বিষাক্ত ‘জে নাট’ জাহাজ আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা
আগামী ৭ মে বাংলাদেশ আসার কথা ছিল বিষাক্ত জাহাজ 'জে নাট' (J. NAT)। ইন্দোনেশিয়া থেকে আসার কথা ছিল এটির। কিন্তু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর জাহাজটি আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে শিল্প মন্ত্রণালয়। অবৈধভাবে এ জাহাজ দেশে আনা হলে পরিবেশ ও শ্রমিকরা ঝুঁকিতে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এর আগেও বাংলাদেশে বিভিন্ন বিষাক্ত জাহাজের গন্তব্য থাকলেও বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাংবাদ প্রকাশিত হলে বন্ধ হয় ওইসব জাহাজ আমদানি। বাংলাদেশের আইন আনুযায়ী এ ধরনের জাহাজ আমদানিতে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা।
শিল্প মন্ত্রলালয়ের উপসচিব মো. আবুল খায়ের স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, জে নাট এক্স জেসলাইন নাটুনা জাহাজটি বিষাক্ত। বিপুল পরিমাণ বিষাক্ত বর্জ্যসহ সেটি ইন্দোনেশিয়া থেকে বাংলাদেশের দিকে রওনা হয়েছে। এমতাবস্থায় বিএসবিআররের সকল সদস্যদের সতর্কতা অবলম্বন করে নির্দেশনা প্রদানের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
দেশের একমাত্র গ্রিন শিপ ইয়ার্ড পিএইচপি শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিএসবিআরের নির্বাহী সদস্য জহিরুল ইসলাম রিংকু বলেন, আমরা ১০ থেকে ১২ দিন আগে বিষয়টি জানার পর জাহাজটি না কেনার কথা সমিতির সকল সদস্যকে জানিয়েছি। কারণ, এ ধরনের জাহাজ ক্রয়ের মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। তাছাড়া এ বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে আমদানি না করার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ প্রতিবছর ৩০ লাখ টনের স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করে গত বছর শীর্ষস্থান দখল করে। মাত্র ১৫ হাজার টনের এ জাহাজ কেন আমদানি করতে যাবে ব্যবসায়ীরা। আগেও এ ধরনের জাহাজ কিনে অনেকে বিশাল অংকের ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়েছে।
এ নিয়ে এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাট ফর্মে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জে নাট নামের ভাসমান স্টোরেজ এবং অফলোডিং (এফএসও) জাহাজটি মেয়াদ উত্তীর্ণ। অফশোর তেল ও গ্যাস সংস্থাগুলো তেল সংরক্ষণের জন্য এটি ব্যবহার করত।
জাহাজটি আগে জেসলাইএন নাটুনা নামে পরিচিত ছিল। এটি নটুনা গ্যাস ক্ষেত্রে চালিত এবং ইন্দোনেশিয়ান কোম্পানি গ্লোবাল নায়াগা বেরসমা পিটি'র মালিকানাধীন ছিল। এটি সম্প্রতি নগদ ক্রেতা সোম্যাপ ইন্টারন্যাশনালের কাছে বিক্রি হয়। তারা এর নাম পরিবর্তন করে রাখে জে নাট। এটি এখন পালাউ'র পতাকাবাহী। সোম্যাপ হলো বিশ্বব্যাপী স্ক্র্যাপ জাহাজ ক্রয় বিক্রয়ের একটি স্বীকৃত সংস্থা।
জে নাট গত ১৮ এপ্রিল ইন্দোনেশিয়া থেকে ছেড়ে যায়। স্থানীয় কর্মীরা জাহাজের বিষাক্ততার বিষয়ে ইন্দোনেশিয়ান সরকারকে সতর্ক করেছিলেন। ট্যাংকারটিতে ১৫০০ টনেরও বেশি বিপজ্জনক বর্জ্য রয়েছে। যার মধ্যে ১০০০ টন স্লপ অয়েল, ৫০০ টন তৈলাক্ত পানি (অয়েলি ওয়াটার) ৬০ টন স্ল্যাজ অয়েল রয়েছে। প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে ভাগ করা একটি স্ল্যাজ নমুনার ল্যাব পরীক্ষা ৩৯৫ এমজি/কেজি মারকারি পাওয়া যায়। ফলে ধারণা করা হচ্ছে জাহাজটিতে উচ্চমাত্রার মারকারি ও বালাস্ট ওয়াটার থাকতে পারে।
এ প্রক্ষিতে এনজিও শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্ম, বাসেল অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (বিএন), ইউরোপীয় পরিবেশ ব্যুরো (ইইবি), আইপেন, নেক্সাস ৩ ফাউন্ডেশন এবং জিরো মার্কারি ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক বর্জ্য আইন লঙ্ঘনের বিষয়ে সতর্ক করেছে। পাশাপাশি এটির আমদানি বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। অবৈধভাবে যদি এ জাহাজ আনা হয়, তবে শ্রমিকদের মারাত্মক ঝুঁকি ও পরিবেশ দূষিত করবে মনে করছে সংস্থাগুলো।
বিষাক্ত জাহাজ আনার যত চেষ্টা
এর আগে ২০১৬ সালের আগস্টে জনতা স্টিল করপোরেশন ড্যানিশ জাহাজ প্রতিষ্ঠান মার্কসের কাছ থেকে এমটি প্রডিউসার নামের জাহাজটি কেনে এবং তা ভাঙার জন্য দেশে আমদানি করে। জাহাজটি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে মন্ত্রণালয় থেকে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি জাহাজটিতে উচ্চমাত্রার রেডিওঅ্যাকটিভ ম্যাটারিয়েল পায়। তবে প্রচলিত আইন ও আদালতের আদেশ অমান্য করে এমটি প্রডিউসারকে আমদানি, সৈকতায়ন ও ভাঙার অনুমতির বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ২০১৭ সালের জুনে হাইকোর্টে রিট করে। কিছু অংশ কেটে ফেলা হলেও জাহাজটি ওইভাবে পড়ে আছে ইয়ার্ডে।
এছাড়াও অতীতে এসএস নরওয়ে, এমটি আলফা, এমটি অ্যাপশেরনের মতো বিষাক্ত জাহাজ বাংলাদেশের ভাঙার গন্তব্য হলেও বিভিন্ন মহলে আলোচনার কারণে তা আনতে পারেনি আমদানিকারকরা।
বিষাক্ত জাহাজ নিয়ে উচ্চ আদালতের রায়
পরিবেশ ছাড়পত্র অমান্যকারী জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ডে জাহাজের আমদানি ও ভাঙার ক্ষেত্রে কোনো অনুমোদন দেওয়া যাবে না। একইসঙ্গে জাহাজের বর্জ্য বিষয়ে পুরোপুরি এবং বিস্তারিত তথ্য ছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক ভাঙার জন্য কোনো জাহাজ আমদানি ও সৈকতায়নের অনুমতি প্রদান বন্ধ রাখতে হবে।
রায়ে হাইকোর্ট পরিবেশ সম্মত ব্যবস্থাপনা ছাড়াই জাহাজ ভাঙার অনুমতি দেওয়াকে বেআইনি ঘোষণা করে চার দফা নির্দেশনা দিয়েছেন।
এগুলো হচ্ছে, জাহাজ আমদানির ক্ষেত্রে বর্জ্য মুক্ত সনদ প্রদানকারী সংস্থার তালিকা দেওয়া। জাহাজের পতাকা পরিবর্তন রোধে এবং বর্জ্য বিষয়ে সঠিক তথ্য নিশ্চিতকরণে 'ধূসর' এবং 'কালো' পতাকাবাহী দেশ হতে জাহাজ আমদানি নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। জাহাজের বর্জ্য বিষয়ে পুরোপুরি এবং বিস্তারিত তথ্য ছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক ভাঙার জন্য কোনো জাহাজ আমদানি ও সৈকতায়নের অনুমতি প্রদান না করা। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর বর্জ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক আইন বাসেল কনভেনশন; দেশে প্রচলিত জাহাজ ভাঙা বিষয়ক বিধিমালা প্রতিপালন নিশ্চিত করতে হবে।
২০১৯ সালে ১৪ নভেম্বর 'এমটি প্রডিউসার' নামে একটি বিষাক্ত জাহাজ আমদানির ওপর পরিবেশ আইনবিদ সমিতির রিটের প্রেক্ষিতে এ আদালত এ আদেশ দেন।
এ প্রসঙ্গে জাহাজ ভাঙ্গা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইপসার কো-অর্ডিনেটর মোহাম্মদ আলী শাহীন বলেন, বাসেল কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী বাংলাদেশে এ রকমের জাহাজ আমদানির অনুমতি দেওয়া আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। তাছাড়া এমটি প্রডিউসার নামের একটি বিষাক্ত জাহাজ আনা হলেও তা আদালতের আমদানি অবৈধ ঘোষণা করে এবং ভাঙ্গার জন্য পরিবেশসম্মদ ও কঠিন শর্ত আরোপ করে। এছাড়া আরও কয়েকটি বিষাক্ত জাহাজের গন্তব্য বাংলাদেশে হওয়ার আগেই গণমাধ্যমে লেখালেখির কারণে তা আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়।