে, চূড়ান্ত পরীক্ষায় সংশ্লিষ্ট বিডিএস অনুযায়ী ছাড়কৃত মালামালগুলি যদি টেস্টে অকৃতকার্য হয় তাহলে নিজ দায়িত্বে বিএসটিআইয়ের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে নিম্নমানের আমদানিকৃত মালামাল ধ্বংস করব, এমনকি কাস্টম আইন অনুযায়ী যে কোন সিন্ধান্ত মেনে নেবো।
অন্যদিকে ৬ টি শর্তে আমদানিকারককে সাময়িক ছাড়পত্র প্রদান করে বিএসটিআই । এতে উল্লেখ করা হয়, বিডিএস আইএসও ১৩০০৬:২০১৫ অনুযায়ী পরীক্ষায় কৃতকার্য হলে বিএসটিআই চূড়ান্ত ছাড়পত্র প্রদানের পর আমদানিকারক উক্ত পণ্য বিক্রয় এবং বিতরণ করতে পারবে। কোন অবস্থাতেই চূড়ান্ত ছাড়পত্র না পাওয়া পর্যন্ত উক্ত পণ্য আমদানিকারক বাজারজাত করতে পারবেন না। এর ব্যত্যয় হলে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
বাংলাদেশ টাইলস ডিলার্স এন্ড ইমপোর্টার্স এসোসিয়েশন এর সাধারণ সম্পাদক গোলাম রসুল বেলাল বলেন, 'বিএসটিআই কর্তৃপক্ষ ৬০ দিনের মধ্যে চূড়ান্ত ছাড়পত্র দিতে না পারার কোন যৌক্তিক কারন থাকতে পারেনা। এটি বিএসটিআই কর্তৃপক্ষের অদক্ষতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমদাানিকারকদের হয়রানির উদ্দেশ্যে অযথাই জটিলতা সৃষ্টি করছে প্রতিষ্ঠানটি। এসব বিষয়ে একাধিকবার আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হলেও বিএসটিআই কর্তৃপক্ষের সাড়া মেলেনা।'
বিএসটিআই প্রধান কার্যালয়ের সার্টিফিকেশন মার্কস (সিএম) ইউং এর উপ পরিচালক মো: গোলাম বাকি বলেন, আমদানিকারকদের অযথা হয়রানির উদ্দেশ্যে প্রতিবেদন দিতে বিলম্ব হওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়। ১ বছর আগে যন্ত্রপাতি নষ্ট থাকার কারনে প্রতিবেদন দিতে বিলম্ব হয়েছে।
বিএসটিআই চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (সিএম) মো: মোস্তাক আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, টাইলস এর গুনগত মান, স্ট্রেনথ, সাইজ অনুযায়ী লেন্থ, ওয়াইড, থিকনেস, পানি শোষন ক্ষমতা সহ মোট ১৩ টি পরীক্ষা করে বিএসটিআই। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ১১ টি এবং ঢাকায় দুটি পরীক্ষা হতো। সব পরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হতো। চলতি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ১৩ টি পরীক্ষা চট্টগ্রাম বিএসটিআই এর ল্যাবে সম্পন্ন হচ্ছে বলে দাবী করেন মোস্তাক আহমেদ।
নিউ মদিনা ট্রেড সেন্টার এর স্বত্বাধিকারী তারিকুল ইসলাম বলেন, 'বিএসটিআই ৬০ দিনের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন না দেওয়ায় আমি টাইলস বাজারজাত করি। ৯ মাস ২৫ দিন পর বিএসটিআই বলছে পণ্যটি তাদের পরীক্ষায় মানোত্তীর্ণ নয়। কাস্টমস থেকে পণ্য খালাসের আগে অঙ্গীকারনামায় উল্লেখ করা হয় মালামালগুলি যদি টেস্টে অকৃতকার্য হয় তাহলে নিজ দায়িত্বে বিএসটিআইয়ের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে নিম্নমানের আমদানিকৃত মালামাল ধ্বংস করব। বিডিএস মান বহির্ভূত পণ্য আমদানির অভিযোগে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আমাকে শুনানীতে ডেকেছে। বিএসটিআইয়ের ব্যর্থতার কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। এই দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়েছি।'
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের সহকারী কমিশনার আমিনুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বিএসটিআই কর্তৃপক্ষ চূড়ান্ত ছাড়পত্র দিতে না পারায় টাইলস এর চালানের চূড়ান্ত শুল্কায়ন সম্পন্ন করা যাচ্ছেনা। এতে প্রতিটি চালানের অধীনে শুনানী নিতে হচ্ছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে। চূড়ান্ত শুল্কায়নের সময়সীমা পেরুনো এক হাজারেরও অধিক ফাইল নিয়ে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ রীতিমতো বেকায়দায় পড়েছে। এসব বিষয়ে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে নির্দেশনা চাওয়া হবে।'